অরুণেশ ঘোষ ও তাঁর কবিতা

সুচেতা ঘোষাল

অ্যাসিড দিয়ে পোড়ানো মেয়েদের মুখগুলো মন দিয়ে দেখেছেন কখনোও? অথবা আশিকুর রহমান নামের যে ব্লগার মৌলবাদীদের হাতে খুন হলেন সেদিন? ওই প্রায় থেঁতলে যাওয়া মুখটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ঠিক কতক্ষণের মধ্যে পেজ থ্রির বলিষ্ঠ পুরুষের উপর চোখ রেখে স্বস্তি পেয়েছেন? রেলে কাটা পরা প্রেমিকের দেহাবশেষ দেখতে গিয়েছিলেন কি মর্গে? নানাবিধ ছাল ছাড়ানোর পরে, মানুষের চেহারার কি অদ্ভূত বদল ঘটে লক্ষ্য করে দেখেছেন? তাদের ছায়াগুলো কিন্তু তখনো আগের মতই দেখতে থাকে, অবিকল, অথচ রক্ত মাংসের মূর্তিগুলো হয়ে ওঠে একইসাথে অসহায় আর শক্তিশালী।  অরুণেশ ঘোষের কবিতা, প্রবন্ধ ও যাবতীয় রচনা সম্পূর্ণ নগ্ন। উপরোক্ত ঘটনাগুলোর মতই অস্বস্তিকর, ভয়হীন এবং সৎ।

আমার ব্যক্তিগত অসাবধানী ও অস্থির সময়-যাপনের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, জীবনের বিভিন্ন ধাপে যেসব কবি ও তাদের কবিতা আমাকে অশান্তি দিয়েছে, তাদের কাছে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। সন তারিখ খেয়াল নেই, কোনও এক ঘন দুপুরে কেউ একজন কানের কাছে উচ্চারণ করেছিল, “আমি মাথা নিচু করে প্রণাম করেছিলাম বেশ্যাকে। বেশ্যা তো থ। সে এক কাব্য,জানো ভারী একটা গল্প হয়ে গেল তারপর।’’ তারপর আরও বলে চলল, “সে আমাকে দিল তার নৃত্যরত ছবি, যোনিমুদ্রা আঁকা কালো গান, স্তনহীন নারীকে অপসারিত করার অধিকার এবং সে-কারণে ছুরি।  সে আমাকে শেখালো দুঃখের গণিত, আমি মূর্খদের কিনতে শিখলাম।  ঊরুর মাংস কাগজে মুরে হাতে তুলে দিল সে, ‘গাঁ গঞ্জে বিতরণ কোরো, সবাইকে বোলো এই মাংসের কথা।’ বেশ্যাকে আমি প্রণাম করেছিলাম অন্ধকারে। নারীকে ক্রুশবিদ্ধ করলে ক্রুশকাঠ কি অপমানিত বোধ করে?” দুপুরবেলার নিশ্চিন্ত মধ্যবিত্ত জীবনকে এইসব প্রশ্ন করলে, ভারী ঝামেলা নেমে আসে। আমার আবার তাতে খুব আরাম, স্বস্তির দিনগুলোই বরং অসহনীয় হয়ে ওঠে বেশিরভাগ সময়ে।


কবিরা স্বভাবগতভাবে অত্যাচারী হন, ফটোগ্রাফার অথবা চিত্রকরেরা কিন্তু তুলনায় নিরীহ। কবিদের খেলা তো শব্দ নিয়ে, আর শব্দের ইন্টেন্সিটি আলো অথবা রঙের থেকে অনেক পরিমানে বেশি হিংস্র, শব্দে রহস্যের জন্য পড়ে থাকে অল্পই। আর আমরা যারা পাঠক, শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে সেই ফাঁদে পা’ও দিয়ে চলেছি, স্বেচ্ছায়, একের পর এক কবিকে সুযোগ দিয়েছি প্রলয় বাঁধানোর। প্রলয় তা ঠিক কোথায় দেখা যাক — যুগযুগান্তরের কাব্যে, রচনায়, আলাপে যে মায়ায় ঢাকা থাকতো যৌনতা, অরুণেশের প্রতিটি কবিতা এই স্ট্রাকচারকে ভেঙেচুরে শেষ করে দিয়েছে। একটা কবিতায় যখন ধর্ষিত হয় চাষীর ঘরের কিশরী মেয়ে, অন্য কবিতায় মধ্যবিত্তের ঘরে ধর্ষণ করে মাইনে করা গৃহশিক্ষক। সমাজ তৈরী করা অনেক শ্রেণীগুলোর একটা থেকে অন্যটায় ঝাঁপ দিতে দিতে অরুনেশ বুঝিয়ে দিতে থাকেন — কি নিম্ন কি মধ্য — অন্ধকারে পার্থক্যগুলো চেনা যায় না আর, তখন সব মানুষকেই উলঙ্গ দেখায়। এমন কি ব্যাসদেবও তো দুর্বল জীবনের নিষ্ঠুরের কাছে।


“নিজেকে নিক্ষেপ করো কুরুক্ষেত্রে তোমাকে চেনে না কেউ,

তুমিও তন্মধ্যে বোকা বোকা মুখ নিয়ে,

খুঁজবে কী অর্থ গীতার শ্লোকের পাশে ব্যাসের ব্যাসার্ধ

অর্থাৎ সঙ্গমরত ব্যাসদেব নিজে জানে কি

জন্মান্ধ আর জন্ডিস জন্মাবে, হায় তার ব্যর্থ বীজে!”


অরুনেশ ঘোষের নানা সময়ের সাক্ষাত্কার থেকে খুব সহজেই জানা যায় তাঁর জীবনযাত্রার কথা, যা আমাদের চেনা ছকের থেকে আলাদা। সমাজের যেখানটায় আলো অল্প, যেখানে  সমাজ-চিন্হিত অন্যায়কে রাস্তা ধরেই মানুষ বেআব্রু হয়েছে, কিন্তু  প্রকৃতির কাছে, নিজেদের কাছে তারা স্বচ্ছ্ব, অরুনেশ চিরকাল সেখানে স্বস্তি পেয়েছেন। বেশ্যাপল্লীর অনেকের সাথে একসাথে তাঁর বড় হয়ে ওঠা। একসাথে কয়েকজন তকমাহীন মানুষ যেমন দিনযাপন করেন, সেইভাবেই। তাঁর সমস্ত লেখা জুড়ে এঁদের রাজত্ব — যে বেশ্যার উপার্জনে বৃদ্ধ বাপের দিন কাটে, অথবা কচি ছেলের পড়াশোনার খরচ চলে, তিনিই নায়িকা। উন্মাদ স্বামীকে উঠোনে রেখে, স্ত্রী ঘরে ঢোকে অন্য এক পুরুষকে নিয়ে, সঙ্গম শেষে দুই পুরুষের সামনে সাবান মেখে  চান করতে করতে স্বাভাবিক আলাপ চালায় তার সঙ্গীটির সাথে। স্বামীর সামনেই, হাসতে হাসতে জানায় অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তার উন্মাদ স্বামীটি গায়ে কোনও কাপড় রাখতে চায় না। “সব সময় ল্যাংটা, কি বিশ্রী, এর জন্য কেউ-ই — কোনও লোকই আসতে চায় না” — নগ্নতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এই কবিতায় প্রশ্ন থেকে যায়, কে তবে নগ্ন হলো? সে বাড়ির পাগল? তার স্ত্রী? নাকি তার সঙ্গী? এই ডায়নামিক্স গুলোই অরুণেশের কবিতা।


অরুণেশ অন্ধকারের কবি, সকল অর্থেই অন্ধকারের মানুষ। প্রতিদিনের খবরের কাগজে অ্যাসিড পোড়া মেয়েগুলোর মুখ, একের পর এক লেখক যাঁরা শুধু তাঁদের মত করে সত্যিটুকু বলার অপরাধে কুপিয়ে খুন হচ্ছেন প্রতিমাসে, তাঁদের শরীর গুলো দেখলে মনে হয় অমন একজন মানুষের খুব দরকার হয়ে পড়ছে এই দিনকালে।


তবে কবিরা সহজে মরেন না, দেহ হারান ঠিকই। অরুণেশের শরীর যেমন ছেড়ে যায় পুকুরের জলে, হার্ট এটাক ঘটে জলে থাকা কালীন। কিন্তু অরুণেশ যে ভীষণ কবি, আর কবিরা  সহজে মরেন না। পাঠকের প্রেম, অপ্রেম, যৌনতা, আবেগে, আশ্লেষে, পাঠকের রাজনীতি জুড়ে তারা বাঁচেন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন