একটা টেবিল তো টেবিল-ই
পিটার বিক্সেল
ওই বাড়ির একেবারে উপরের তলায় সে থাকে। হয়তো একসময়ে সে বিয়ে করেছিলো, ছেলেপুলেও হয়তো ছিল। এমন হতেই পারে যে, সে একসময়ে অন্য কোন শহরে বাস করতো। একসময়ে তাঁর নিশ্চয়ই একটা শৈশবও ছিল। কিন্তু সে এমন একটা সময় যখন বাচ্চারা বড়োদের মতোই পোষাক পড়তো। তিনিও হয়তো তেমনই পড়তেন। এখনো সেই পোষাকে ঠাকুমার সঙ্গে দেয়ালে টাঙানো ছবিতে তাদের ইতস্তত দেখা যায়।
তার ঘরে দুটি চেয়ার, একটা টেব্ল্, একটিই বিছানা, একটি কম্বল আর একটি কাপবোর্ড। একটা ছোট্ট টেবিলে একটা আলার্ম ক্লক, তার পাশে কিছু পুরোনো খবরের কাগজ আর একটা ফটো অ্যালবাম। দেয়ালে ঝুলছে একটা ছোট্ট আয়না আর একটাই ছবি।
রোজ সকালে আর সন্ধ্যেবেলায় এই বৃদ্ধ সামান্য হাঁটাহাঁটি করেন, আশেপাশের মানুষের সঙ্গে অল্পস্বল্প কথাবার্তা বলেন। এর বেশি কিছু নয়। আর ঘরে ফিরে টেবিলের সামনে বসে থাকেন।
এই নিয়মের কোনো হেরফের ঘটে না। এমন কি রবিবারেও নয়। আর যখন টেবিলের সামনে মানুষটি বসে থাকেন, খুব মন দিয়ে শুধু ঘড়িটার টিক টিক শব্দ শোনেন।
তারপর হঠাৎ সেই বিশেষ দিনটি এলো।
চমৎকার রোদ ঝলমলে এক সকাল। খুব গরম নয়, আবার ঠান্ডাও তেমন নেই। তিনি হাঁটছেন। চারপাশে পাখিদের ডাকাডাকি। মানুষজন বেশ হাসিখুশি, বাচ্চারা হুল্লোড় করছে, খেলছে। আর বিশেষ ঘটনাটি হল, এমন পরিবেশের কারণেই হয়তো, মানুষটি এই সব কিছুকে হঠাৎ ভালোবেসে ফেললেন।
বহুদিন পর তিনি হাসলেন।
ভাবলেন, ‘এইবার সব কিছু নিশ্চয়ই বদলে যাবে।’
জামার উপরের বোতামটা খুলে ফেলে, টুপিটা হাতে নিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন তিনি। যেন বসন্ত এসেছে তাঁর শরীরে, মনে। এক অদ্ভুত আনন্দ! ঘরের পথ ধরলেন। ফেরার পথে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন আর এমন খুশি খুশি ভাব নিয়েই বাড়ির সদর দরজায় এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠে একেবারে নিজের ঘরের সামনে। পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ঢুকে পড়লেন ঘরে।
কিন্তু কই! তার ঘরে তো কিছুই বদলায়নি! সেই টেব্ল্, দুটো চেয়ার, সেই একই বিছানা! চেয়ারে বসেই আবার ঘড়ির সেই টিকটিক শব্দ তিনি শুনতে পেলেন। খুব হতাশ হয়ে গেলেন। তাঁর সব আনন্দ নিমেষে চলে গেল। কিছুই তো বদলায়নি!
মাথাটা গরম হয়ে গেল। এক বিচিত্র ক্রোধ গ্রাস করলো তাঁকে।
আয়নার দিকে তাকালেন। তাঁর মুখ ক্রমে লাল হচ্ছে, চোখদুটো কুঁচকে উঠছে। ওঁর শীর্ণ হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো। প্রবল জোরে টেবিলের উপর একটা ঘুষি মারলেন। প্রথমে একটা, তারপর উপর্যুপরি। সেই সঙ্গে চিৎকারঃ
‘বদলাতে হবে। এই সবকিছুকে পাল্টাতেই হবে!’
এখন তিনি আর ঘড়িটার কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না।
তাঁর হাত ব্যথা হয়ে গেল, চিৎকার করতে করতে ক্রমে গলা ভেঙে গেল। আর আশ্চর্য, ঘড়িটার শব্দ তিনি আবার শুনতে পেলেন! বুঝতে পারলেন, কিছুই পালটায়নি।
‘সব সময়ে সেই একই টেবিল, একই চেয়ার, বিছানা, একই ছবি। আর আমি টেবিলকে টেবিল বলছি, ছবিটাকে ছবি, বিছানাটাকে বিছানা-ই, আর মানুষও তো চেয়ারটাকে চেয়ারই বলছে। কিন্তু কেন? ফরাসীরা বিছানাকে ‘লী’ বলে, টেবলকে ‘তাহবলেহ’, ছবিকে বলে ‘তাহবলো’, চেয়ারকে ‘শেজ’। কিন্তু তারা তো পরস্পরকে বুঝতেও পারে! এবং চাইনিজরাও তেমনই।
'তাহলে বিছানাকে ছবি বলা হবে না কেন!’ কথাটা ভেবেই তাঁর কিন্তু হাসি পেল। তারপর তিনি হাসতেই থাকলেন। হাসতে হাসতে তাঁর গলার স্বর এমন বেড়ে গেল যে, প্রতিবেশীদের ঘরের দেয়ালে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করতে হলো, ‘আস্তে’, ‘আস্তে’।
তিনি খুব জোরে বলে উঠলেন, ‘পাল্টাচ্ছে, শুরু হয়েছে বদল।’ এরপরেই বিছানাকে তিনি ‘ছবি’ বলা শুরু করলেন।
‘ওঃ! খুব ক্লান্ত লাগছে, একটু ঘুমোবো ছবিতে।’ এই বলে তিনি গেলেন ঘুমোতে।
পরদিন সকালে এবং প্রায়শই সকালে অনেকক্ষণ ধরে ‘ছবি’তে শুয়ে থাকতে লাগলেন। ঐ অবস্থাতেই একসময়ে তাঁর চোখ পড়েছিলো চেয়ারে। চেয়ারকে তিনি নাম দিলেন ‘অ্যালার্ম ক্লক’।
তারপর তিনি ‘ছবি’ থেকে উঠে সাজগোজ করে এসে বসলেন ‘অ্যালার্ম ক্লক’-এ। হাতদুটো ছড়িয়ে দিলেন টেবিলের উপর। কিন্তু টেবিল তো আর টেবিল নেই, নতুন নাম পেয়েছে সে। ‘কম্বল’!
তাহলে কি দাঁড়ালো? এক সকালে তিনি ‘ছবি’ থেকে উঠে, জামাকাপড় পড়ে ‘কম্বল’-এর সামনে ‘অ্যালার্ম ক্লক’-এ বসে ঘরের অন্যান্য আসবাবপত্রের দিকে নজর দেওয়া শুরু করলেন। সব কিছুরই তো পছন্দমতো নামকরণ শুরু করতে হবে! তাঁকে তো বদলাতে হবে!
বিছানাকে ‘ছবি’।
টেবিলকে ‘কম্বল’।
চেয়ারকে ‘অ্যালার্ম ক্লক’।
খবরের কাগজকে তিনি ‘বিছানা’ নাম দিলেন।
আয়নাকে ‘চেয়ার’।
অ্যালার্ম ক্লককে ‘ফটো অ্যালবাম’।
কাপবোর্ডের নাম দিলেন ‘খবরের কাগজ’।
কম্বলকে ‘কাপবোর্ড’।
ছবিকে ‘টেবিল’।
আর ফটো অ্যালবামকে নাম দিলেন ‘আয়না’।
এভাবে এক দিন, এই বৃদ্ধ মানুষটি ‘ছবি’তে শুয়ে থাকলেন অনেক বেলা অবধি। সকাল ন’টায় ‘ফটো অ্যালবাম’ বেজে উঠলো। মানুষটি উঠে দ্রুত পায়ে, পা দুটো যেন ঠান্ডায় জমে না যায়, গিয়ে বসলেন ‘কাপবোর্ড’-এর উপর। এরপর তিনি ‘খবরের কাগজ’ থেকে জামাকাপড় বের করে নিলেন। পোষাক পড়ে তিনি দেয়ালে ঝোলানো ‘চেয়ারে’র দিকে তাকালেন। তারপর ‘কম্বল’-এর উপরে রাখা ‘অ্যালার্ম ক্লক’এ গিয়ে বসলেন আর ‘আয়না’র উপর চোখ বুলোতে থাকলেন, যতক্ষণ না মায়ের ‘টেবিল’-এর উপর তাঁর চোখ পড়লো।
ব্যাপারটা তাঁর কাছে খুব মজার মনে হ’ল। তারপর সারাদিন ধরে এই গোটা বিষয়ে সড়গড় হওয়ার জন্য বারবার অভ্যাস করা শুরু করলেন। যতক্ষণ না নতুন শব্দগুলোয় তিনি অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন, অভ্যাস চলতে থাকলো। তা’হলে এখন ঘরের সব জিনিসেরই নতুন নাম দেওয়া হয়ে গেছে। এখন তিনি তো আর মানুষ নন। কেবল ‘পা’ মাত্র। আর পা হ’ল ‘সকাল’, সকালটা ‘মানুষ’।
এবার আপনি গল্পটা লিখতে শুরু করুন। মনে রাখবেন, এভাবেই আপনি, ঐ বৃদ্ধ যেমন করেছিলেন, আপনিও করতে পারবেন আর অন্যান্য বিষয়গুলিরও নতুন নামকরণ করতে পারবেন।
যেমন ধরুন,
অ্যালার্ম ক্লকের শব্দকে নাম দিলেন ‘পা ফেলা’,
ঠান্ডায় জমে যাওয়াকে ‘দেখা’,
শুয়ে থাকা-কে ‘রিঙ্গিং’,
দাঁড়িয়ে থাকা-কে ‘ঠান্ডায় জমে যাওয়া’,
পা ফেলে যাওয়া-কে ‘চোখ বুলিয়ে যাওয়া’।
এমন আর কি!
তা’হলে কি দাঁড়ালো!
বৃদ্ধ অর্থাৎ বুড়ো ‘পা’ অনেকক্ষণ ধরে ছবির মধ্যে শুয়ে থাকলেন। সকাল ন’টায় ফটো অ্যালবাম বেজে উঠলো। পা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে প্রায়। তাই কাপবোর্ডের উপরে এমনভাবে গিয়ে বসলেন, যাতে সকালটা দেখতে না হয়।
এরপর নিজের জন্য বৃদ্ধ স্কুলের কিছু নীল নোটবুক কিনলেন। ঘরে ফিরে নতুন শব্দসব লিখলেন নোটবুকে। এবং লিখতেই থাকলেন। এই কাজটা তাঁকে বেশ কিছুদিন খুব ব্যস্ত রাখলো। এখন রাস্তায় তাঁকে আর সচরাচর দেখা যায় না।
এভাবে সব জিনিসের নতুন প্রতিশব্দ একসময়ে তিনি আয়ত্ত করে ফেললেন। আর যতই তিনি এমন নতুন নতুন শব্দে পারদর্শী হয়ে উঠলেন, সঠিক বা প্রচলিত শব্দ ভুলেই গেলেন প্রায়। এখন এক নতুন ভাষা তিনি পেলেন, যা একেবারেই তাঁর নিজস্ব এক সম্পদ।
এরপর সময়ে অসময়ে তিনি এই নতুন ভাষায় স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন। ছোটবেলায় যেসব গান তিনি শিখেছিলেন, সেগুলিকে নতুন এই ভাষায় অনুবাদ করে ফেললেন। নিজের মনে খুব নিচু গলায় নতুন ভাষায় গানগুলি তিনি গাইতেন।
কিন্তু কিছুদিন পরেই এই অনুবাদের কাজটা তাঁর পক্ষে ক্রমে খুব মুশকিলের হয়ে দাঁড়ালো। নিজের পুরোনো ভাষা তিনি ভুলেই যেতে বসলেন প্রায়। অগত্যা নীল নোটবুকটাতে সঠিক শব্দ তাঁকে খুঁজতে হ’চ্ছিল। আর মানুষের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারটা তাঁর কাছে হয়ে দাঁড়ালো খুব উদ্বেগের। মানুষজন বিভিন্ন জিনিসপত্রকে যে নামে ডাকে, সেসব বুঝতে তাঁকে অনেকক্ষণ চিন্তা করতে হচ্ছে।
তাঁর ‘ছবি’কে ওরা বিছানা বলছে!
‘বিছানা’কে বলছে খবরের কাগজ!
তাঁর ‘চেয়ার’কে বলছে আয়না!
‘ফটো অ্যালবাম’কে বলছে অ্যালার্ম ক্লক!
‘খবরের কাগজ’কে কাপবোর্ড!
‘কাপবোর্ড’কে কম্বল বলছে!
তাঁর ‘টেবিল’কে বলছে ছবি!
‘ঘরের আয়না’কে তারা ফটো অ্যালবাম বলছে!
এভাবে একটা সময়ে এমন হলো যে, লোকজনের কথাবার্তা শুনলেই হাসি পেতে শুরু করলো তাঁর।
‘তুমি কি আগামীকাল ফুটবল খেলা দেখতে যাচ্ছো?’ কিংবা কেউ একজন হয়তো বললো, ‘আমেরিকায় আমার এক মামা থাকে।’
আর এমন ভাষায় তাদের কথা বলতে শুনে উনি হেসে ফেলতেন।
হাসতেন, কারণ এইসব কথা কিছুই তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
শেষ অবধি এটা অবশ্য মজার গল্প থাকলো না।
খুব বিষন্ন আবহে এই গল্প শুরু হয়েছিলো আর শেষ-ও হ’ল খুব দুঃখের মধ্যে।
ধূসর রঙের কোট পড়া বৃদ্ধ চারপাশের লোকজনকে যে আর বুঝতে পারছেন না, সেটা হয়তো ভীষণ খারাপ কিছু না। এটা হতেই পারে।
সব থেকে খারাপ ঘটনা যেটা তা হচ্ছে, লোকজন তাঁকে আর বুঝতে পারছে না।
তিনি নীরব হয়ে গেলেন।
কেবল নিজের সঙ্গেই কথা বলতেন।
এমন কি, তাদের দেখে ন্যূনতম অভিবাদনটুকুও তিনি আর জানাতেন না।
হায়!
পিটার বিক্সেল
সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন শহরে ১৯৩৫ সালের ২৪শে মার্চ এক নিম্নবিত্ত পরিবারে পিটার বিক্সেল-এর জন্ম। তাঁর জন্মের পর পরিবারটি সুইজারল্যান্ডের ওলটেন শহরে চলে যায়। সেখানে প্রথাগত পাঠ শেষ করে বিক্সেল পেশা হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। সুইজারল্যান্ডে তিনি একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক এবং লেখক হিসেবে পরিচিত। And Really Frau Blum would very much like to meet the Milkman তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পসংকলন। প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৬৪ সালে। সেখান থেকেই এই গল্পটি আহরিত। প্রথমে ইংরেজি ভাষায় ২০১৭র মার্চে লিডিয়া ডেভিস এই গল্পটি অনুবাদ করেন। বিক্সেল-এর প্রথম উপন্যাস The Seasons (১৯৬৫) Gruppe 47 Prize পুরস্কার পায়। বিক্সেল কুড়িটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য অন্তত ১১টি পুরস্কারে তিনি সম্মানিত হ’ন।
ঋণঃ কবি, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক কৌশিক চক্রবর্তী
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন