মাঝে মাঝে সকাল হয়
নির্জন হ্রদের ধারে মাঝে মাঝে জোড়া নীল পাহাড়ের
করবী উজ্জ্বল খাঁজে আমার সকাল হয়
আকাশ যেখানে হাওয়ায় ঝলক ঝলক ওড়ে
কত ধূ ধূ লাল পাহাড়ি ফুলের গাছে ঝরে পড়ে
শঙ্খের মতন শান্ত মসজিদের স্তব্ধ চূড়ায়।
সেখানে সবুজ স্বচ্ছ আলোেভরা নিটোল ফলের ভারে নুয়ে
হ্রদের শীতল জল ছুঁয়ে
কমনীয় প্রণতির মতো স্নিগ্ধ এক জলপাই গাছ।
সেইখানে দেখি তুমি অসম্ভব গাঢ় মমতায়
মেদুর লাবণ্যঘন মাটি;
জলপাই গাছটির সূচিকন চুলের মতন
অসংখ্য শিকড় একা বুকে করে শুয়ে আছ।
মাঝে মাঝে এ রকম এক একটি সকালে
মনে হয় বেঁচে আছি, খুব ভাল লাগে।
আচমকা নীল ফাঁসি
ঘিরেছে হঠাৎ নীল বিদ্যুৎ আমাকে চতুর্দিক
শরীর ঠিকরে ওঠে জ্বলজ্বলে ওষ্ঠের রক্তাভা,
বাধা পড়ে গেছি আমি তাই অনিমিখ।
পাহাড়ি পাখির মতো স্পন্দিত উজ্জ্বল তার চুল
আঙুল মণিতে গাঁথা চমকে চমকে জ্বলে ওঠে
কথায় কথায় হাসি ঘুরপাক খায় তীক্ষ্ণ বৃষ্টি
ডুবে যেতে যেতে ভালোবাসি।
নিটোল আবর্তে যেন একমুখে ভাসা,
এই ছুটে ছুটে আসা একটি চূড়ায়
অন্ধকার স্তরে স্তরে গান গড়ে ওঠে।
বিরাট সমুদ্র ফুঁসে এক বার স্থির হয়ে থাকে,
ছটফটে নীল ফাঁসি নাচের ঘূর্ণিতে কাছে এল
আচমকা জড়াল আমাকে।
প্রিয়তম নেমিসিস
গ্রিক নাটকের স্তব্ধ নেমিসিস সারা দিন
কাঁপাচ্ছে আমাকে
আচমকা মাঝরাত্রে বুক ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙে যায়
কে যেন ব্যথিত চোখে ধুয়ে দিচ্ছে নিঝুম শরীর
কে যেন, কে যেন...
আজন্ম অজানা এক গান কিংবা উপহার
ভেঙেছে পাষাণতার ধ্যান
রক্ত শিরশির করে-
আবছা ফিরোজানীল ছায়া ফেলে আত্মার গম্বুজ
মেরুবাসী ভাল্লুকের লুকোনো পূর্বাশা
সে কি নির্জর সূর্যমন্দির?
চুম্বক পাহাড়, তার কাছে গেলে জাহাজের স্ক্রু খুলে যায়
আলগা হালকা নিষ্ঠ নির্জন শরীর।
দেবীমায়া
হালকা খয়েরি মেশা পুরনো সবুজ ভাঁজ
পাথরের একটি পল্লবে,
তোমার মুখের ছবি আঁকা, সন্ন্যাসিনী
দিকে দিকে তাম্র-নীল লালচে হরিৎ
ধোঁয়াটে শ্যামল গাছপালা
কত রঙবেরঙের উজ্জ্বল কাষায়
ওড়ে স্নিগ্ধ বনস্থলী থাক থাক গভীর পাহাড়ে
কোমল রুপোর শান্ত উড়ন্ত মন্দির
ডান হাতে দুলে ওঠে ভরা কমণ্ডলু।
হৃষীকেশ, কনখল, দেবপ্রয়াগের
জাহ্নবীর নীল দুধ কুলুকুলু গান
সামনের দিকে বয়ে যায়-
দীর্ঘ লোকালয়হীন হিমাচল, আরো বহু দূরে
ওঙ্কারধ্বনির মতো তার একটানা স্তব্ধ ধ্যান
ছুঁয়ে থাকে শুধু সারা দিন।
ছন্ন হরিণেরা
দিগন্ত উথলে পড়ল নিশ্চল বনের ফাঁকে ফাঁকে,
কুয়াশার মতো হাওয়া,
হরিণেরা ডাকে ঐ পুব দিক পানে।
তাদের গায়ের ফোঁটা
পাতার আলতো পিঠে ছুটন্ত বৃষ্টির দাগ।
একসঙ্গে জমে তারা, মুখনিচু, পরামর্শ করে
এই বন কার,
এই বাতাসের ক্ষার মাঘ মাসে কেন?
দীর্ঘশ্বাসে মনে হয় কেউ আছে, কোনো শুরু-
রাতের ওধারে গেলে তাকে খুঁজে পাবে,
চিতা বা হুড়ার নয়,
সে এক উন্মাদ কালো প্রধান আকাশ।
কে তাকে উপচে যাবে,
কোন্ ফাঁদে তাকে কাছে ডেকে দেখবে শেষ?
প্লুত হিম গানের রেশের মতো নখ তার পায়ে,
আর সেই শব্দ পেলে গাছেরা নির্মম হয়
যখন হরিণ ছায়া খোঁজে
খোঁজে উলুঘাসে তৈরি ঘর।
নিরুত্তর তাদের চোখের মতো নক্ষত্রের চোখ খুললে
অপার অজ্ঞান, কষা হতুকির স্বাদ।
সাদা, ঘোর সাদা মেঘ শাখা ও উপশাখায়
একটি নিথর স্তব্ধ হাতের মতন ঘনিয়ে রয়েছে তারপর।
দেবারতী মিত্র
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন