দলিত নারী শরীর



 দিব্যা কার্তিকেয়ান: আপনার মেয়েবেলা এবং একটি দলিত পরিবারে কন্যাসন্তান হিসেবে আপনার বড়ো হওয়ার কথা জানতে চাই?

সুকীর্তরানী: আমি ভেলোর জেলার লালাপেট গ্রামের মেয়ে। সেখানকার দশ ঘরের এক ঘরে আমি বড়ো হয়েছি। আমার বাবা মা দু-জনের কেউই প্রাথমিক শিক্ষা পায়নি। আমরাই প্রথম প্রজন্ম যারা শিক্ষা পেয়েছি। আমরা চার বোন আর দুই ভাই। গ্রামের অনুষ্ঠানে আমার ঠাকুরদা পরই (তামিলনাডুর দলিতদের এই বাজনার নামেই পরইয়া বলা হয়) বাজাত। আমার বাবা ইআইডি পার্টিতে কাজ করত। উৎসব আর শবযাত্রার অনুষ্ঠানাদিতে পরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রতি বছর একজনকে বেছে নেওয়া হয় পরই বাজানোর জন্য, সেটায় তাকে বাধ্য থাকতে হয়। আমার বাবা এর বিরোধিতা করেছিল আর সেই জন্য পঞ্চায়েত তাকে ডেকে পাঠিয়ে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করেছিল। যেহেতু বাবা পারির কাছে কর্মরত ছিল, তাকে এটা কোনোভাবে টলাতে পারেনি।

দিব্যা: আপনি যখন প্রথম বর্ণবৈষম্যের সম্মুখীন হন আপনার বয়স কত ছিল তখন? 

সুকীর্তরানী: আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তাম, এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। আমার ক্লাসের একটি মেয়ে আমাকে একটি ক্যান্ডি দিয়েছিল, আমি তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে তার জন্য মিষ্টি এনেছিলাম। তাকে সেটা দিতেই, সে আমার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি একইসঙ্গে বিভ্রান্ত আর আহত হ্যেছিলাম, পরে অবশ্য আমি জেনেছিলাম সে কেন ওরকম করেছিল। মেয়েটি উঁচু জাতের। তাদের মধ্যে তখনকার দিনে ছেলেমেয়েদের শেখানো হত দলিত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে না মেলামেশা করতে। তাদের বলা হত, “তাদের সঙ্গে কথা বলবে না, তাদের আশকারা দেবে না আর তাদের সঙ্গে কিছু দেওয়া নেওয়াও করবে না।”

দিব্যা: তাহলে বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারটা অত ছোটো বয়সে আপনাকে পাথরাঘাতের মতো আঘাত করে থাকতে পারে।

সুকীর্তরানী: সেটা আমাকে এখনও যন্ত্রণা দেয়। সেটা কুসংস্কারের সঙ্গে আমার জীবনের প্রথম সাক্ষাৎ। তবে ছোটোবেলাকার মতো সময় এখন অতটাও নৃশংস না। পনেরো বছর পর, আমি রানিপেটের কাছে একটি ইশকুলে শিক্ষক হিসেবে কাজে ঢোকার পর একদিন আমি আমার ইশকুল দেখতে যাই। আমার ক্লাসঘরেও যাই যেখানে আমি পড়াশোনা করতাম। এইসব জিজ্ঞাসা পরে আমার কবিতা হয়ে রূপান্তরিত হয়েছে।

দিব্যা: সময়বিশেষে আপনার কবিতা কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে? আপনার প্রথম দিকের কবিতায় জোরালোভাবে অনুপ্রাস ও ধ্বনিসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। আর সেখান থেকে আপনার লেখার বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়। আপনার কবিতার অনুপ্রেরণা কী ছিল আর কীভাবে সেসব কবিতায় বাস্তবায়িত হত?

সুকীর্তরানী: অনেকানেক ভাবনাচিন্তা আর প্রশ্ন যেসব মনের মধ্যে চলত যা কবিতায় বাস্তবায়িত হয়েছে। এভাবে সেসব আকার পেয়েছিল নিজের আত্মপ্রকাশের পথ করে নিয়েছিল। দিস্তা দিস্তা বাস্তবোচিত গল্প না লিখে আমি ছোটো ছোটো কবিতা লিখেছি যার মধ্যে দিয়ে আমি নিজের ভাবনাচিন্তা প্রকাশ করতে পেরেছি। এই সাহিত্যের সঙ্গেই আমার ভালোবাসা জন্মায়।

দিব্যা: কোন বিষয়ে আপনি আগ্রহী ছিলেন?

সুকীর্তরানী: শুরু থেকেই আমার প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে লিখতে ভালো লাগত না; শুধুমাত্র সামাজিক পরিসরই আমার কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে। আমার প্রথম কবিতা ছিল কীভাবে পৃথিবীটা গোল, তবে জানলার বাইরে তাকিয়ে বুঝেছিলাম, পৃথিবী কীভাবে ওলটপালট হচ্ছে, ভাঙছে আর গড়ে উঠছে নতুন নতুন আকৃতিতে, কোনোভাবেই গোল না। তখন বুঝেছিলাম যে আমার স্বতন্ত্র স্বর তৈরি হতে সময় লাগবে। 

দিব্যা: ‘இரவு மிருகம்’ (‘রাতের পশু’) বইতে আপনি জাত এবং দলিত পরিচিতির কথা বলেছেন শরীরের মধ্যে দিয়ে। হস্তমৈথুন একটি নির্গতকরণ প্রক্রিয়া আর ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা যেখানে সবসময়ই বলা হয় যে মেয়েদের জন্য তা নিষিদ্ধ। আপনি দলিত ইতিহাসকে শরীরের মাধ্যমে চিহ্নিত করেছেন। দমনের প্রতিটা ক্ষেত্রই শারীরিক ছিল আর সেটা বহন করেছে শরীর। আপনি এটা করতে পেরেছেন? 

সুকীর্তরানী: তখন এই ধরনের কবিতা বিশেষ একটা ছিল না, আর পাঠকেরাও এমন কবিতা ’৯০-এর দশকে কেউ বিশেষ পড়েনি। আমি কমলা দাস, তসলিমা নাসরীন আর আফ্রিকার কবিদের কবিতা অনুবাদে পড়া শুরু করি। সেসব আমাকে বুঝতে সাহায্য করে নিজের অধিকার থেকে বঞ্চিত নারীর কেমন মনে হয়। কুট্টি রেবতি (একজন তামিল নারীবাদী কবি)-র কবিতা আমাকে প্রাণিত করে। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষেরাই নারীবাদকে লঘু করে দ্যাখে। তা সত্ত্বেও, আমি এ নিয়ে আরও লেখার কথা ভেবেছি।

দিব্যা: দলিত নারীরা কি নারীবাদের সঙ্গে টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যায়? 

সুকীর্তরানী: আমার ক্ষেত্রে, জাত পরিচিতি আর নারী শরীর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে। আমার মনে হয় যে একজন দলিত নারীর সমস্যা অন্য জাতের নারীর থেকে ভিন্ন। আমার সব লেখা আমার অভিজ্ঞতাপ্রসূত নয়; সেসব অন্য যেকোনো নারী বা দলিত নারীর অভিজ্ঞতাপ্রসূত। আমরা জাতের শেকলে বদ্ধ। দলিত নারী শরীর বিশেষত নিত্য হিংস্রতার সম্মুখীন হয়। তথাকথিত উঁচু জাতের নারীরা যে-ব্যথার মুখোমুখি হয়, আমার মতে তুলনামূলকভাবে দলিত নারীদের ক্ষেত্রে আরও গুরুতর। আমাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে হয় আমাদের স্বজাতের পুরুষদের সঙ্গে, যারা নারীদের ওপর ক্ষমতা আরোপ করতে চায়।
উঁচু জাতের পুরুষরা তো তারপরের প্রতিস্পর্ধা, কারণ তাদের মনে হয় তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের অধিকার আরও বেশি আছে। নারীদের অবস্থা যেকোনো বাড়িতে কোনোরকমভাবে সমাজের থেকে ভিন্ন কিছু না, সবখানেই এক। 

দিব্যা: উদাহরণ? 

সুকীর্তরানী: যদি কখনো উঁচু জাতের পুরুষদের মধ্যে রাস্তা নিয়ে ঝামেলা বাঁধে, তারা সেটা নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নেবে। তবে সেটা যদি কোনো দলিত পরিবারের সঙ্গে ঘটে, সেখানে মেয়েদের শরীরকে টেনে আনা হবে হিংস্রভাবে, এটাই এখনও পন্থা হিসেবে চলে আসছে। সচরাচর, একটি নারী শরীরকে অসম্মান করা হয়, কিন্তু একটি দলিত নারী শরীরকে প্রায় ঘৃণার চোখে দ্যাখা হয়। যখন প্রিয়াঙ্কাকে, একজন দলিত নারীকে নগ্ন করে হাঁটানো হয় আর হত্যা করা হয় ২০০৬ সালের খাইরলাঞ্জির হত্যাকাণ্ডে, তার ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়েছিল। সেটা দেখে এক সপ্তাহ ঘুমোতে পারিনি। আমি ভীতসন্ত্রস্ত ছিলাম। আমার সঙ্গেও সেরকম হতে পারত।
সেই ভয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য লিখতে শুরু করি। আমার কবিতা কখনোই কারও কাছে কিছু করা বা না-করার মিনতি না। আমি লিখি যা ঘটে গেছে সেটা। ‘স্বাধীনতার পতাকা’ কবিতায় কয়েকটি পঙ্‌ক্তি আছে এমন—

আমার যোনিতে পোঁতা
আঁকশির একেবারে ওপরে 
আমাদের স্বাধীনতার পতাকা উড়বে
আমাদের রক্তে রাঙা হয়ে। 

রোহিত ভেমুলা একজন তারকা। যখন একজন রোহিত ভেমুলা মরে, সেখানে আরও একজন রোহিত উঠে আসে কানহাইয়া কুমার বা জিগনেশ মেভানির রূপে। পতাকা উড়তেই থাকবে। আমাকে ভূমিপতিত করা যাবে না, আমি তারপরও উঠে দাঁড়াব। 
আমার কবিতায় সেই আশা আমি দেখতে চাই।

দিব্যা: তবে সেই আশা কি একজন দলিত নারীর ক্ষেত্রেও এক?

সুকীর্তরানী: সত্যিই না। উদাহরণে বলা যায়, জাত এবং নারীর সতীত্ব অনেকটা কাছাকাছি। নারীর শরীরকে পবিত্র মন্দির হিসেবে দ্যাখা হয়, পবিত্রতার অপর নাম হিসেবে। আমি একে দেহ-রাজনীতি বলে থাকি। আমার মতে, পবিত্র বলে কিছু হয় না; কোনো কিছুই পবিত্র বা শুদ্ধ না। যখন একজন নারী ধর্ষিত হয় বা যখন এক দলিত ছেলে পালিয়ে বিয়ে করে ভিন্ন জাতের এক মেয়েকে, মেয়েটাকেই কিন্তু অশুদ্ধ বলা হয়, ছেলেটাকে না। যেহেতু তার শরীর আর শুদ্ধ নেই, উঁচু জাতের পুরুষরা ঠিক করে যে মেয়েটার আর বাঁচার অধিকার নেই। সেই কারণেই আমি জাত আর শরীরী আখ্যানকে একসাথে জুড়ে দিই।
দলিত হিসেবে এটা আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আর এটা আমাদের কাছে নারী হিসেবেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সাহিত্যে একটু বেশি দলিত পুরুষ কণ্ঠস্বরের অবস্থান।

দিব্যা: আমাদের শরীরকেই ব্যবহার করা হয় আমাদের জাতের বিরুদ্ধে হিংস্রতা প্রকাশ করার জন্য— প্রতিটা জাতবিদ্বেশ ছড়ানোর পিছনে; দলিত ব্যথার শরীরে এও এক শারীরিক আঘাতচিহ্ন। আপনার শারীর আর যৌন জাগরণ মিশে যায় আপনার জাত পরিচয় আর ইতিহাসের পুনর্সন্ধানের সঙ্গে। আপনার শরীরকে কীভাবে দেখেন যখন এসবের সঙ্গে জুড়ে দেন নিজের শরীরকে? 

সুকীর্তরানী: ‘আমার শরীর’ কবিতায়, এটি একটি আবিষ্কারের মতো যে হিংসা আর ঝুঁকির পর, শেষে শান্তি থাকে, ঠিক ঝড়ের পরের স্তব্ধতার মতো। 

তুমি আমাকে বাঁধাতে পারো,
ছবির মতো
আর ঝুলিয়ে দিতে পারো দেয়ালে
আমি পড়ে যাব নীচে

তোমাকে ছাড়িয়ে যাব
নদীর মতো হঠাৎ বানে।

আমি নিজে হয়ে উঠব
পৃথিবী
আগুন
আকাশ
জল
আমাকে জত ধরে রাখো তুমি, 
তত আমি ছড়িয়ে পড়ি
প্রকৃতির ঝরনাধারায়। 

এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিতার একটি। আসলে নারীর শরীর এই পৃথিবীর মতো কারণ উভয়ই সৃজনকর্তা। তবে একজন নারীর কোনো গৃহ থাকে না— তার নিজের ঠিকানা এই পৃথিবীতে। যে-গ্রামে আমি থাকি সেটা আমার না; সেই গৃহ আমার বাবার গৃহ। কোথায় আমার মায়ের গৃহ? আমার মায়ের গ্রাম হল তার বাবার গ্রামে। একজন নারীর ঠিকানা একজন পুরুষের ঠিকানায়। সমাজে আমরা সবসময়ই চিহ্নিত হয়ে এসছি আমাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের দ্বারা।
নারীর ঠিকানা তখনই চিহ্নিত হয় যখনই সেটা পুরুষের ঠিকানা ঠিকানার সঙ্গে যুক্ত হয়। যদি আমি সন্তান ধারণ করি, আমরা বলতে পারি না সে আমার, এ আমার স্বামীর সম্পত্তি। এভাবে ভাবতে আমাদের শেখানো হয়েছে। আমাদেরকে এরকম ভাবনাচিন্তায় ভরিয়ে তোলা হয়।

দিব্যা: আপনার কি মনে হয় একটি নারী শরীর, যা আগে এবং এখনও এরকমভাবে শ্রমের শরীর হিসেবে দ্যাখা হয়, যা আপনার কৌমার্যে ভরা কবিতার মধ্যে দিয়ে মুক্ত হয়?

সুকীর্তরানী: একটি নারী শরীরকে কখনোই নিঃসঙ্গ ছাড়া হয় না, তাকে সবসময়ই দখলে রাখা পুরুষ কুক্ষিগত করে রাখে, ভালোবাসে তাকে, বা যার মাধ্যমে সে জন্মেছে। ভালোবাসা আর কাম এক আর যদিও এক নাও হয়, উভয় কামনাই এক শরীর থেকে উদ্গত। একটি পুরুষের ক্ষেত্রে নিজের যৌনতাকে প্রকাশ করা সহজাত, তবে একটি নারী কখনোই তা পারে না: যদি সে করে, সেটা পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। নারীর যৌনতাকে আমাদের সমাজ নিষিদ্ধ করে। 
বিষয়টা বিগত ২০০০ বছর সময়কালের যে শুদ্ধতা আর যৌনতার এই অঙ্গাঙ্গীভানে জড়িয়ে যাওয়া, যেখানে শুদ্ধতা শুধুমাত্র নারীর ব্যাপার আর যৌনতা পুরুষের। এই ভাবনাচিন্তাই জঘন্য। এ কেবলই জৈবিক অনুভূতি। তবে যখনই নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ওঠে, ওদের সঙ্গে সঙ্গে বিতাড়িত করা হয়।  

দিব্যা: আপনি যদি নারীবাদী হন, সেক্ষেত্রে আপনি কোণঠাসা। যদি আপনি দলিত নারীবাদী হন সেক্ষেত্রে আপনি আরও বেশি কোণঠাসা। অতীতেও, গীতিকারদের মধ্যে পালানি বারাথি আর স্নেহান নারীবাদী কবিদের আক্রমণ করেছিলেন। তখন আপনার কী মনে হয়েছিল?

সুকীর্তরানী: আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম যেখানে আমি নারী শরীরকে একটি গানের সঙ্গে সংযুক্ত দেখিয়েছিলাম। একদিন রাতে আমার কাছে এক অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে। সেই ফোনে ভেসে এসেছিল একটি পুরুষের কণ্ঠস্বর। সে বলেছিল, “আমিও আপনার শরীরকে আমার শরীরের কাছাকাছি অনুভব করতে চাই।”
এরকম ঘটনা কয়েকজন নারী কবিদের সঙ্গেও ঘটেছে। যখন দু-জন গীতিকার নারীবাদী কবিদের অকথ্য আক্রমণ করেছিল, আমার পরিবার আমার পক্ষে ছিল না। যদি এতে একা যুদ্ধ করি, আমি আশা করতে পারি না আমার পরিবারও তাই করবে।

দিব্যা: এটা ধরে নেওয়া যায় যে আপনার পরিবার আপনার লেখা বুঝতে পারবে না?

সুকীর্তরানী: আমরা সেই সমাজে থাকি যেখানে নির্ভয়ার মতো নারীরা যদি বাইরে বেরোয়, আমরা বলি, “সে কেন বাইরে বেরিয়েছে?” তবে কেউ কোনো পুরুষকে এসব জিজ্ঞেস করে না। যদি আমার পরিবারকে বলি এই আক্রমণের কথা, তারা আমাকে বলবে লেখা ছেড়ে দিতে। এটা জলবৎ তরলং। আমি নির্ভর করি আমার বন্ধু এবং সহলেখকদের ওপর। তারা এগিয়ে এসছে এসব ক্ষেত্রে। আমরা যখন কিছু নারী লেখকদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান করেছিলাম, তখন তারা অনেকেই ভয়ে এগোতে চায়নি। তারা আমাদের আমাদের প্রতিবাদকে শ্লথ করার উপদেশ দিয়েছিল। আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রদর্শনও হয়েছিল। আমি সবাইকে দোষারোপ করছি না, তবে অনেকেই আমাদের মেনে নিতে পারেনি। 
আপনার পরিবার আপনাকে আগলে রাখবে সমাজের নানা রকম আক্রমণ থেকে, বিষয়টা কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আপনি একই আচরণ নারীদের ক্ষেত্রে আশাই করতে পারবেন না। যারা দেহ-রাজনীতি, নারীবাদ আর দলিত পরিচয় নিয়ে যারা কথা বলে তাদের জন্য বিষয়টা একেবারেই অসামর্থ্যের বিষয়। 

দিব্যা: পুরুষ কণ্ঠগুলো কী বলেছিল? 

সুকীর্তরানী: “সে শুধু যোনি নিয়ে লেখে, সে শুধু অশ্লীল কবিতা লেখে।” আমরা অনেক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছি। যারা নারীবাদ নিয়ে কথা বলত তারা তাদের সম্পর্কে শ্লেষাত্মক কথা বলত বহিষ্কারের কথা বলত। “আমরা ভাবতাম তাদের স্তন বড়ো কিন্তু দেখা গেল আসলে ছোটো”— বক্তব্যটি একজন প্রধান তামিল কবি সম্পর্কে বলা হয়েছিল। 
অধিকাংশ মানুষেরই স্তন ও যোনি শব্দের ব্যবহারে কুণ্ঠা আছে। ভারথী একটি শিশুকে নিয়ে লিখেছিলেন যে মায়ের স্তন থেকে দুধ পান করছিল। এই শব্দগুলো গত শতাব্দীর তামিল সাহিত্যে অহরহ দেখা যেত, যেমন অন্ডাল, অরুণাগিরিনাথার আর পট্টিনাথারের কবিতায় এমনকী ‘কাম্বা রামায়ণ’-এও দেখা যেত, সেসবকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়নি। 

দিব্যা: নারীবাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীভাবে সময়ের সঙ্গে বদলেছে?

সুকীর্তরানী: নারীবাদকে হতে হবে ব্যাপ্ত। যদি দলিত সাহিত্যের কোনো পরিসর থেকে থাকে, তাহলে সেটা দলিত সাহিত্যের কোনো পরিসর থেকে থাকে, তাহলে সেটা দলিত নারীদের পক্ষেও থাকা দরকার, আমি মনে করি। আমরা যেকোনো একটা সীমার মধ্যে নারীবাদকে বাঁধতে পারি না। আমার নারীবাদের ভাষা আপনার থেকে ভিন্ন। কারও জন্য, পাবে যাওয়া আর বাইরে রাত কাটানোই নারীবাদ। আমার জন্য, বাড়ির বাইরে পা রাখতে পারাটাও নারীবাদ, দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। 
আমাদের এটা বুঝতে হবে যে দিল্লির নারীবাদ আর কন্যাকুমারীর নারীবাদ এক না। লালাপেটের নারীবাদ কন্যাকুমারীর থেকে আলাদা। গুরুত্বপূর্ণ হল তার মধ্যেকার প্রবাহিত নারী-স্বাধীনতা। সেটা জুড়ে থাকে ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার সঙ্গে। এই প্রসঙ্গে, দলিত নারীবাদও গুরুত্বপূর্ণ এবং ভিন্ন। 

দিব্যা: হ্যাঁ, এটাই প্রতিচ্ছেদের জরুরি বিষয়। দলিত নারীবাদী হিসেবে আপনার কি মনে হয় যে আপনার কথা বলা দরকার, কারণ আমাদের কোনো স্বর নেই?

সুকীর্তরানী: নির্ভয়া বা প্রিয়াঙ্কা উভয়কেই নারী শরীর হিসেবেই অধিকাংশত দেখা হয়, মানুষ হিসেবে না-দেখে। তারা উভয়ই বর্বরতার সম্মুখীন হয়েছিল। তবে যখন এসব নীচু জাতের নারীদের সঙ্গে ঘটে, তার ফলাফল কিছুটা ভিন্নই হয়। 
যদি সব অবদমিত নারীদের একইরকম অবদমন সহ্য করতে হত, সেই আমার নারীবাদী সাহিত্যে দলিত বিষয়টা আর থাকবে না। আমি এটা নিজে বেছে নিইনি; সমাজের পরিস্থিতি আমাকে ঠেলে দিয়েছে। আমার কাজ নারীমুক্তি নিয়ে আর আমি গুরুত্ব দিয়ে থাকি দলিত নারীদের। 

দিব্যা: আপনার একটি বিখ্যাত কবিতায়, আপনি লিখেছিলেন যে কীভাবে মেয়েবেলায় আপনি আপনার বাবাকে একজন পারিয়া শ্রমিক হিসেবে পরিচিত করাতে দ্বিধা বোধ করতেন, আপনার বন্ধুদের সামনে। আপনার ওই বাসি ভাত লুকোনোর ব্যাপারটা ছিল নিজের জাত লুকোনোর প্রচেষ্টা। আপনি কি এই লজ্জার চামড়াকে ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছেন কবিতাটার মধ্যে দিয়ে? এটাই কি শুরু ছিল?

সুকীর্তরানী: প্রথমে আমি একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিতে চাই যে আমরা লিখি আমাদের অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে। সেসব অন্য জায়গা আর মানুষেরও প্রতিভূ। কোনো ধারণায় পৌঁছে যাবেন না। আমি ২৫ বছর বয়সে কবিতাটি লিখেছিলাম। লেখাটা ছিল অনেক দলিতের সম্মিলিত স্বর। আমার ইশকুলে শিক্ষকেরা জিজ্ঞেস করত, কে সাবর্ণ আর কে ‘হরিজন’? আমি নিজেকে কখনো শব্দটার সঙ্গে মানাতে পারি না। যদি আমরা ঈশ্বরের সন্তান হয়ে থাকি, তবে অন্যরা কার সন্তান? 

দিব্যা: আপনাকে কি সেই লজ্জাকে নির্ভর করে থাকতে হয় না কি সেটাকে ভয় পেতে হয়?

সুকীর্তরানী: শিশু হিসেবে আমার কোনো খেলার সঙ্গী ছিল না। আমার পনেরো বছরের ইশকুলজীবন ছিল একটা অন্ধকার যুগ। কেউ কি আমাকে আমার হারানো পনেরো বছর ফিরিয়ে দিতে পারবে? সেটা এখন অতীত: আমি আমার জাত পরিচিতি নিয়ে অনেকটা অগ্রসর হয়েছি। একজন দলিত হিসেবে আমি গর্বিত আর সেটা ঘটেছে আমার কলেজজীবনে। শিশু হিসেবে আমি জাতপাত বুঝতাম না আর সেসব বোঝার মতো পরিণতও ছিলাম না, তখন বিভ্রান্ত ছিলাম। এখন আমি মুক্ত। আমি পরিচিতির বাধাকে অতিক্রম করে এসছি সবক্ষেত্রেই, যেমনটা আমি আমার কবিতায় বলেছি।

সুকীর্তরানী কবিতা পড়া শুরু করলেন

মনের মধ্যে 
আমি, যার মৃদু মাংসের গন্ধ 
আমার বাড়ি যেখানে হাড় ঝোলানো 
আর আমার রাস্তায় যুবকেরা
অবাধ ঘুরেফিরে বেড়ায়
নারকেলের খোলের বাজনা বাজায় জোরে
চামড়ার সঙ্গে আটকানো 
আমার মফস্‌সলের শেষ সীমানা 
আমি তবুও তাদের সান্ত্বনা দিয়ে চলি
আমরা সবার থেকে এগিয়ে আছি।




সুকীর্তরানী

তামিল দলিত কবি সুকীর্তরানী-র সাক্ষাৎকার
আলাপচারিতায় দিব্যা কার্তিকেয়ান
ভাষান্তর: শতানীক রায়

এই সাক্ষাৎকার ‘The Wire’-এ ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল ১৬ জুলাই ২০১৭ সালে। সাক্ষাৎকার শুরুর আগে সুকীর্তরানী সাক্ষাৎকারটি তামিলে নেওয়া যায় কি না, তিনি বলেছিলেন সেই ভাষা তাঁর রক্তে বয়। শুরুতেই তিনি নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। যদিও সাক্ষাৎকার ইংরেজিতেই হয়েছিল। অধিকাংশ সাক্ষাৎকারজুড়েই দলিত নারী শরীরের বিষয়টা ঘুরেফিরে এসেছে। আমি এর ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না কারণ এর বেশিরভাগই কবি বলেছেন। আমি সাক্ষাৎকারের নামকরণ করেছি ‘দলিত নারী শরীর’। তামিল দলিত কবি সুকীর্তরানীর একটি উল্লেখযোগ্য কবিতার বই হল ‘রাতের পশু’ যার কথা এই সাক্ষাৎকারেও উঠে এসেছে। তাঁর নির্বাচিত কবিতার সংকলন তামিল থেকে অনুবাদ করেছেন শীর্ষা মণ্ডল ও শত্তীশ্বরন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন