ধীবর
নদীর তীরে
পীত জালকাঠিগুলি
মৃত্যুগ্রন্থিপ্রবণ
ক্রোধহীন সূর্য
ধীর অপেক্ষায় থাকা
করতলে ঘুমন্ত
শেষমেষ
একটা নীল ছোপওয়ালা
পুঁচকে মাছ
আঁকশির ডগায়
আর গোলাপের পাপড়ির থেকেও ক্ষুদ্র
একখণ্ড আকাশ
মৃত্যুবৎ আঘাতে
জমিনে পতিত
অর্থহীন নাটক যত
জেলে আরেকবার তার দণ্ডকে চুবোলেই
সেই সূর্যটা, বিন্দুমাত্র বিরক্তি না রেখে
আবার, আবারও সেই হাতেই ঘুমিয়ে যায়।
নদীর বেগুনীরঙা সমতলের উপর দিয়ে
তিনটে কালো নৌকা দিগন্তের দিকে রওনা দিয়েছে
তাদের ভেসে যাওয়া আমার নজরে আসছে না
কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তারা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে চলেছে।
তাহলে কি নদীটা মলিন ফুলবৎ কোনো স্বপ্নমাত্র?
আর আকাশ তবে কী?
ফ্যাকাশে নীল স্বপ্নই?
এই ঘরবাড়ির নাগরিক জঙ্গল,
সেও এক সোনালি স্বপ্ন?
অদৃশ্য এক হাত
নৌকাগুলোকে ঠেলে দিচ্ছে
অজানা ফেরিঘাটগুলোর দিকে
তারা কি নি:শব্দে পৃথিবীর বুক থেকে দেশান্তরী হতে চলেছে?
তাদের ধোঁয়ার ঝুঁটিগুলো
অতীতের নীলাভ পর্দায়
পদচিন্হের সংকেত আঁকছে
কিন্তু হাওয়ার আকর্ষণ তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে একে অপরের থেকে
আর সেই শব্দগুলো পড়া যাবে না।
জড়বস্তুদের ছন্দকে অনুসরণ করতে
এই সক্রিয় শতাব্দীর কোনও এক সময়
আমিও চেয়েছিলাম
চিন্তা করতে, যুদ্ধে নামতে, জ্যান্ত লোকেদের সঙ্গে বাঁচতে।
কিন্তু আমারই প্রবৃত্তিজাত স্বপ্নের সম্মোহনে বাঁধা পড়ে
ফিরে গিয়েছিলাম একান্ত সেই কৃষ্ণগহ্বরেই,
যেখানে এক অলস আর লোভী পতঙ্গের মতো আমার জন্ম হয়েছিলো শুধু ভালোবাসতে।
আমি ফালতু, নীরস, মন্থর আর উদ্ভট,
সূর্যের আলোয় টানটান আমার এই শরীর নিজেই নিজেকে খাওয়ায়
আর আমি শুধু ভালোভাবে বেঁচেবর্তে থাকি
গ্রীষ্মকালে।
যখন অরণ্য থেকে ঘ্রাণ ভেসে আসে
আর সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমায় রুক্ষ জমিতে
আর ফল খসে পড়ে আমার মুঠোয়।
দৈববাণী
একদিন ...
যে নগরীকে আমি দেখছি অতীত থেকে
আশপাশ ছেড়ে উঠে এসে হাঁটতে শুরু করবে।
তার যত লোহার দাঁড়
এক বিষণ্ণ ছন্দে সচল হয়ে উঠে
এগিয়ে যাবে নদীর দিকে
আর জল, তার যে প্রশস্ত নিরেট আগাগুলো নির্মাণ করেছিলো
রাক্ষুসে সব গহ্বর চিরে গেঁথে যাওয়ার জন্য
সেগুলো দিয়েই তাদের আঁকড়ে ধরবে,
ধারণ করবে নগরীর যাবতীয় হাপরের অরণ্য
-কৃষ্ণকায় বল্লমসমূহ-
ধোঁয়ার তৈরি কুহেলী, যত গিঁট
-উড়তে থাকা ধ্বজাসকল-
আর এঁদো ঘরবাড়ির সৈন্যবাহিনী,
পূর্বনির্ধারিতভাবেই
সে ছেড়ে যাবে তার আর্দ্র ঔপনিবেশিক ভিতগুলো,
আর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে
ঢুকে পড়বে
পুরুষদের
জরাজীর্ণ আর সহজবোধ্য দেশে।
এই সৃষ্টির শুভ্র যত পরাগ, অন্তরীক্ষের সুগন্ধী ক্ষীর,
আহা, কীভাবে যে চাই যদি হতে পারতাম
এক মহৎ অপাপবিদ্ধ প্রজাপতি-
তাহলে তোমার অতীন্দ্রিয় রেণুতে মাথা ডুবিয়ে থাকা যেতো,
আর তোমায় পান করা যেতো যেন তুমি এই মর্ত্যভূমিরই একজন।
এখন আমার চোখে বসন্তের দহন।
কিন্তু লৌকিক আসক্তিরা শুয়ে আছে, ভাঙা বৃন্ত নিয়ে,
আত্মাটা শুকিয়ে গিয়ে চরাচরকে এতোটাই একাকী করে তুলেছে যে
যদি আমি হাঁটি,
এই গোলকে সেই পদধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় আমারই কানে।
তুষারাচ্ছন্ন রাতগুলোয়, যখন মৃতদের শ্বেত কঙ্কালগুলোকে আমি শুনতে পাই যারা নীরব,
নক্ষত্রেরা ঘোরাফেরা করে মাথার উপর দিয়ে,
সব কিছু অভিভূত করে ফেলে আমায়।
যেন এ স্বর্গেরই কোনো এক সাধ, আর আমি সত্যিই জানি না
আমার এ পোড়া কপালে স্বর্গের দেবীর একফোঁটা সুধাকে ফেলাতে গেলে আমায় আর কী কী দিতে হবে।
আলফোনসিনা স্তর্নি ১৮৯২-১৯৩৮
পুরুষ অধ্যুষিত লাতিন আমেরিকান সাহিত্যজগতে আধুনিক যুগের গোড়ার দিকের প্রথম উল্লেখযোগ্য নারী, নারীবাদী এবং কবি আলফোনসিনা স্তর্নি। সুইস-আর্জেন্টিনিয়ান স্তর্নির জীবন ছিলো তাঁর কবিতার মতোই ভ্রাম্যমাণ, উদ্দাম ও বিদ্ধংসী। তিনি প্রচলিত ছককে ভেঙে কবিতায় ফ্রী ভার্স, কথ্যভাষা আর ব্যক্তি অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে নির্মাণ করেছিলেন নিজস্ব শৈলী যা তাঁর সমকালীন ও পরবর্তীতে বহুজনের কাছে অনুসরণীয় হয়ে উঠেছিলো। তাঁর কবিতা লিঙ্গ, অস্তিত্ব, সমাজ আর নারীর অধিকার নিয়ে দৃঢ় ভাষায় জিজ্ঞাসা আর প্রতিবাদ রাখে। তীব্র শরীরী ইঙ্গিতবাহী হয়েও স্তর্নির কবিতা আশ্চর্য শ্লীল, এ এক বিস্ময়। মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে তিনি আত্মঘাতি হন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন