লিওনার্ড কোহেন-এর কবিতা
কৌশিক চক্রবর্তী
১৯৮৮ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কোহেন বলেছিলেন, তাঁর কাছে লেখার প্রক্রিয়া হলো “like a bear stumbling into a beehive or a honey cache: I'm stumbling right into it and getting stuck, and it's delicious and it's horrible and I'm in it and it's not very graceful and it's very awkward and it's very painful and yet there's something inevitable about it.”
কবিতা তো সত্যিই এক “inevitable”… যে লেখে, যে যাপন করে, সে জানে। কবিতায় তিনি লিখে গেছেন তাঁর নিজস্ব একাকীত্ব, মনকেমন, রাজনীতি ও ভালোবাসার আখ্যান। তাঁর বেশ কিছু কবিতাকে পরে তিনি গানে রূপাতরিত করেছেন। পরিচিত সেই গান বা আসলে কবিতাদের বাইরে, অন্য কিছু কবিতাকে বাংলা তর্জমায় রাখা থাকলো এখানে। শরতে, সেপ্টেম্বর মাসে (১৯৩৪) কোহেনের জন্মদিন। আর ২০১৬-এর নভেম্বর, হেমন্তকাল লিখে রেখেছে তাঁর চলে যাওয়া। এই শীতকাল তবে কোহেনের গানের হোক, কবিতার হোক।
মাঝে মাঝে মনে হয়
কে জানে এ শহরের কতজন
সাজানোগোছানো ঘরে থাকে...
গভীর রাতে আমি যখন জানলা দিয়ে বাইরে
ঘরবাড়িগুলোর দিকে তাকাই
চোখে পড়ে প্রতিটা জানলায় একেকটা মুখ
চেয়ে আছে আমার দিকেই
আমি ঘুরে যাই যখন
কে জানে কতজন এমন করে নিজের নিজের টেবিলে ফিরে গিয়ে
এইসব কথা লিখে রাখে...
এই সেই একটা মাত্র কবিতা
যা আমি পড়তে পারি
আমিই সেই একমাত্র লোক
যে এ কবিতা লিখতে পারে
যখন সবকিছু এলোমেলো হয়েছিলো
আমি নিজেকে খুন করিনি
আমি নেশার কাছে গভীর বাণীর কাছে
যাইনি
আমি ঘুমোতে চেয়েছি
কিন্তু পারিনি যখন
লিখেছি
লিখে গেছি
যে লেখা হয়ত বা
এমন কোনো রাতে
আমার মতন কেউ
পড়ে নেবে
আমি আর খুঁজিনি তোমায়
আমি আর অপেক্ষা করিনি
আমি আর মরে যাইনি তোমার জন্য
আমি শুধু নিজের জন্য মৃত্যু চেয়েছি
কী তাড়াতাড়ি বয়েস বেড়েছে
গালে জমেছে মেদ
কোমর স্থূল
তোমায় যে ভালোবেসেছিলাম সে ভাবনা
ক্রমে ধূসর চুল হয়ে গেছে
বুড়ো হয়ে গেছি
ভাবনাহীন, লক্ষ্যহীন
এলোমেলো ঘুরে ঘুরে এটাসেটা খেয়ে
কিনে গেছি আরও বড় পোশাক
ভুলে গেছি কেন নিজের জন্যে রাখা সময়গুলোকে দেখে
এত রাগ হতো
কেন ফিরে এলে আজ রাতে, কেন এলে আবার
আমি যে আজ এই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেও পারি না
গাল বেয়ে অবিরাম কান্না ঝরে পড়ে
আরও একবার ভালোবাসতে ইচ্ছে করে
আরও একবার
এইভাবে বেঁচে থাকতে
আজ ভোরবেলা আমায় সাজিয়ে দিলো বাতাস।
আকাশ বললো – চোখ বন্ধ করো... আর এই
হাসি মুখখানা নিয়ে ছুটে যাও সোজা রোদ্দুরে।
অরণ্য বললো – চিন্তা কোরো না, আমিও পান্নার মতন
বুড়ো, গল্পেগুজবে হেঁটে ঢুকে পড়ো আমার গভীরে।
গ্রাম বললো – আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ, নিখুঁত
তুমি কি এখনই শুরু করবে... বলো?
সে বললো... স্নান করে নিচ্ছি আমাদের
গতবছরের ধরে রাখা জলে, তার স্বাদ তো এখন পাথর...
আজ ভোরবেলা আহা আমায় সাজিয়ে দিলো বাতাস
তুমি বলো নীরবতা আসলে
কবিতার চাইতেও শান্তিকল্যাণের আরও বেশি কাছাকাছি
কিন্তু যদি ‘উপহার’ বলে
আমি তোমাকে নীরবতা এনে দিই
(কারণ আমি যে নীরবতা জানি)
তুমি তাহলে বলবে...
“ এ তো কোনো নীরবতা নয় গো...
এ তো আসলে আরেকটা কবিতাই”
আর তার পর সেটুকু ফিরিয়ে দেবে আমাকেই
তোমার মুখ চেয়ে বলেছিলাম
আমি চাঁদের প্রশংসা করব
বলব... নদীটির রঙ
গাঙশালিকের উচ্ছ্বাস আর বেদনা খুঁড়ে খুঁজে আনব নতুন শব্দ।
তুমি খুব কাছে আছো... যেমন
যা কিছু মানুষ নির্মাণ করে, দেখে নেয়, বপন করে,
তেমন করে কাছের, তেমন করে আমার...
গাঙশালিকেরা আস্তে আস্তে গুটিয়ে নেয় নিজেকে, গান গায় ধীরে
এই হাওয়ার বর্শাফলকে।
নদীর ওপর এই লোহার দরজা
পাথরের আঙুলের ফাঁকে ধরে রাখে তার হিমঠাণ্ডা উজ্জ্বল মুক্তোহার ...
পাড়ে দাঁড়ানো গাছগুলোর ডালপালা নদীর জলের মতন
তিরতির করে কাঁপে
সন্ধিপ্রস্তাব দেয় চাঁদকে
অন্ধকার আকাশ ফুঁড়ে যাতে খরস্রোতে পাড়ি দেওয়া যায়...
আকাশ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর আসে না।
ডালপালাগুলো কিছু শব্দ করে শুধু...
কয়েক মাইলজোড়া বাতাসে বাতাসে
তোমার শরীর আর কথা দিয়ে তুমি সব কিছু বলে দিয়েছ
মুছে দিয়েছ আমার সমস্ত অপরিচয়
আমায় দিয়েছ শেকড় আর গাঙশালিক আর নুড়িপাথর...
তোমার এত কাছাকাছি থাকা... জড়িয়ে ধরতে পারি না তাই
ওদের সঙ্গে আমার চুপিচুপি ভালোবাসাবাসি
তুমি ভয় পাও... এই বুঝি ছেড়ে চলে যাব
যাব না ... যাব না কখনও
চলে যায় তো কেবল অপরিচিতরাই
সবকিছু অধিকার করে নিয়ে আমার যে আজ আর
অন্য কোথাও যাওয়ার নেই...
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন