ফরাসি কবিতা

ব্লেজ সঁদ্রার্স 

ফরাসি থেকে অনুবাদ : সৈয়দ কওসর জামাল


  

 

কালপুরুষ

(Orion)

এই হল নক্ষত্র আমার

তার আকার হাতের মতো

আমার এ হাত যেন উঠে আছে আকাশের দিকে

সারাটা যুদ্ধের মধ্যে আমি দেখেছি উজ্জ্বলতর কালপুরুষ

যখন যুদ্ধবিমান জেপেলিন প্যারিসের ওপর বোমা ছুড়তে আসে তারা সর্বদা এসেছে কালপুরুষ থেকে

আজ সেটি আছে আমার হাতের ওপর ঊঁচুতে

বিশাল মাস্তুল বিদ্ধ করছে সেই হাতের তালুকে নিশ্চয় ব্যথায় ভরে উঠছে

আমার বিচ্ছিন্ন তালু আমাকে যন্ত্রণা দেয় যেভাবে বিদ্ধ সে এক অনন্ত হাতলে

 




বৈশাদৃশ্য

(Contrastes) 

আমার কাব্যের জানলা হাট করে খোলা আছে বড়ো রাস্তার দিকে আর তার শোকেসের মধ্যে

জ্বলজ্বল করছে

আলোর মহার্ঘ পাথরেরা

শোনো বেহালা লিম্যুজিনের আর জাইলোফোন লাইনোটাইপের

অনধিকারীও স্নান সেরে নিচ্ছে আকাশ-টাওয়েলে

সর্বত্র রঙের ছড়াছড়ি

পথচারী মেয়েদের টুপিগুলো ধূমকেতু সন্ধ্যার আগুনে

 

ঐক্য

এর বেশি ঐক্য আর নেই

সব ঘড়ি এখন দ্যাখায় মধ্যরাত দশ মিনিট পিছিয়ে

আর কোনো সময় নেই

আর কোনো পয়সা নেই

চেম্বারের মধ্যে

ওরা ধ্বংস করে ফেলছে প্রাথমিক বিষয়ের অসামান্য উপাদানগুলো

 

রেস্তোরাঁর মধ্যে

কর্মীরা নীল পোষাক পরে রেড ওয়াইন পান করছে

প্রতি শনিবার তারা বাজি ধরে

খেলায় খেলায়

যখন তখন এক দুর্বৃত্ত গাড়িতে চড়ে চলে যায়

কিংবা এক শিশু খেলা করে ত্রিয়োম্পের আর্কের সঙ্গে...

মঁশিয় কোশোঁকে আমি বলি তিনি যেন তাঁর আশ্রিতদের রেখে আসেন আইফেল টাওয়ারে

 

আজ

মালিকানা হস্তান্তর হবে

পুণ্যাত্মা বিক্রিত হবে ছোটো ছোটো দোকানগুলিতে

আমই খুশি মনে পড়ছি ক্যালিকো কর্ন-পপির ফালি

কেবল সরবনের ঝামাপাথরে ফুল ফোটে না

পরোপকারীর চিহ্ন সেন নদীর বিপক্ষে চায করে চলে

আর সেন্ট-সেভেরিনের উদ্দেশ্যে

আমি শুনে যাই নিরন্তর ট্রামের ঘরঘর শব্দ

 

বৃষ্টি হচ্ছে ইলেকট্রিক আলোর বাল্ব

উত্তর-দক্ষিণ আনন্দনৌকোর পূবের মেট্রো মঁত্রুজ স্টেশন

সবকিছু আলোকময়

গভীর

রু দ্য বুসি রাস্তায় ওরা চিৎকার করে বিক্রি করছিল ইন্ট্রানজিয়া  আর পারি-স্পোর্টস

আকাশের এরোড্রাম এখন আলোয় প্রজ্জ্বলিত যেন শিমাবুর আঁকা ছবি

ওদিকে উঁচুতে

আছে মানুষেরা

লম্বা

কালো

বিষণ্ণ

এবং ধোঁয়া, কারখানার চিমনি

 



নির্মাণ

(Construction)

রঙের, রঙের আর নানা রঙের...

ওখানে রয়েছে হালকা যা ছড়িয়ে পড়ছে তৃতীয় যুগের এক সূর্যের মতন

ক্রমশ প্রখর হচ্ছে

আর ঠিক করে দিচ্ছে

মৃত্যুর প্রকৃতি

পৃথিবীর ওপরের ত্বক

তরলতা

কুয়াশা

যাকিছু জন্মায় সব ছিন্নভিন্ন

মেঘের জ্যামিতি

ডুবেযাওয়া ওলনদড়ি

অশ্মীভুত হয়ে যাওয়া

সঞ্চরণ

সবকিছু সন্তরণশীল

আত্মা ফেরে জীবনে হঠাৎ বস্ত্র পরে প্রাণী ও লতার মতো

বিশাল রূপেই

এবং এখন

চিত্রকর্ম হয়ে ওঠে এত বিশাল ও চলমান

 

চাকা

জীবন

মেশিন

মানবাত্মা

৭৫ মিলিমিটার সিলিন্ডার হেড

আমার পোর্টেট

 

 

ভোর

(Aube)

 ভোরবেলায় আমি ইঞ্জিনের ভিতরে নেমে গেছি

শেষ বারের মতো আমি শুনেছি পিস্টনের গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস

 

পলকা নিকেলের হ্যান্ড-রেল ধরে ঝুঁকে আমি শেষ বারের মতো অনুভব করি সেই হাতলের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি আমার মধ্যে প্রবেশ করছে আর তার সঙ্গে অতিউত্তপ্ত তেলের দুর্গন্ধ এবং বাষ্পের ভীরু উষ্ণতা

 

আমাদের একটিমাত্র পানীয় প্রধান মেকানিক সেই বিষণ্ণ আর নিরুদ্বিগ্ন মানুষটি যার শিশুসুলভ সুন্দর হাসি আর কথা বলেন না যেভাবে আমি বলি

 

যখন তাঁর রুম ছেড়ে চলে আসছি তখন সমুদ্রের দিক থেকে সূর্য তার সব স্বাভাবিকতা নিয়ে আর তার তাপ ছিল খুবই তীব্র

ফিকে লালচে বেগুনি রঙের আকাশে মেঘ ছিল না

আর আমরা যখন সান্টোজ এর দিকে এগিয়েছি আমাদের জলপথ বর্ণনা করেছে একটা বড়ো বাঁকানো তির যা চিকমিক করছিল নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে

 

****




ব্লেজ সঁদ্রার্স 
(Blaise Cendrars ১৮৮৭-১৯৬১জন্মেছিলেন সুইৎজারল্যান্ডে। তাঁর নাম ছিল ফ্রেদেরিক লুই সোসের। ব্লেজ সঁদ্রার্স নাম গ্রহণ করেছিলেন ১৯০৭ এ প্যারিসে 

আসার পর, ১৯১০ সালে কবিতা লেখা শুরু করার সময়। তাঁর ছিল পৃথিবী ভ্রমণের অন্বেষা। রাশিয়ার থেকেছেন, থেকেছেন আমেরিকায়। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘নিউ ইয়র্কে ইস্টার’ (১৯১২)।  ‘ট্রান্স-সাইবেরিয়ান ও ফ্রান্সের ছোট্ট জেআনের গদ্য (১৯১৩) দীর্ঘ কবিতা তাঁর কবিসত্তাকে চিনিয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের হয়ে লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিলেন এবং আহত হন। তাঁর ডানহাত কেটে বাদ দিতে হয়। ‘লা ম্যাঁ কুপে’ (ছিন্ন হাত) তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা। তাঁর আর একটি দীর্ঘ কবিতাগ্রন্থ ‘পানামা, কিংবা আমার সাত মামার অভিযান (১৯১৮)। ‘উনিশটি ইলাস্টিক কবিতা’ (১৯২১) ও ‘কোডাক’ (১৯২৪) তাঁর ছোটো কবিতার সংকলন। ১৯২৪ সালের পর আর কবিতা লেখেননি। এর পর সঁদ্রার্স উপন্যাস রচনার দিকে ঝুঁকেছিলেন। একের পর এক উপন্যাস লিখেছেন ১৯৫৬ সাল অবধি।]




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন