মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সমীর রায়চৌধুরীর গল্পের তুলনামূলক আলোচনা

অশোক তাঁতী

সমীর রায়চৌধুরীর ছোটগল্প - 
 সমীর রায়চৌধুরীর অধিকাংশ গল্পই বদ্ধমুখ নয়।, মুক্তমুখ। যেখানে থাকে এক গল্প থেকে অন্য গল্পে চলে যাওয়ার ইশারা । গল্প পরিব্যপ্ত হয় । পাঠক গল্পের ইশারার মধ্যে পান অসীমায়িত হওয়ার তাড়না অভিজ্ঞতা ব্যপ্ত হয় । যে অভিজ্ঞতা ছোটগল্পের তথাকথিত ক্যাননের নির্দিষ্টতাকে ভেঙে ফেলে । ছোটগল্পের এক , একক , একটিমাত্রর সুনির্দিষ্টটা বা নির্ণয়তার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে এইভাবে অনির্ণয়তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ফলে গল্প শেষ হয়ে হইল না শেষ হয়ে ওঠে । রাবীন্দ্রিক গল্পের সংজ্ঞা বলে যাকে চালানো হয় – যা আসলে তাঁর কবিতার অংশ গল্পের সংজ্ঞা নয় – তা যে ছোটছোট দুঃখকথা বলে , সেই দুঃখকথা এখানে থাকে না । কারণ দুঃখ এক বা এককের ধারনা , তার মধ্যে পরিপুরকতা থাকে না ।
 সুখের পরিপূরক দুঃখ নয় , তা সুখের বিপরীত । সমীরের গল্পে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে পরিপূরকতা , বিপরীত নয় । তথাকথিত রাবীন্দ্রিক সংজ্ঞাতে যে মুহুর্তে গল্পের শরীরে বিপরীতের প্রবেশ সেই মুহুর্তেই গল্পের সমাপ্তি । তখন গল্প তার চরম সীমাতে বিরাজ করে । যে উলম্বতাতে আরোহণ আধুনিক গল্পের পরম প্রাপ্তি । সমীরের গল্পে এই বদ্ধমুখ সমাপ্তি থাকে না । ফলে সেখানে পরম প্রাপ্তি বলে কিছু পাওয়া যায় না । সমীরের গল্প সেখানেই শেষ হয় যেখানে টেক্সট প্রসারিত হয় , সম্ভাবনাময় হয় । তাঁর কিছু গল্পের শেষ আমরা দেখতে পারি –
১) নবনীতাকে ‘ জানি ’ – তে তেমন মানায় না , ‘ জানি না ’ - তে ঢের বেশী রস । সে কেবল খুকু সেজে বলতে চায় , - আমি বাবা অতশত জানি না । যেমন , জানিনার রহস্য মশা তার কামড়ে একটু করে জানিয়ে যায় – ( কামড় )
২) অবশ্য রশিদ , জুবের , সাবির , মুকবুল ওরা জামাল আর নকভিকে যেমন বলে , তেমনই , এবার জানকেও যে বলবে শালা দোগলা ।
 তবে কি দোগলা হওয়াই – ( দোআঁশলা )
৩) সময়কে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় অবস্থানে পালটে নিতে ..... সময় আর অবস্থান জায়গা বদল করে , শেফালি পাশ ফেরে ... ( কালো রঙের কাজ ঃ আঁধারের অবিনির্মান )
উদাহরণ না বাড়িয়ে দেখা যায় কোন গল্পই যতিচিহ্নে শেষ হচ্ছে না । গল্প শেষে থাকে কিছু ডট্ অথবা ড্যাস । যা জানিয়ে যায় নতুনতর সম্ভাবনার কথা । যে সম্ভাবনার মধ্যে থাকে আনুভূমিকতা । এই শেষ হয়ে হইল না শেষের থেকে রাবীন্দ্রিক সমাপ্তির পার্থক্য আছে । এই শেষ থেকে কোন ক্যানন নির্ধারণ করা সহজ নয় । সম্ভাবনা বিস্তারের জন্য গল্পে থাকে পুরনো সম্ভাবনার প্রস্থানবিন্দু , যা হয়ে ওঠে নতুন সম্ভাবনার সূচনাবিন্দু । যে সূচনাবিন্দু ধারণ করে ডট্ বা ড্যাশকে । শুরু বা শেষের এই মিশ্র প্রকাশ তাঁর অধিকাংশ গল্পেই ।

 মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প-
 পক্ষান্তরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ফ্রয়েডীয় ধারনা বা মার্কসীয় বীক্ষাতে লিখিত। গল্পের শেষে কিছু প্রাপ্তি থাকে। তাঁর লেখা কয়েকটা গল্পের শেষ অংশ দেখা যেতে পারে ।
 ১) এদিকে আমার বেড়েছে চশমার পাওয়ার । কখনো দেয়ালে টিকটিকি না দেখার ইচ্ছা হলে আমার চোখ বুজতে হয় না – চশমাটা খুলে ফেল্লেই চলে । ( টিকটিকি )
২) নব্বই বছরের বুড়ো হারান সেইখানে মাটিতে মেয়ের কোলে এলিয়ে নাতির জন্য উতলা হয়ে কাঁপা গলায় বলে , ছোঁড়া গেল কই ! কই গেল ? হায় ভগবান ! ( হারানের নাত জামাই )
৩) কাপড় যে দিতে পারে না এমন মরদের পাশে আর শোব না বলে রাবেয়া একটা বস্তায় কতকগুলি ইঁট – পাথর ভরে মাথাটা ঢুকিয়ে গলায় বস্তার মুখটা দড়ি জড়িয়ে এঁটে বেঁধে পুকুরের জলের নীচে পাঁকে গিয়ে শুয়ে রইল । ( দুঃশাসনীয় )
এইসব উদাহরণে মানসিক অবস্থানের অনির্দিষ্টতা নেই । গল্পকার কোন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন না । অসংখ্য সিদ্ধান্তের মধ্যে কোনো একটাকে তিনি প্রাধান্য দিচ্ছেন না । ঘটনার শেষহীনতা থাকতে পারে । তবে তা কখনোই নতুন সম্ভাবনার বিস্তার নয় । মানিক সিঁড়ি ভাঙ্গা অঙ্কের মতো ধাপেধাপে যুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে গল্পের শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছেন । যুক্তির এই পর্যায়গুলোয় তিনি ফ্রয়েড বা মার্কসের তত্ত্বের ওপরে নির্ভরশীল ।
 সমীরের অধুনান্তিক আখ্যানের মধ্যে গল্প আসে পরিপূরক হিসেবে । মানিকের আধুনিক আখ্যানের মধ্যে গল্প আসে এক সমান্তরাল বুঝপ্রকরণের জন্য । যা অনুভূমিক নয় । এটা বোঝার জন্য আমরা দুজনের দুটো গল্পের কথা ভাবতে পারি। মানিকের ‘ টিকটিকি’ আর সমীরের ‘কামড়’ গল্প ।
 
 মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ টিকটিকি’
 ‘টিকটিকি’ গল্পে জ্যোতিষার্ণব দোতলা বাড়ির এক তলায় থাকে । তার ছেলেমেয়ের মা একদিন সকালে তাকে জিজ্ঞাসা করে , ‘আমি মরলে তোমার কি উপায় হবে ?’ তখনই একটা টিকটিকি ডেকে ওঠে । সেদিন সন্ধেয় সে মারা যায় । তার ছেলেমেয়ের মা তার স্ত্রী নয় । তাই স্বর্গে যাওয়ার অধিকার তার আছে কি না , জ্যোতিষার্ণব বুঝতে পারে না । কারণ স্বর্গ কথাটা উচ্চারিত হলে কোনো টিকটিকিই ডেকে ওঠে না । এজন্য জ্যোতিষার্ণব রেবতীকে মরে গেলে স্বর্গে যাওয়ার অধিকার সহ অর্থাৎ বিয়ে করে আনে । কিন্তু সে ভয় পায় , রেবতী যেন কখনও মৃত্যুর কথা না বলে । তাই রেবতীর খেলার সাথী , যাকে জ্যোতিষার্ণব তার স্ত্রীর সাথে পরকীয়া সম্পর্কের সন্দেহে হাত দেখে ভয় দেখায় , বলে টিকটিকিগুলোকে মারতে। কিশোরের আলপিন বিঁধে টিকটিকির চোখের দুপাশে দুটো নতুন চোখের ক্ষত তৈরী হয়ে দুফোঁটা রক্ত জমলে জ্যোতিষার্ণব বলেন – টিকটিকিকে চারচোখো করে দিলে ? তোমাকেও চারচোখো হতে হবে । / সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ালে কোথায় যেন একটা টিকটিকি ডেকে ওঠে । ’’
কিশোরের চশমা হয় । বন্ধুরা তাকে চারচোখো বলে রাগাতে শুরু করে । রেবতীর প্রতি বিতৃষ্ণায় সে আর কখনও জ্যোতিষার্ণবের বাড়িতে যায় না । রেবতীর খবরও রাখে না ।
 
 সমীর রায়চৌধুরীর ‘কামড়’
কামড় গল্পে আটমাসের গর্ভবতী নবনীতা ও বরুণের বাড়িতে এক ফোঁটা রক্তের জন্য পোয়াতি স্ত্রীকে পাঠিয়ে পুং মশা ভাবে বাবুরা না মেরে ফেলে। স্প্রে , চাপড় , ডিডিটি , বিএইচসি, পায়রেথ্রাম, বেনজিন হেক্সাক্লোরাইড ইত্যাদির ব্যবহার বাড়ছে । মশা মানুষের হাত থেকে বেঁচে কিভাবে বংশবিস্তার করতে পারে সেই কথা ভাবে । আর নবনীতা মশাদের হাত থেকে বেঁচে কিভাবে তার সন্তানের জন্ম দিতে পারে সেই কথা ভাবে । তথাকথিত অর্থে কোনো গল্প থাকে না এই গল্পের ভেতরে । প্রকৃতি, মানুষ, মানুষের প্রকৃতি ঘিরে আবর্তিত হয় গল্পটা ।
 
 কল্লোল যুগ থেকে অধুনান্তিক স্পেস
 মানিক উত্তর-কল্লোল যুগের লেখক । গল্পের রাবিন্দ্রীক অধুনিকতাকে যে যুগ আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল । অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর মতে কল্লোল যুগ ‘ জিজ্ঞাসা ও নৈরাশ্য , সংগ্রাম ও অপূর্ণতা ’ এই দুই যতির মধ্যে দুলছে । আধুনিক জীবনের সংশয় ও ক্লান্তি নিয়ে মানিক অন্যরকম আত্মপ্রকাশের ভঙ্গি নিয়ে এলেন । যা মনস্তত্ত্ব নির্ভর । মানিকের ‘টিকটিকি’ গল্পে মানুষের আচার – আচরণ ও গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে মানুষের মনস্তত্ত্বের সমান্তরাল টিকটিকির ত্রিকালদর্শী ভূমিকা ।
 কামড় গল্পে আসে মশাদের কথা । মশার কামড়ের মনস্তত্ত্ব , ভাষাতত্ত্ব , বংশগতি , জ্বালা , যন্ত্রণা , মানুষের প্রকৃতিস্থতা থেকে বিচ্ছিন্ন একক জীবনের কথা , মশা বিষয়ক গালাগালির সমাজ মনস্তত্ব , স্ত্রীস্বাধীনতা , বহুগামিতা , মশার জীবনচক্র ইত্যাদি । এই গল্পটা সমীরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখা না হলেও টিকটিকি গল্পের মত সমান্তরাল দুটো ঘটনার একসাথে উচ্চারণের জন্য গল্পটাকে নির্বাচিত করা হয়েছে ।
 মানিকের গল্পে টিকটিকি আসে মনস্তাত্ত্বিক অনুষঙ্গে , জ্যোতিষের ছদ্মবেশে । গল্পের মধ্যে আছে দুটো গল্প - জ্যোতিষার্ণবের প্রথমা স্ত্রীর ও এক কিশোরের । অথচ টিকটিকি ঘিরে আবর্তিত হয় গল্পটা । ‘ টিকটিকি’ গল্পের নামকরণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত । গল্পের মধ্যে মানসিক সান্তনা , ভয় ও ভয় দেখানো , দাম্পত্য , কিশোরপ্রেম ইত্যাদিকে ঘটমান করে তোলে । পুরো গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে টিকটিকি । তার কক্ষপথ জুড়ে থাকে জ্যোতিষার্ণব , তার বিয়ে না করা স্ত্রী , দ্বিতীয় স্ত্রী রেবতী ও রেবতীর কিশোর প্রেমিক বা খেলার সাথী । নিজেদের জীবনকে যারা প্রতিতুলনা করে টিকটিকির সাথে ।
 টিকটিকি গল্পে একটা স্থির সত্য আছে । জ্যোতিষার্ণবের ভবিষ্যতবাণী ও টিকটিকির সমর্থনের ওপর যা দাঁড়িয়ে । তাই কিশোরের চশমা হওয়া , চশমার পাওয়ার বাড়া ইত্যাদিকে তার বন্ধুরা তাকে চারচোখো বলে তামাশা করে । এই ঘটনাকে আকস্মিক পতন বলা যায় না । কারণ লেখক এর আগে একই ভাবে জ্যোতিষার্ণবের প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুকে ঘটমান করে তুলেছেন । সেই সিরিসিরে ভয়ের অনুভূতি পাঠক ও গল্পের চরিত্রদের মনে সমান্তরাল ভাবে ক্রিয়াশীল । সমান্তরাল অনুভূতি বলে কিশোরের চারচোখ হওয়াটা গল্পের ভবিতব্য বা স্থির সত্য – যে সিদ্ধান্তের দিকে গল্প শেষে গিয়ে মিলেছে । গল্পের প্রথম লাইন থেকে ন্যারেটিভ এই স্থির সত্যে দিকে এগিয়েছে – যা নির্ণেয় ।
 সমীরের গল্প আবর্তিত হয় ভাষাবৃত্তকে ঘিরে , তা এভাবে স্থির সত্যের দিকে এগোয় না । তিনি যা বলতে বলতে এগিয়েছেন তাকেই আবার ভেঙ্গে ভিন্ন দিকে এগোতে চেষ্টা করেছেন । যেমন মানুষের রক্ত ছাড়া মশার বংশ বিস্তার সম্ভব না , আবার মশা প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ । মানুষের ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয়তার সাথে তার বিরোধ । ফলে গল্পের মধ্যে যে স্ববিরোধ আসে তাকে তিনি প্রশ্রয় দিয়ে যান । নির্মম তীব্র অনুভূতি তাঁর গল্পে গড়ে ওঠে না । অনুভূতির ভার্টিক্যালনেসের অভাব তাঁর প্রত্যেক গল্পে । সম্ভাবনার হরাইজন্টাল অনুভূতি সেখানে খেলা করে । গল্পে থাকে অনির্ণেয়তার দোলাচল । সমীরের গল্প ন্যারেটিভকেন্দ্রিক নয় । শুরুতে গল্পে দুটো কেন্দ্র দেখা যায় – নবনীতা ও এক স্ত্রী মশার মনস্তত্ব । গল্পের ক্রমশ ন্যারেটিভ থেকে সরে যায় - মানুষ ও এক প্রাকৃতিক জীবের মধ্যে সংগ্রামে । ফলে গল্পটা হয়ে ওঠে সমস্ত প্রকৃতির । যদিও সেই বিচলন এমন কৌশল ও গতিতে ঘটছে তা টের পেতে পেতে গল্প তার অবয়বের শেষের দিকে এগিয়ে যায় ।
 
 ফ্রয়েডিয় মনস্তত্ব ও গল্পের অবয়বের পুনরাবৃত্তি-
 মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই গল্পে পুনরাবৃত্তির বাধ্যবাধকতা আছে । গল্পের প্রথম পর্যায়ে জ্যোতিষার্ণবের স্ত্রীর যে ভূমিকা দ্বিতীয় পর্যায়ে তা কিশোরের । দুজনেই অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে । প্রথম পর্যায়ে জ্যোতিষার্ণব দ্বিতীয় পর্যায়ে রেবতী । তারা দুজনেই ভালবাসে , দুজনেই ভয় পায় টিকটিকির ডাক শুনে । প্রথম পর্যায়ে স্ত্রীর মৃত্যু , দ্বিতীয় পর্যায়ে কিশোরের চারচোখ হওয়া । গল্পে তিনি একটা নির্দিষ্ট স্ট্রাকচার বা অবয়ব ব্যবহার করেছেন । অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় একে অপরের প্রতিবিম্ব । প্রথম পর্যায়কে দ্বিতীয় পর্যায় প্রতিস্থাপিত করে । একই সন্দর্ভের পুনরাবৃত্তি অনুভূতির তীব্র উলম্বতা প্রকাশে সহায়ক হয়ে ওঠে ।
 এইভাবে মানিকের গল্পের প্লট ও ঘটনাক্রমের অনিশ্চিত সম্ভাবনা নির্ধারিত হয় পুনরাবৃত্তির মধ্যে দিয়ে । এই পুনরাবৃত্তির মধ্যে আছে নাটকীয়তা ও বিদ্রূপ । গল্পের প্রথম অবস্থার মধ্যে আছে মৌলিকত্ব । প্রথম অংশে জ্যোতিষার্ণবের স্ত্রী ও দ্বিতীয় অংশে জ্যোতিষার্ণব পরস্পরের পুনরাবৃত্তি , দুই জনেই চান সুখ ও শান্তি । প্রথম পর্বের জ্যোতিষার্ণব আর দ্বিতীয় অংশের রেবতী উভয়ক্ষেত্রেই এক অবৈধ সম্পর্কর ঈঙ্গিত পাওয়া যায় । প্রথম অংশের স্ত্রীর মৃত্যু দ্বিতীয় অংশের কিশোরের চারচোখ হওয়া , দুইই অবৈধ সম্পর্কের গন্ধমাখা এবং টিকটিকি অনুশাসিত । অর্থাৎ দ্বিতীয় অংশ প্রথম অংশের পুনরাবৃত্তি ।
 এই পুনরাবৃত্তি গল্পে বদ্ধমুখ নির্মাণ করে । যে বদ্ধমুখ ফ্রয়েডীয় ইগো (জ্যোতিষার্ণবের অচেতন ইচ্ছে এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ধারনা) , সুপার ইগো (টিকটিকির অমোঘতা) ও ইডকে (কিশোরের ক্ষতি চাওয়া ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছ থেকে সরিয়ে দেওয়া) কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় । জ্যোতিষার্ণবের অপসারিত ইচ্ছে সাঙ্কেতিকতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে তাঁর জীবন ও কর্মকাণ্ড। তিনি কিশোরকে প্ররোচিত করেন । তবে এই সাঙ্কতিকতার মানে বা পুনরাবৃত্তির অবয়ব সম্পর্কে তিনি কখনই সচেতন থাকেন না ।
 অধুনান্তিকতা ও কিছু স্বাধীনরাশি
 সমীরের গল্পের মধ্যে যে গল্প আসে সেখানে নির্দিষ্ট স্ট্রাকচার ব্যবহার হয় না । একটা পর্যায় আর একটাকে প্রতিস্থাপিত করে না । তা একটা পর্যায়কে প্রসারিত করে – প্রতিবিম্বিত করে না । মানিকের গল্পে যে সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান দেখা যায় তা সমীরের গল্পে থাকে না । সমীরের গল্প বাস্তবের সামাজিক বিনির্মাণ হয়ে ওঠে ।
 অর্থাৎ সমীরের গল্পে পুনরাবৃত্তি হয় সাদৃশ্যের , মানিকের গল্পে পার্থক্যের । সমীরের গল্পে যার পুনরাবৃত্তি হয় তাকে বলা যায় স্বাধীন রাশি বা সদৃশ বিষয়বস্তু । পক্ষান্তরে মানিকের গল্পে আসে বাধ্যতামূলক আন্তঃসম্পর্কের একটা অবয়ব যেখানে যে বিষয়ের পুনরাবৃত্তি হয় তা সবসময়ই অপর । সেখানে ‘ লেখকের ভাষাসত্ত্বা প্রথাগত পাঠরীতির ঐতিহ্যের সুযোগ নিয়ে কর্তৃত্ব বিস্তার করে পাঠকের ভাষাসত্ত্বার সাথে । ’
মানিকের গল্পের টেক্সটের একত্ব রক্ষার জন্য দুটো গল্পের মধ্যে যতই পরস্পর বিরোধী ভাব তৈরীর চেষ্টা করুন, তিনি আগাগোড়া গল্পের মধ্যে গোপনীয়তাকে সমর্থন করে গেছেন । প্রায় ইচ্ছেকৃত ভাবে গল্পের মধ্যে তিনি রহস্য তৈরী করেছেন । জ্যোতিষার্ণবের প্রথমা স্ত্রী তাঁর বিবাহিতা নয় অথচ সেই সম্পর্কের গোপনীয়তাকে তিনি রহস্যাবৃত রেখে বারবার ব্যবহার করে গেছেন । কিশোর ও রেবতীর সম্পর্ক কখনো জানা যায় না ।
 মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পকে সমালোচকরা দুটো পর্যায়ে ভাগ করেন – প্রথমদিকের ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ব ও যৌন চেতনা ভিত্তিক গল্প এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে মার্ক্সীয় বীক্ষায় লিখিত সমাজ চেতনার গল্প । দুই পর্যায়ের বিভাজন রেখা বরাবর থাকে কম্যুনিস্ট পার্টিতে তাঁর যোগদান । প্রথম পর্যায়ে তিনি চেয়েছেন মানুষের মনের গুঢ় ইচ্ছেগুলোকে চরিত্রের নিপুণ বয়ানে তুলে ধরতে । দ্বিতীয় পর্যায়ে সামাজিক অনাচার অবিচারকে তুলে ধরেছেন । প্রথমপর্যায়ে তিনি চেয়েছেন ব্যক্তি মানুষের উন্নতি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে সামাজিক মানুষের । সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে তিনি চেয়েছেন ব্যক্তি বা সমাজের রোগ নির্ণয় ও তার প্রতিকার । তাই এই দুই পর্যায়কে আলাদা করে চিহ্নিত না করে বলা যায় মানিক মানুষের মুক্তি এবং উন্নতির জন্য ‘ জীবন ও সাহিত্যকে নিষ্ঠার সঙ্গে ভালবেসে , জীবন ও সাহিত্যকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য ’ ( মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ) নিয়ে সাহিত্য চর্চা করেছেন । সেখানে টিকটিকির মত প্রাকৃতিক উপাদান গুলোকে তাদের নিজস্বতা নিয়ে গল্পের মধ্যে উপস্থিত হয় না । টিকটিকির উপস্থিতি শুধুমাত্র চরিত্রদের ব্যবহার ও চিন্তাভাবনা বোঝার জন্য নয় । গল্পে টিকটিকির অস্তিত্ব প্রতীকের মত, কিন্তু কামড় গল্পে মশার অস্তিত্ব কোনো প্রতীক রূপে নয় , লেখক সরাসরি মশা হিসেবে মশার অস্তিত্বর কথা বলেন । কামড় গল্পের মধ্যে প্রতীকের ব্যবহার সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে । সমীর রায়চৌধুরী মানুষ ও সমাজের মুক্তির উদ্দেশ্য নিয়ে গল্প লিখছেন না । তিনি লেখেন ‘ তোদের কে এক প্রেসিডেন্ট তো ভালই বলেছে , এ পৃথিবীর সমস্ত সম্পদে সকলের সমান অধিকার । যা আছে সবাই ভাগ করে ভোগ করবে । তবেই তো প্রকৃতির ভারসাম্য । ’ গল্পে মানুষ ও মশা দুজনেই নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে এক প্রাকৃতিক লড়াইতে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্ধী হয়ে ওঠে । প্রত্যেকের নিজস্ব ধরন।
 নিজস্ব বেঁচে থাকার এই ভিন্ন ধরনের পাঠ , একসাথে মহাজাগতিক অস্তিত্ব ও ক্ষুদ্রতর প্রজাতির বিশেষ অস্তিত্বর দ্বন্ধ প্রকাশ করে । সন্দর্ভ হয়ে ওঠে চাপা উত্তেজনার এক দ্বন্দ্ব, যেখানে থাকে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ । সন্দর্ভে থাকে আধিপত্য বিস্তার ও পরাভবের পুনরাবৃত্তি – কখনো মশার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আবার কখনো মানুষ নামক প্রজাতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে । এভাবে সন্দর্ভ হয়ে ওঠে মিশ্র শুরু ও অসংখ্য সম্ভাবনার সঙ্করায়নের এক জটিল বর্ণনা ।
 
 মাতৃত্ব ও দুধভান্ডার-
 মানুষ ও মশার সাথে এক নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকাও গল্পের ন্যারেটিভের মধ্যে উঠে আসে । গল্পটাকে পাঠক সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন । দুটো ঘটনা পাশাপাশি পাঠকের চোখের সামনে ঘটে যেতে থাকে । একটা ন্যারেটিভে মানুষ মা বাবা সন্তানের কথা , অন্য ন্যারেটিভে মশা মা বাবা সন্তানের কথা । গল্পের মধ্যে সমীর পরিবার , মাতৃত্ব ইত্যাদি শব্দার্থের ব্যকরণগত অর্থ থেকে নতুনতর মানে প্রকাশের ঝুঁকি নেন । স্তন্যপায়ীর সাথে জড়িত যে পরিবার ও মাতৃত্বর চেতনা , তাকে মশার মত কীটদের সাথে এক করে তিনি ‘ গল্প জীবন থেকে উঠে আসে ’ এই ধারনার অবলুপ্তি ঘটান । পাঠক মাতৃত্বের এক প্রাকৃতিক ধারনা গড়ে নিতে পারেন , যা মশা ও মানুষের ক্ষেত্রে একই রকম । প্রকৃতির মহাসন্দর্ভে মশা–মা আর নিবেদিতার ভূমিকা সমমর্যদার । দুজনেই মা । ভারত প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বাস করে বিশ্বমাতৃত্বে । ভারতীয় হিন্দুদের কাছে গরু হল গো মাতা । নদী গঙ্গা মা । মরুভূমিতে উটমাতা । দেশও মা । দেশমাতৃকা । বন্দেমাতরম্ । সমস্ত প্রকৃতির এই বিশ্বমাতৃত্ব ভারত আত্মস্থ করেছে বহু প্রাচীনকালে । তার মধ্যে সংকীর্ণ রাজনৈতিক বোধ ছিল না। সমীর ‘ স্তন্যপায়ী ’ গল্পে এই মাতৃত্বর কথা , প্রকৃতির দুধভান্ডারের কথা তুলে ধরেছেন । বর্তমান পাশ্চাত্য নারীবাদ – ইকোফেনিনিজম্ – প্রকৃতির এই সার্বিক প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে । ‘আধুনিকতা’ এই দুধভান্ডরকে প্যাকেটজাত করেছে । ‘আধুনিক’ চরম ভোগবাদ প্রকৃতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে । আবহাওয়ার চরম প্রকাশ সম্ভব করে তুলেছে আধুনিকতা । নিজস্ব প্রয়োজনে মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুরের প্রাকৃতিক পর্যায়গুলোকে ধ্বংস করে ফেলছে । এই আধুনিকতাতে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কবি বলেন ‘সবার ওপর মানব সত্য’ । প্রাচীন ভারত মানুষ নামক এক প্রজাতির কথা বলে না । গীতার দশম অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখান । যা শুধুমাত্র মানুষ নামক প্রজাতির সংগ্রামের কথা বলে না । তা সমগ্র পৃথিবী জৈব ও অজৈব পরিমণ্ডলের ‘বিশ্বরূপ’ । প্রকৃতির অজৈব সত্ত্বার আছে জীবন সংগ্রাম ও মৃত্যু । যেমন আছে নদী পাহাড় ও মাটীর । ভারতীয় লোকায়ত দর্শন সেই বিশ্বরূপকে আত্মস্থ করেছে ।
 প্রকৃতির দুধভান্ডার ব্যবহারের উদ্দেশ্যে মানুষ তার পোষ্যে পরিণত করেছে নানান স্তন্যপায়ী প্রাণীকে । মশা স্তন্যপায়ী নয় । পতঙ্গ । ফলে তার কাছে মশার প্রয়োজনীয়তা প্রায় নেই । বরং ম্যালেরিয়া , কালাজ্বরের কারণ আবিষ্কার মশাকে মানুষের কাছে অনেক আগেই ব্রাত্যে পরিণত করেছে । অথচ টিকটিকি স্তন্যপায়ী না হলেও মানুষ মনে করছে টিকটিকি ভবিষ্যৎবক্তা । একটা অদৃষ্টকে সে জানে । তাই টিকটিকির প্রয়োজনীয়তা মানুষের কাছে আছে । মশা অদৃষ্ট নয় । তাই আধুনিকতার কাছে মশার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই । উত্তর–আধুনিক খোঁজ পায় তার প্রয়োজনীয়তার জায়গাটা । সেখানে গল্প যাত্রা করে অভেদের দিকে । যা কোনো পূর্ব নির্ধারিত তত্ত্বকথা, দর্শন বা মতামত দিয়ে বোঝা অসম্ভব ।
 
 প্রজাতি ও Politics
মানিক গল্প লিখছেন একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ, সেখানে দাঁড়িয়ে । যা খুব বেশী হলে একটা প্রজাতির উন্নতির কথা বলে । সেখানে অন্যদের প্রতি জ্যোতিষার্ণবের থাকে অশ্রদ্ধা । যে অশ্রদ্ধা শিক্ষা , বয়স ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার সীমা বরাবর দাঁড়িয়ে থাকে । সমীর কোন মতাদর্শ নিয়ে কথা বলছেন না । এখানে Politic এর পার্থক্য আছে । প্রকৃতির অস্তিত্ব , বিকাশ ও পরিবর্তনের একটা নির্দিষ্ট বৃহত্তর Politic আছে , যা দলীয় বা কোনো নির্দিষ্ট প্রজাতিকে ঘিরে হয় না । সমীর গল্পের মধ্যে সেই বৃহত্তর মানব সমাজের মঙ্গলের কথা বলেন । যা মানুষকে সর্বশক্তিমান প্রকৃতির বাইরের এক জীব মনে করে । প্রকৃতিকে জয় করাই যার উদ্দেশ্য । মানিকের গল্পের এক আধুনিক উদ্দশ্যময়তা থাকে । যে জন্য তাঁর গল্পর আঙ্গিক খোলামেলা নয় । তা বদ্ধ । উত্তর আধুনিক যে জায়গাতে আসে তা বৃহত্তর জৈব সম্ভাবনার কথা বলে । যাকে আমরা মানুষের শত্রু মনে করছি সেই সব গাছ এবং প্রাণীও জৈব সমাজে একটা ভূমিকা নেয় । প্রকৃতির পুরো আয়োজনের মধ্যে যে একটা রাজনীতি ঘটে চলেছে সেটা নানান ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এবং সেই ডিসকোর্সটা সামনে রেখে লেখা হয়েছে সমীরের ‘ কামড় ’ গল্পে । পুরো গল্পটা তিনি খেলাচ্ছলে বর্ণনা করে যান । সেখানে অনেক সম্ভাবনার প্রকাশ দেখা যায় ।

 দেরিদা যাকে প্রত্নলেখা ( Arche – Writing ) বা ছাপ ( Trace ) বলেন, দেরিদার মতে যাবতীয় জীব ও জড় অস্তিত্বর মূলে । সেই ছাপ বা অতিচেতনার জন্য প্রাকৃতিক জীবন ও মানবিক জীবন হয়ে ওঠে একে অপরের পরিপূরক । প্রকৃতির ভেতর থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভবের জন্য যে ছাপ থাকে মানুষের চেতনার মধ্যে । লেখার মাধ্যমে উঠে আসে অতীত – শব্দের মানে আর আগের বর্ণনা প্রসঙ্গকে সম্পূর্ণ মুছে যায় না । তা ভবিষ্যতের অসংখ্য প্রসঙ্গকে অর্থপূর্ণভাবে প্রসারিত করে । সন্তান ধারণের সেই প্রসঙ্গ মশা থেকে প্রসারিত হয় মানুষের মধ্যেও । এই পরিপূরকতার জন্য সমভাবে আসে মশা মা ও মানুষ মায়ের সন্তান ধারণের অভিযান । টিকটিকি ও জ্যোতিষার্ণবের মধ্যে যে চেতনা থাকে না । 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন