বোবাচোখ শুনতে পায় না
 


          ট্রেনে রোহনা যাচ্ছি নিজের কামরায় বসে আছি মেয়েটা ঢুকলো মনে হলো, বাবা, মা 


ছাড়তে এসেছেন

- এটা কর ওটা করিসনে জানলা দিয়ে ঝুঁকবিনে অচেনা মানুষের সাথে ভাব করার দরকার নেই

সাবধানবাণীতে বাণীতে মেয়েটির অস্থির অবস্থা! শেষ পর্যন্ত ট্রেন ছাড়লো ওরা বললেন- কথাগুলো মনে রাখিস

ওই সময় আমি অন্ধ ছিলাম চোখে আলো সহ্য হচ্ছিলো না মা বাবার সাবধানের সবেধন নীলমণিকে দেখতে পেলাম না আন্দাজ করছিলাম, সামনেই চটি পরে হাঁটছে কেমন দেখতে, বুঝতে পারছি না। বুঝতে হয়তো দেরি হবে হয়তো বুঝতেই পারবো না। তার আগেই নেমে যাবে।

গলার স্বর শুনেছি খুব মিষ্টি। ছোট্ট ছোট্ট কথা। এমন কি চটি পায়ে হাঁটার শব্দও বেশ নরম।   

- আপনি কি দেহরা যাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করলাম

এমন অন্ধকার কোণে বসে আছি, দেখেইনি চমকে উঠেছে বিস্ময়ে বলে উঠলো- কে? সরি আপনি আছেন, বুঝতেই পারিনি

ঠিকই তো! চোখ থাকলেও সবাই ঠিকঠাক দেখতে পায় না কিন্তু ভাব দেখায়, যেনো অন্যের চেয়ে বেশি দেখছে অথচ আমার মতো যাঁরা দেখেন না, কিংবা কাণা, ছানিপড়াদের মতো আবছা সামান্য দেখেন, বাকিটুকু তাঁরা অন্য ইন্দ্রিয় দিয়ে পুষিয়ে নেন মেয়েটি তেমন নিশ্চয় নয় বললাম- আমিও আপনাকে দেখতে পাইনি শুনতে পেয়েছি

ভাবলাম, আমি যে অন্ধ জানাবার দরকার নেই যে অন্ধকারে বসে আছি, চোখ আড়াল করা মোটেই কঠিন নয়

সে বললো- সাহারানপুরে নেমে যাবো জ্যাঠাইমা নিতে আসবেন

মজা করে বললাম- ওরে বাবা, জ্যাঠাই মা! তাহলে আপনার সাথে বেশি ভাব না করাই ভালো জ্যাঠাইমা মানেই খাণ্ডারনি

তাঁর চুড়ি আর রিনরিন হাসির শব্দ পেলাম- আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

বললাম- দেহরা ওখান থেকে মুসৌরি

- মুসৌরি! দারুণ!! যেতে খুব ইচ্ছে করে পাহাড় আমার খুব প্রিয় বিশেষ করে এই অক্টোবরে

-হ্যাঁ, এই সেই মনোমুগ্ধকর সময়

মুগ্ধস্মৃতি চারণ করছিলাম- বুনো দেহলি ফুলে পাহাড় ছেয়ে যায় ঝকঝকে রোদ্দুর দিনে ওড়না ছাওয়া পূর্ণিমা রাত ঝিমঝিম আগুনের সামনে বসে আধো অন্ধকারে সিপ, সিপ দু এক চুমুক বিয়ার, আহ! লাভলি

মেয়েটি চুপ আমাকে রোমান্টিক ভাবছে কিংবা আমি তাঁকে ছুঁয়ে ফেলেছি! সে কি রোমান্টিক হয়ে উঠলো? 

জিজ্ঞেস করলাম- ভালোলাগে না?

ভুল করে ফেললাম কি? ও কি আমাকে মেয়েঘেঁষা ভাবছে? নারীকে ভোলাতে সব পুরুষই এমন সাধারন প্রশ্ন করে থাকে উঁহু! ভুল করিনি মেয়েটির স্বর আবেশে আধো জড়িয়ে এসেছে জিজ্ঞেস করলো- আপনি জানালার বাইরেটা দেখছেন না কেনো?

চক্ষুষ্মানের মোচড়ে নিজেকে জানালার দিকে ঘুরিয়ে নিলাম জানালা খোলায় ছিলো বাইরেটা দেখতে পাচ্ছি না দেখার ভান করছি ইঞ্জিনের ধকধক, রেলের লোহার পথ চাকায় পিষে ধাতবঘর্ষণ শরীরে মিশে যাচ্ছে কল্পনায় দেখছি, টেলিগ্রাফ তারের ভিতর টরেটক্কা খবরগুলো সমানে সামনের দিকে দৌড়ে চলেছে, টেলিগ্রাফ পোস্টগুলো পিছনে বললাম- লক্ষ্য করেছেন? গাছগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, আমরা দেখি, পিছনে ছুটছে

- তাই তো ঘটে এ আর নতুন কী? দেহরার জঙ্গলে কোনো জানোয়ার দেখলেন?

– দেহরাতে জানোয়ার প্রায় নেইই

জানালা থেকে ঘুরে মুখোমুখি বসলাম দুজনেই চুপচাপ একটু সাহসীই হয়ে উঠলাম সব নারীই প্রশংসার কাঙাল বানিয়ে বললাম- আপনার মুখখানা অদ্ভুত আকর্ষনীয়

চুড়ির ছন্দে বেজে ওঠা সেই মিষ্টি হাসি শুনতে পেলাম, মেয়েটি বলছে– সত্যিই শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেছি, আমি নাকি মিষ্টি,  সুন্দর মধুর 

- হ্যাঁ, সত্যিই আপনি মুগ্ধকর আকর্ষণীয়া মানেই তো সুন্দর

- আপনিও যথেষ্ট সাহসী কিন্তু এতো গম্ভীর কেনো?

তাই তো! মেয়েটিকে উদ্দেশ করে একবারও হাসিনি অন্তত এক আধবার হাসা উচিত ছিলো কিন্তু অকারনে হাসলে কেমন বোকা বোকা লাগে আর ভীষণ একা মনে হয়

- শিগ্‌গির আপনার গন্তব্যে আমরা পৌঁছে যাবো আমাকে এখনও দুতিন ঘন্টা যেতে হবে বিরক্তিকর

আমার একাকীত্বে পাহাড় প্রমাণ আপশোষ মেয়েটির গলায় বাষ্প হয়ে এলো- ইস্‌স, আমার কিন্তু সারাটা জীবন এমন চলতে, কথা বলতে, শুনতে ভালোলাগে

মেয়েটি এক্ষুণি নেমে যাবে এই মধুর যাওয়া আমাদের ফুরিয়ে যাবে ও ভুলে যাবে, এই সব অদরকারি কথাবার্তা কিন্তু যতক্ষণ এই ট্রেনে চলতে থাকবো, সে আমার সঙ্গেই রয়ে যাবে এমন কি ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ার পরও

হুইসেল অন্যরকম আওয়াজে বেজে উঠেছে চাকাগুলোর শব্দও বদলে যাচ্ছে রেলের পাটির সাথে বেশি পিষে যেতে না চেয়েও এগিয়ে যেতে যেতে ট্রেনটি থামতে চাইছিলো চলার ছন্দও বদলে গেছে মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিলো চুল সামলাচ্ছিলো বুঝলাম না, মিশকালো ববকাট না ঢেউ খেলানো কবরী! হেয়ার ব্যানে আটকালো নাকি বিনুনি অথবা এলো করে ছড়িয়ে দিলো পিঠময়? চোখ থাকলে দেখতাম ট্রেন আস্তে আস্তে প্লাটফর্মে থেমে গেলো কুলি, হকারদের হাঁকডাক চাপা দিয়ে যাঁর গম্ভীর গলা পেলাম, নিশ্চিত  জ্যাঠাইমা মেয়েটি বললো- তাহলে আসি

ওর চুলের মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিলাম খুব কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো ইচ্ছে করছিলো একটু ছুঁয়ে দেখি ততক্ষণে নেমে গেছে গন্ধ রয়ে গেছে, যেনো সে দাঁড়িয়ে আছে

“ তুমি ইচ্ছে করলেই কবিতাকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিতে পারো কিন্তু সুগন্ধ মুছে ফেলতে পারো না কিছুতেই...”

একজন নতুন যাত্রী এসেছেন ক্ষমা চেয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি, মনে নেই ফিরে চললাম, বার্থের দিকে পৃথিবী আবার অন্ধ হয়ে গেলো মঞ্চে নতুন যাত্রা শুরু হলো 

নতুন গান গেয়ে ট্রেন গতি বাড়িয়ে দিয়েছে সামনের সিটে আবার আলো এসে পড়েছে। নতুন যাত্রী। আমি অন্ধকার দেখছি জানালার বাইরেও অনেক কিছু ঘটে চলেছে সামনের যাত্রী, স্তব্ধতা ভেঙে দিলেন রহস্য করে বললেন- নিশ্চয় আপনার খারাপ লাগছে লাগবারই কথা যিনি নেমে গেলেনে, তাঁর মতো সুন্দরী আমি নই

বললাম- মেয়েটি সত্যিই বুদ্ধিমতী আচ্ছা বলতে পারেন, মেয়েটির চুল কোঁকড়ানো না টানটান?

ভদ্রলোক রহস্য আরো ঘনিয়ে তুলে বললেন- চুল খেয়াল করিনি তবে চোখদুটো সত্যিই সুন্দর হলে কী হয়? পুরোপুরি অন্ধ দেখেননি?



বীজগল্প: দ্য আইজ আর নট হেয়ার

লেখক: রাসকিন বণ্ড (ভারত)

বিনির্মান: সাধন দাস


রাসকিন বণ্ড 

(জন্মঃ ১৯৩৪- ) ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত ভারতীয় লেখক মুসৌরিতে থাকেন ছোটোগল্প, উপন্যাস, শিশু সাহিত্য রচয়িতা আওয়ার ট্রিজ গ্রো ইন দেহরা লিখে ১৯৯২এ সাহিত্য একাদেমি পান, ১৯৯৯ পদ্মশ্রী, ২০১৪ পদ্মভূষণ সত্তরের দশকে “দ্য সেন্সুয়ালিস্ট নামে একটি গল্প লিখে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হন ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল ফর চাইল্ড এডুকেশান তাঁকে শিশু সাহিত্যে অবদানের জন্য সম্মানিত করেন চলচ্চিত্রায়িত জুনুন তাঁর লেখা দুরদর্শনে তাঁর ছোটোগল্পের সিরিজ দেখানো হয়েছে       

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন