টি. এস. এলিয়ট-এর কবিতা
জে. আলফ্রেড প্রুফ্রকের প্রেমগান
ভূমিকা ও অনুবাদ: জুয়েল মাজহার
যদি জানিতাম, যারে আমি দিতেছি উত্তর
পুনরপি সে ফিরিবে এ–মরজগতে
তবে ফের এই শিখা জ্বলিত না মোর
অপিচ কদাপি কেহ এ-পাতাল হ’তে
জীবন্ত ফেরেনি; শুনি যাহা, আদতে তা সত্য যদি হয়
তব কাছে করিব বর্ণন আমি নিন্দাভীতি বিনা।
তুমি আর আমি মিলে চলো তবে যাই,
যখন ছড়ানো সন্ধ্যা আকাশের গায়
টেবিলে শুইয়ে-রাখা ইথার-অবশ এক রোগীর মতন;
চলো যাই, আধ-ফাঁকা পথগুলো ক্রমশ উজিয়ে
এক-রজনীর-শস্তা-হোটেলে হোটেলে
অস্থির রাতের যত খয়া-খয়া প্রলাপ এড়িয়ে, আর
ঝিনুক-শোভিত আর কাঠকুচি-ছাওয়া যত রেস্তোরাঁর ভিড়ে
সেইসব পথের চলন
ফন্দি-আঁটা, একঘেঁয়ে তর্কের মতন,
যে-পথেরা নিয়ে চলে তোমাকে নাছোড় এক জিজ্ঞাসার দিকে …
জানতে চেয়ো না তুমি, অহো, ‘এটা কি’?
যাই আর চলো গিয়ে দেখি।
ঘরটিতে মহিলারা আসে আর যায়
মিকেলেঞ্জেলোর কথা জিভের ডগায়।
হলদে কুয়াশা তার পিঠ ঘষে জানালার কাচে,
হলদে ধোঁয়াটি তার নাক ঘষে জানালার কাচে,
জিভেতে চাটল এসে গোধূলির যতগুলি কোণ,
থমকে দাঁড়াল শেষে নর্দমার খুঁটিগুলো ঘেঁষে,
পড়ুক পিঠেতে তার চিমনির যত ঝুলকালি,
বারান্দা গলিয়ে সে একবার হঠাৎ লাফাল,
আর এই আশ্বিনের সুকোমল রাতখানি দেখে,
বাড়িটাকে এক পাক দিল আর ডুবে গেল ঘুমে।
এবং সে আলবত পাবেই সময়।
হলদেটে সে-কুয়াশা শার্সিতে পিঠ ঘ’ষে
পথ বেয়ে চলে চুপিসারে;
যে-মুখগুলিকে তুমি চেনো, সেসব মুখের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নিখুঁত
একটি মুখ গড়ে নিতে মিলবে সময়, ঠিক মিলবে সময়;
মিলবে সময় ঢের হননের আর সৃজনের
কত যে রয়েছে পড়ে কাজ, সেসবের জন্য ঢের রয়েছে সময়, আর
যে-হাতেরা উঁচিয়ে প্রশ্ন এক ছুড়ে দ্যায় তোমার থালায়
সেসব হাতেও আছে অঢেল সময়,
সময় তুমিও পাবে সময় আমিও পাব ঢের
এবং অযুতবার দ্বিধাচালে দোলার সময়,
এবং নিযুতবার দেখা আর যাচিয়ে দেখার,
টোস্ট আর চা-খাওয়ার আগে
ঘরটিতে মহিলারা আসে আর যায়
মিকেলেঞ্জেলোর কথা জিভের ডগায়।
আর হাতে আলবত থাকবে সময়
আর, ‘‘ আমি পাব কি সাহস?’’, ‘‘ আমি পাব কি সাহস?’’--- একথা ভাবার;
থাকবে সময় হাতে উল্টো ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবার
একটা টাক গজিয়েছে, মধ্যিখানে চাঁদিতে আমার---
( বলবে সকলে: দ্যাখো, কেমন পাতলা হয়ে যাচ্ছে ওর চুল )
আমার প্রভাতী-কোট, আঁটসাট আমার কলারখানি ছুঁয়েছে চিবুক
নেকটাই রুচি-সুশোভন, তবু, একটি মামুলি পিনে গাঁথা
( বলবে সবাই: ওর হাত-পা সব কেমন মাজুল )
তেমন সাহস কই
তোলপাড় করবো নিখিল?
একটি মিনিট, তাতে ভেবে দেখা, যাচিয়ে দেখার,
রয়েছে সময়, আর, একটি মিনিট এসে করবে সব ওলট-পালট
যেহেতু সবাই আমার চেনাজানা, সবাইকে আমি খুব হাড়ে হাড়ে চিনি
চেনাজানা ভোরগুলি, অপরাহ্ন, গোধূলির ক্ষণ
কফির চামচে আমি পরিমাপ করেছি জীবন;
দূরের ঘরটি থেকে ভেসে-আসা সুরের আড়ালে
পতনের লয়ে ক্রমে লীয়মান স্বর আমি চিনি
তাহলে কী করে আমি সাহস কুড়াব?
আর ওই চোখগুলো চিনি আমি, চিনে গেছি সবই
যে চোখেরা, পরিপাটি করে যারা তোমাকে সাজায়
এবং যখন আমি নিক্তিমাপা, পিনে-গাঁথা ছটফট করি
এবং যখন আমি, পিনে-গাঁথা, দেয়ালে কাতরাই
তাহলে কী করে শুরু করি
থুথুসহ ছুড়ে দিতে প্রত্যহের এঁটো-অবশেষ?
কী করে সাহস আমি পাই?
আর ওই বাহুগুলো চিনি আমি, চিনেছি সকলি----
বাজুবন্ধপরা ওই নগ্ন আর শাদা বাহুজোড়া
( তথাপি,বাতির আলোয় হালকা বাদামি পশমে তারা ঢাকা !)
এ-কি তবে পোশাকবাহিত কোনো ঘ্রাণ
যা আমাকে করে আনমনা?
দুটি বাহু টেবিলে এলানো, কিংবা, একখানি শালেতে মোড়ানো
কী করে সাহস আমি পাবো? আর
কী করে করবো আমি শুরু?
বলব কি, সরু ওই পথ ধরে গোধূলিতে গেছি আমি হেঁটে
দেখেছি কত না হাতাঅলা জামা-গায়ে, জানলার বাইরে-মাথা,
নিঃসঙ্গ লোকেদের পাইপের ধোঁয়া উড়ে যেতে?
একজোড়া ক্রুদ্ধ ভোঁতা থাবা যদি হতে পারতাম
বেড়াতাম সুমসাম সাগরের তল চিরে চিরে।
আর ওই অপরাহ্ন, সন্ধ্যা, আহা, কী সুখে ঘুমায়!
দীর্ঘ সরু আঙুলের আলতো পরশে মসৃণ,
ঘুমন্ত… ক্লান্ত…কিংবা ভণিতায় পার করে দিন,
তোমার আমার পাশে, এইখানে মেঝেতে সে শুয়েছে সটান।
পাব কি মনের জোর, কুলফি-বরফ, কেক, চা-পানের শেষে,
একটি নিমেষ, একে ঠেলে দিতে এর নিজ সংকটের দিকে?
যদিও কেঁদেছি আর করেছি উপোস, করেছি কান্না আর করেছি প্রার্থনা,
যদিও দেখেছি আমি মুণ্ড আমার ( তাতে হালকা টাক ) বয়ে আনা হলো এক ঢাউস থালায়,
নই আমি প্রেরিত পুরুষ–- মহিমাও নেই কিছু তাতে;
এ-আমার মহিমার ক্ষণ আমি দপ করে নিভতে দেখেছি
আরও দেখেছি আমি, অনন্তের দারোয়ান আমার পাতলুন ধরে হাসিতে লুটায়,
অল্প কথায় বলি, মনেতে লেগেছে বড়ো ভয়।
শেষমেষ, এটাই হওয়ার ছিল তবে,
পেয়ালা, মোরব্বা আর চা-পানের পর্বটি শেষে
চিনেমাটি তৈজস, এসবের ভিড়ে আর তোমাকে-আমার-বলা গল্পের ফাঁকে, তাতে
হতো কি তেমন কোনো লাভ
দ্বিধা ঝেড়ে হাসিমুখে যদি আমি দিতাম প্রস্তাব,
পৃথিবীকে দুমড়ে এক পিণ্ডবৎ আকার দিতাম,
গড়িয়ে দিতাম একে নাছোড়-দুর্মর এক প্রশ্নের দিকে,
আর বলতাম: “লাজারাস আমি, এসেছি মৃতের দেশ থেকে
এসেছি জানাতে আমি সব, তোমাকে জানাব আমি সব”------
আর সে-রমণী যদি শিয়রে বালিশ পেতে বলে:
“ আমি তো আদৌ এটা চাইনি বোঝাতে,
ব্যাপার তা নয় মোটে, ব্যাপার তা নয়।’’
আর শেষে, এমনই হওয়ার ছিল তবে,
মিলতো কি ফায়দা কোনও তাতে
সূর্যাস্ত, উঠান-দেউড়ি আর ছড়ানো পথের শেষে
উপন্যাস, চা-পেয়ালা, মেঝেতে-গড়ানো যত ঘাঘরা আর
এই-যে এটা, এর পরেও বহু কিছু রয়েছে সেখানে?
যে কথাটি বলতে চাই, বলা অসম্ভব!
যেন এক জাদুর লন্ঠন স্নায়ুজাল ছুড়ে দিয়ে পর্দাজুড়ে সাজিয়ে রেখেছে
কী লাভ, কিসের ফায়দা তাতে
যদি সে-রমণী তার শিয়রে বালিশ পেতে, ছুড়ে ফেলে শাল
জানালার দিকে ঘুরে বলে:
“এমনটা আদৌ আমি চাইনি বোঝাতে,
ব্যাপার তা নয় মোটে, ব্যাপার তা নয়।’’
নই আমি হ্যামলেট, রাজার দুলাল, কপালে ছিল না সেটা লেখা;
শুধু এক পার্শ্বচর লর্ড, দলভারী করা যার কাজ
কুমারে মন্ত্রণাদান, একটি-দুটি দৃশ্য উন্মোচন
ধূর্ত, কূট, সতত সজাগ;
নগণ্য ও অভাজন এক ক্রীড়নক, যদি কাজে লাগি ধন্য হই
মাথাটা কিঞ্চিৎ ভোঁতা, মুখে তবু বড় বড় বুলি পইপই
মাঝেমাঝে অন্যদের হাসির খোরাক আর
কখনও-বা হদ্দ বোকা বনে যেতে হয়
বয়স হচ্ছে… আমি যাচ্ছি বুড়িয়ে
পরবো আমি পাতলুনের কিনার মুড়িয়ে
টেরি কেটে ফেলব পেছনে? আর, ভয় পাব পিচফল খেতে?
পশমের শাদা পাতলুন পরে আমি হাঁটব সৈকতে।
শুনলাম কান পেতে, সুরে সুরে গাইল গান কত জলপরি
মোটেই ভাবি না আমি, আমাকে শোনাবে তারা গান
দেখেছি তাদের আমি, ঢেউয়ে চড়ে সাগরের দিকে সাঁতরে যেতে
গেল তারা চিরে চিরে তরঙ্গের সফেদ কুন্তল;
বায়ুর চাপড় লেগে ক্ষণে শাদা, ক্ষণে কালো জল।
আমরা কত না কাল কাটিয়েছি জলধির মহলে-মহলে,
সাগরকন্যারা পাশে, পরেছে পাটল-লাল শৈবালের মালা
গেলাম অতলে ডুবে, যখন ভাঙালো ঘুম মানুষের গলা।
------------------------------
//
টি. এস. এলিয়ট ও ''জে. আলফ্রেড প্রুফ্রকের প্রেমগান'' কবিতা নিয়ে কয়েক ছত্র
‘Let us go then, you and I,
When the evening is spread out against the sky
Like a patient etherized upon a table....’
—এই তিনটে চরণ, বলা চলে, ইংরেজি কবিতাকে দিয়েছিল আধুনিক যাত্রাপথের দিশা। অন্যভাবে বলা যায়, ইংরেজি কবিতার আধুনিকতার যাত্রাবিন্দু এই ত্রিচরণ। অমূলকও নয় তা: The Love Song of J. Alfred Prufrock নামের এই কবিতাটি এমনসব উপাদান, এমনসব কুললক্ষণ, এমনসব দৃশ্য ও চিত্রকল্প, এমনসব অনাস্বাদিতপূর্ব বিষয় আর ভাব-অভিভাব নিয়ে বিশ্বকবিতায় হাজির হয়েছিল, যা যুগান্তকারী আর বৈপ্লবিক। তাঁর বিখ্যাত আর বহুল পঠিত-আলোচিত কবিতা ‘পোড়ো জমি’ (The Waste Land) রচনারও ঢের আগে লেখা হয়েছিল এই কবিতা। ‘পোড়ো জমি’ কবিতারও মানসবীজ ছিল ‘‘The Love Song of J. Alfred Prufrock’’ নামের এই কবিতা; অবশ্য এলিয়ট প্রথমে এর নাম দিয়েছিলেন Prufrock Among the Women.
১৯১৫ সালে Poetry ম্যাগাজিনে এটি ছাপা হয় ‘‘The Love Song of J. Alfred Prufrock’’ শিরোনামে। এর দু’বছর পরে, ১৯১৭ সালে, এটি ছাপা হয় ‘প্রুফ্রক অ্যান্ড আদার অবজারভেশন্স’ (‘Prufrock and Other Observations’ ) নামের বইতে।
The Love Song of J. Alfred Prufrock বিশ শতকের ইউরোপীয় আধুনিকতার (Modernism) অনেক বৈশিষ্ট্য ও কুললক্ষ্মণ ধারণ করে আছে: ভাবের খণ্ডায়ন, হতাশা, বিশ্বাসের সঙ্কট, জীবনের অর্থহীনতা, উদ্বেগ, অস্তিত্বের অসারতার অনুভূতি আর সবকিছুতে নৈরাজ্য, অনাস্থা, দ্বিধা ও ভণিতা। নিখিল নাস্তি আর নিখিল নেতিঘেরা ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল’ এক জগতের আলেখ্য যেন। এলিয়ট এসবেরই প্রতিভূ হিসেবে আধুনিক মানুষের ছবি এঁকেছেন তাঁর কবিতাবলিতে------ The Love Song of J. Alfred Prufrock দিয়ে যার শুরু। টি. এস. এলিয়টকে নিয়ে গৌরচন্দ্রিকা অনাবশ্যক। মৃত্যুর এত-এত বছর পরেও বিশ শতকের সবচেয়ে শংসিত-আলোচিত এই কবির খ্যাতি ও প্রভাব এখনও অটুট। কেউ কেউ কবিতার বিশ-শতককে ‘এলিয়টীয় শতক’ বলতে আগ্রহী।
‘জে. আলফ্রেড প্রুফ্রকের প্রেমগান’ তাঁর প্রথম দিককার কবিতাবলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এ-কবিতায় এলিয়টের কবিপ্রতিভা যতটা স্ফূর্তিলাভ করেছে, সে তুলনায় তাঁর অতি-বিখ্যাত, অতি-আলোচিত কবিতা ‘The Waste Land’ বা ‘পোড়ো জমি’-তে ততটা নয়। কাব্যগুণে ও সিদ্ধিতে ‘পোড়ো জমি’-র চেয়ে ‘ জে. আলফ্রেড প্রুফ্রকের প্রেমগান’-কে শ্রেয়তর বলে মনে হয়। প্রায় একই কারণে তাঁর প্রথম দিককার কবিতা-সংকলন ‘Prufrock and Other Observations’ আধুনিক ইংরেজি কবিতার ইতিহাসে সবচেয়ে উন্মোচক, উন্মীলক ঘটনা। বিশ্বকবিতার ইতিহাসে এ-কবিতা বাঁকবদলের সবচেয়ে বড়ো মাইলফলক; আর ওয়ার্ডসওয়ার্থ, মিল্টন-কোলরিজদের লিগ্যাসি-টানা প্রচল ইংরেজি কবিতার পুরনো দুর্গে এই কবিতাই সর্বপ্রথম আধুনিকতার রক্তাপ্লুত ধ্বজাটি উড়িয়েছিল। আধুনিকতাবাদ ছিল রোম্যান্টিকতাকে চুরমার-করে-দেওয়া এক নতুন মতবাদ--- স্বস্তি-ভাবালুতার অবসান ও বিসর্জনের সূচক; এক টেকটোনিক-চ্যুতি, এক প্যারাডাইম শিফট। যে প্রকৃতিলগ্নতা, যে সারল্য, যে আশা, কল্পনার হর্ম্যমিনার ঘিরে যে ভাব-কাতরতা ছিল প্রচল কবিতার কুললক্ষ্মণ, এলিয়ট তার বিপরীতে গড়ে তুললেন বহু-গ্রন্থিল আর ক্রমজটিল এক চক্রনেমি।
The Love Song of J. Alfred Prufrock—কবিতার শুরুতেই এলিয়ট নিজের অপর সত্তাটিকে, অথবা তাঁর ঈপ্সিত রম্য রমণীকে, বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানান। তবে তার আগে পাঠকের চোখ থেকে রোমান্টিকতার রঙিন চশমাটি খুলে নেন; পাঠকের পূর্বধারণা, অভ্যাস, স্বস্তি ও আবেশকে চুরমার করে দিয়ে কবিতার শুরুতেই এলিয়ট সন্ধ্যাকে তুলনা করে বসেন একজন ইথার-অবশ রোগীর সঙ্গে ( একটা সময় ছিল যখন অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীকে অচেতন করতে ইথার প্রয়োগ করা হতো)--- Like a patient etherized upon a table--... এ-যেনবা, ‘‘কেউ যাহা শোনে নাই, কোনও এক বাণী’’ ----একটিমাত্র চরণের মধ্য দিয়ে এলিয়ট বয়ে আনলেন।
কবিতার প্রথম তিনটে চরণ--- চিরকালের মতো ঘুরিয়ে দ্যায় প্রচল ইংরেজি কবিতার অনবচ্ছিন্ন গতিপথ; একে চালিত করে দেয় নিষ্করুণ, লৌহ-ইষ্টকময়, ফন্দি ও ভণিতাময়, শঠে-শাঠ্যং, ক্রমজটিল, মুখোশঢাকা-মুখে-গিজগি
‘‘হলদে কুয়াশা এসে পিঠ ঘষে জানালার কাচে, / হলদে ধোঁয়টিঁ এসে নাক ঘষে জানালার কাচে’’---The yellow fog that rubs its back upon the window-panes, / The yellow smoke that rubs its muzzle on the window-panes... আর, soot that falls from chimneys... বাড়িঘর আর কারখানার শত শত চিমনির ঝুলকালি, ধোঁয়া ও ধূলিতে আবিল ল্যান্ডস্কেপ,এর নগরনিসর্গ। হলদেটে আবিল ধোঁয়ায় ঢেকে আছে এর আকাশরেখা। এর বাসিন্দাদের মনে শুধু হতাশা, ক্রূরতা, দ্বিধা, সন্দেহ, সংশয় ও ক্লেদ... হিয়েরোনিমুস বশ্-এর (Hieronymus Bosch) —এর আঁকা এক নরক যেনবা, যা থেকে পরিত্রাণের আশা নেই কোনও।
এই কবিতা, প্রচলের পদ্মবনে আচমকা ঢুকেপড়া এক মত্ত হস্তি বলা যায় একে । ভবিষ্যকালের ইংরেজি কবিতার, সেইসঙ্গে গোটা দুনিয়ার ভবিষ্য কবিতারও, মন্ত্রবীজ এই কবিতাটি দেখায়, এলিয়ট নামের এক ভবিষ্য-নৃপতির বৈদূর্যমণিখচিত উষ্ণীষের চকিত ঝলক। এভাবে বললে, বোধ করি বাড়িয়ে বলা হয় না। এই কবিতাটি আধুনিক নগরজীবনের অন্তঃসারশূন্যতা আর অর্থহীনতা, এর ভেতর-ফাঁপা, মুখোশঢাকা স্থূল ও কদর্য-কুটিল রূপ, এর ভাণপটু কপটতা আর নিরাবেগ উদাসিনতার নান্দীপাঠ যেন।
কবিতাটির শুরু থেকে শেষ অব্দি এলিয়টের অসাধারণ বিপুল কল্পনা-প্রতিভা, নব-ভাবনা ও যেন শতবাহু, শতডানা বিস্তার করে আছে----- এ-কবিতায় এলিয়ট কোনো সময়-সঙ্গতি মেনে চলেন নি; যেনবা ইচ্ছে করেই স্বাভাবিক যুক্তিপরম্পরা ভেঙে দিয়েছেন। তাই একের পর এক আপাত-বিসদৃশ ইমেজে এগিয়ে যেতে থাকে এ-কবিতা। ক্যাওস আর হারমোনি এখানে হাত ধরাধরি করে চলে। পরস্পরের প্রতিপক্ষ বা অ্যাডভারসারি হিসেবে নয়, বরং অযূথ ব্যক্তিমানুষের অল্টার ইগো হিসেবে জায়গা বদল করে চলে। এলিয়ট-বর্ণিত ‘কল্পনার লজিক’ ( “There is a logic of imagination as well as a logic of concepts”) যেন প্রতিফলিত এ-কবিতার কাঠামো ও আত্মায়।
--
--
S’io credesse che mia risposta fosse
A persona che mai tornasse al mondo,
Questa fiamma staria senza piu scosse.
Ma percioche giammai di questo fondo
Non torno vivo alcun, s’i’odo il vero,
Senza tema d’infamia ti rispondo.
---ওপরে উদ্ধৃত এই ষড়পঙ্ক্তি The Love Song of J. Alfred Prufrock কবিতার এপিগ্রাম। দান্তের (Dante) ‘দিভিনা কোম্মেদিয়া’-র (Divina Commedia) ইনফার্নো অংশ থেকে নেওয়া। সেখানে আমরা গুইদো দ্য মন্তেফেল্ত্রোর (Guido da Montefeltro) বয়ানে উঠে আসে ভয়াল এক নরকের ছবি; যে নরক থেকে নিষ্কৃতি লাভের কোনও আশা তার নেই।
কবিতার নায়ক জে. আলফ্রেড প্রুফ্রকও এমনই এক মনো-নরকের বাসিন্দা; যে-নরক থেকে বের হবার কোনো পথ খুঁজে আর পায় না সে।তাই ফ্যান্টাসি বা অতিকল্পনাই তার আপাত- আশ্রয়। আসলে প্রুফ্রক কোনো চরিত্র নয়, বরং নিছকই একটি নাম; ক্রম ক্ষীয়মান, ক্ষীণতর এক স্বর কেবল। কবিতার শুরুতেই টেবিলে শায়িত ইথার-অবশ রোগীর সঙ্গে তুলনীয় যে সান্ধ্য- মুহূর্তের নাটকীয় বর্ণনা পাই, তা আসলে প্রুফ্রকেরই অর্ধচেতন মানসিক অবস্থাটির প্রতিরূপ। প্রুফ্রকের সিদ্ধান্তহীন, দ্বিধা-কম্পিত মনটাও অলস-বিবশ, নির্কলরব সন্ধ্যাটির মতোই অসাড়তালিপ্ত। প্রুফ্রক নিজেকে আধুনিক নগরনাট্যের এক ট্র্যাজি কমিক্যাল-হিস্ট্রিক্যাল অ-রোম্যান্টিক আর অরাজকীয় ‘হ্যামলেট’ বলেই মনে করে; নিজেকে তার মনে হয় হাস্যাস্পদ, নিকৃষ্ট এক ভাঁড়; অন্য সবার চোখে যে এক কাপুরুষ বা ঊন-পুরুষ। তার স্বগতোক্তির মধ্যে ‘আমি’ ও ‘তুমি’ আদতে তার নিজেরই দুই বিভক্ত সত্তা। তার প্রেমগান তার আপন মনের ইনফার্নোর বাইরে কখনোই ব্যক্ত-উচ্চারিত হবে না। প্রুফ্রক নিজেও তা আলবত জানে। কেবলি একঘেঁয়ে পথ, কুয়াশা-বেড়ালের ছবি, বাইবেলের জন দ্য বাপ্তিস্ত, লাজারাস, মিকেলেঞ্
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন