অর্ঘ্য দে







মধুবনি হাওয়া

(মুক্ত গদ্য)


    এই একখণ্ড জলাশয় হয়তো মানচিত্র বহির্ভুত। অক্ষরেখা দ্রাঘিমারেখার জালে ধরা পড়েনি। কার্তিকের আবছা আলো অনেকক্ষণ আটকে আছে জলীয় দর্পণে। অতলস্পর্শী হাওয়া বইছে। মিষ্টি একটা গন্ধ। আমার তালতোবড়ানো শরীরটাকে নিরেট করার চেষ্টায় যেন নিযুক্ত হয়েছে। ভীষণ সপ্রতিভ। শরীরটা নিরেট হয়ে গেলে হাঁসেদের মতো হয়ে যাব। তখন আর ভেসে থাকতে বাধা থাকবে না। উন্মুক্ত জলবিহারে খুঁজে পাব নির্বাণের পথ।

    

    এদিক ওদিক ঘাসফুল ফুটে আছে। ওদের ছুঁয়ে উড়ে গেল প্রজাপতি। আমার শরীরে পাপড়ি নেইশুধুই খরতা। মধুবনি হাওয়ায় ভেঙে যায় সেই খরতা। বেরিয়ে পড়ে শিশুর নগ্নতা। মনে হয় ফিরে যাই আদিতে। আরেকটি বার শুরু করি শূন্যমুখ উৎস থেকে। অবিন্যস্ত পা ফেলি সবুজে। ফের অজানা হয়ে যাক অতিক্রান্ত পথ। খুলে যেতে পারে দিশা যা অনতিক্রম‍্য। 

 

    পিছুটান নেই বলেই মধুবনি হাওয়া হয়তো যুঝতে পারে। নাহলে খুঁতে ভরা এই টোল খাওয়া পৃথিবী থেকে কবেই লুপ্ত হয়ে যেত প্রাগৈতিহাসিকদের মতো। অস্তিত্বের লড়াই আছে কিন্তু জিঘাংসা নেই। মধুবনি হাওয়ায় অশ্রুত সভ্যতার রূপকথা। কান পাতলে শোনা যায় বৈদিক গ্রামের শ্লোক নারীকন্ঠের কুসুমকোমল উচ্চারণ। স্নিগ্ধ, মাতৃসুলভ। আমাকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে। অসীমে জ্বলে ওঠে একটা দুটো তারা। নক্ষত্ররাজ্যের পত্তন হয়। আমার স্নায়ুকোষে যেন নূপুরের মৃদু রিনিঝিনি। মধুবনি হাওয়ার আনাগোনা বাড়ে। মুখের সিগারেট নিভে যায়। আমার সংজ্ঞাতন্ত্রে কম্পিত হতে থাকে নৃত্যগীতের মণ্ডলী। সম্পূর্ণ অচেনা সেই সুরমণ্ডলে যেন আমার অজ্ঞাতবাসের সূচনা হল। মুছে যাচ্ছে সমস্ত ভৌগোলিক রেখা, উপরেখা। সন্ধ্যাপ্রদীপের মতো এক এক করে নিভে যাচ্ছে আপন পরের চেতনা, দ্বন্দ্ব। শত্রু-মিত্র বোধ। দায় নেই, দায়িত্ব নেই। জয়-পরাজয় গুরুত্বহীন, শুকনো পাতার মতো উড়ছে। উশৃঙ্খলভাবে উড়তে উড়তে জলাশয়ে পড়ে ভেসে যাচ্ছে অনন্তে। শমীবৃক্ষের কোটরে গচ্ছিত রাখলাম আমার সব অস্ত্র। মধুবনি হাওয়া শুধু আমার দোসর। অবিরাম ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় আমার শরীরে ফুটে উঠছে গীতিআলেখ্য। কোনও এক বাউলের দোতারায় উচ্চারিত হবে পলাশ রঙের দিনে।   

 

 

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন