প্রণব কুমার বর্মনের কবিতা
অসমিয়া থেকে বাংলা অনুসৃজনে : বাসুদেব দাস
আমার দেশকে তুমি এত সহজে বিক্রি করতে
পার না হে রাজনীতিবিদ ,হে নেতা মন্ত্রী হে
কোম্পানির কর্তৃপক্ষ
আমার দেশ মাতার গর্ভ ভেদ করে তুমি নিতে
পারবে
তেল লোহা কয়লা হীরা
পরাতে পারবে প্রিয় নারীকে গলার হার
সাজাতে পারবে প্রাসাদ
মধুমতী নায়িকার পালঙ্কে শয়ন, করতে পারবে
সোমরস পান
কিন্তু আমার দেশকে তুমি সহজে বিক্রি করতে
পার না হে রাজনীতিবিদ
আমার দেশমাতার তুমি বস্ত্র হরণ করতে পারবে
কিন্তু পারবে না করতে উলঙ্গ
কোথাও এখনও কৃ্ষ্ণ জেগে আছে
দেশমাতার লজ্জা ঢাকার জন্য আছে ত্রিরঙ্গা
শুকিয়ে বালুচর হয়ে যায়নি ব্রহ্মপুত্র গঙ্গা
আমার দেশকে তুমি এত সহজে বিক্রি করতে
পার না হে রাজনীতিবিদ ,হে দালাল,হে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ
আমার দেশ অঙ্কিত হয়ে রয়েছে বাল্মীকির কাপ দোয়াতে
দাঁড়িয়ে আছে রাম এবং রামায়ণের গম্বুজে
হিরণ্য কশিপু হয়ে যেখানে করবে পদাঘাত
চেতনায় অথবা স্বাধীনতায়
বাক অথবা ক্ষুধার ভাত
সেখানেই প্রতিবাদ সেখানেই মুর্দাবাদ
সেখানেই মুষ্টিবদ্ধ হাত
নখাল নরসিংহের নিনাদ
আমার দেশের মানচিত্র কুরুক্ষেত্রের রক্তে অঙ্কিত
ন্যায়ের জন্য গান্ডীব টংকার আজও বাজে
শরশয্যায় পিতামহ রক্তাক্ত
কর্ণ ভুপতিত , দ্রোণাচার্য নিহত
তুমি কে হে ধৃতরাষ্ট্র
কোম্পানি বহুজাতকের মোহে অন্ধ
বভ্রূবাহন জেগে আছে মণিপুরে
আমার দেশকে তুমি এত সহজে বিক্রি করতে পার না
বেদে শিকড় থাকা পুষ্প-পত্র বিকশিত আমার দেশ
যার অনেক ফুলের নাম গীতা, ত্রিপিটক,
চার্বাক, শৈব, শাক্ত ,শঙ্করাচার্য ,কীর্তন ঘোষা, বিবেকানন্দ
যার অনেক ফলের নাম গৌতম বুদ্ধ, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বোস, লাল বাল পাল
ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, কুশল কোঁয়র, আব্দুল কালাম ,লাল বাহাদুর কালাম আজাদ,
যার শিকড়ে শিবাজী, মঙ্গল পান্ডে, গোমধর, টিপু সুলতান
সেই বোধের বৃক্ষ NOT FoR SALE
আমার দেশকে তুমি বাজারের পণ্যের মতো দরদাম
করতে পার না
শতাংশ হিসেবে দিতে পারনা রেহাই
নিলামে বাজি রাখতে পার না
আমার দেশ মানে কেবল ক্রিকেট নয়
নয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা
নয় জোট বন্ধন, নয় দলাদলি, সংসদের হাতাহাতি
নয় উচ্চতম অট্টালিকা নির্মাণের গৌরব
আমার দেশ দাঁড়িয়ে আছে আকাশ ছুঁয়ে
আকবর দীন-ইলাহিতে, পুরুর দম্ভে, অশোকের সারণাথে
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে,লীলাবতীর বীজগণিতে
আমার দেশের কন্ঠে গালিবের শায়েরী, তানসেনের সুর
মীরাবাইয়ের ভজন
কবীরের কাব্য, মজরুহ সুলতানপুরী, গুলজারের
পদ্য, কে সচ্চিদানন্দন, জীবনানন্দ ,নবকান্ত
তোমাদের মনিমুক্তার চেয়ে অনেক বেশি যার মূল্য
আমার দেশকে তুমি এত সহজে বিক্রি করতে পার না
পাল্লায় তুলতে পার না দেশের স্বাধীনতাকে
এই দেশের মানচিত্র আঁকা আছে
গুলিবিদ্ধ জোয়ানের বুকে,
চাষির গোড়ালিতে, দলিলের নির্যাতিত পিঠে
ফাঁসি কাঠে, প্রতিটি মন্দির, মসজিদ, গির্জা
গুরুদ্বারে ,শিশুদের হাসিতে, মহিলাদের স্বপ্নে,
যুবক-যুবতীর নিঃশ্বাসে, বৃদ্ধের স্মৃতিতে ,শহীদ
মাতার চোখের জলে
তুমি তাদের ত্যাগ থেকে কীভাবে কেড়ে নিয়ে
বিক্রি করবে আমার দেশকে
আমার দেশকে তুমি এত সহজে বিক্রি করতে পার না
হে রাজনীবিদ,হে নেতা ,হে মন্ত্রী ,হে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ
NOT FOR SALE আমার দেশ!
নীলিম কুমারের কবিতা
অসমিয়া থেকে বাংলা অনুসৃজনে : বাসুদেব দাস
আমি তাকে জানি
তিনি কখন ও শূন্যতার কথা লিখতে পারেনা
শরীর বেয়ে আত্মাকে হাতড়ে বেড়ায় সে
যার আঙ্গুলে নখ থাকে না, ঠোঁটে থাকেনা ঠোঁট
বিছানায় শীতল চুল মেলে যে স্বপ্ন দেখে না
সাপের অরণ্যের।
যার হাত থেকে খসে পড়ে একটা মোম
আর অন্ধকারে খুঁজে বেড়ায় শরীরের যাত্রা পথ
আমি তাকে জানি
তিনি কখনও শূন্যতার কথা লিখতে পারেন না
আজ রাতে সমস্ত বীণার তাঁর
ছিঁড়ে যাবে। আমার হাতে গজাবে অজস্র আঙ্গুল
পাখির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাবে আঙ্গুলগুলি।
প্রত্যেকেরই বুকের তাঁর ছিঁড়ে বাজবে আমার আঙ্গুল।
কারণ,আজ রাতে আমি পান করব
নদীগুলি, ছোটো নদী এবং ঝর্ণা গুলি
মাছ এবং শামুকগুলি, ফুল এবং জোনাকি পোকা গুলি,
ভেসে আসা মানুষের চোখগুলি।
চাঁদটাকে আমি হয়তো পুঁতে রাখব
তারাগুলি আমি হয়তো আজ রাতে উপড়ে ফেলব
উৎসবে।
সৌরভ শইকীয়ার কবিতা
অসমিয়া থেকে বাংলা অনুসৃজনে : বাসুদেব দাস
একজন নারীর মতোই ব্যবহার করে।
সুন্দরী একজন রজস্বলা রমণীর মতোই সে
ফুটবলটাকে নিয়ে খেলা খেলে।
গ্লাসে বিয়ার ঢালতে ঢালতে, ওহো না
ডিস্কোথেকে জাজওয়েভ শুনতে শুনতে, ওহো না
ব্রাজিলের সাওপাওলো থেকে এই হীরা খচিত রত্নটি সঙ্গে নিয়ে
হুস করে সে উড়ে যায় ইউরোপে
আর ফুটবলটি ভাবে — হানিমুন
সে চুমু খায় শব্দ করে করে
প্রবল জোয়ারে আলিঙ্গন করে
উপচে দেয় সে গোলের ঠিকানা লিখে, রোণা… রোণা
ইস!
শাসন করার পরিবর্তে মন ভুলানোর যত্ন করে
কেননা সে জানে
এই দু পা থেকেই নিক্ষেপিত হবে সেই ত্রাস সঞ্চারী মিসাইল
যেখানে বলটা আঁকাবাঁকা মেঘে সাজাবে অপর পক্ষকে
তাই,
ফুসলানোর চেষ্টা করে
অন্য মন ভুলানো সামগ্রীর মতো এক পদের পরে অন্য পদ দিয়ে
কারণ বলটা তো জানে না
সে যে তাকে নারীর মতোই ব্যবহার করে…
জীবনে তখনই নাটকের উদ্রেক ঘটে, যখন ঈশ্বর চায়
সাংঘাতিক কিছু হোক।
কী বলছে শোনো, সেই বুড়ো ঈগল পাহাড়টা—
লেভ ইয়াসিন এলেও বোধ করি
রক্ষা করতে পারত না।
গাছের পাতা বাতাসে উড়ে উড়ে যেভাবে আলগোছে মাটিতে পড়ে যায়
মেসির শটটাও সেভাবে ভাঁজ নিয়ে প্রবেশ করেছিল যথাস্থানে
যথাস্থানে
যথাস্থানে।
ওঃ চোখের জল। গতি যেন রামধেনু
মাঝরাতে বিশাল এলসিডিটা যখন
মোচড় খেয়ে ফুঁপিয়ে উঠেছিল
আর হৃদয়!
পাশবিক ফুটবল খেলছিল ওরা
পাশবিক।
কেননা তোমার আকাশ এই তুলা পাতার সাদায়
কয়েক ফোঁটা কালি মাত্র।
বলটা মালিকের কথা শুনবেই।
দ্রুত সরিয়ে নিও না।
কারণ, পাতা গজিয়েছে
কারণ,লতা বেয়ে উঠছে
বসন্ত নেমেছে সোনার পা দুটিতে।
বিপুল কুমার দিহিঙীয়ার কবিতা
অসমীয়া থেকে বাংলা অনুসৃজনে : বাসুদেব দাস
কথাগুলি সহজভাবে নিতে পারি না
জ্বলতে থাকে অসহজ কথাগুলি
শহীদের উত্তাপে রঞ্জিত আকাশ
বাতাসে জ্বলে ফুল এবং চাঁদ
এই যে পাগল বাতাসে—মৃতদের পৃ্থিবী
এই যে আর্তনাদের সমুদ্রে—বুকে বুলেট
তথাপি বেঁচে থাকতে হবে
তথাপি বাঁচতে বাঁচতে সেলাই করতে হবে
রাজ অট্টালিকার আক্রোশ
কথাগুলি সহজভাবে নিতে পারি না
চোখের সামনেই হয় কেনা-বেচা
মাংসের মতো বিক্রি হয় কাঁচামাটির গন্ধ
জ্বলতে থাকে অসহজ কথাগুলি
জমাটবাঁধা রক্তে ছটফট করে ছটফট করে।
আগুনেরও আছে আত্মা।শব্দ আছে।উত্তাপ আছে
আছে আলো
আগুনের নেই ভালোবাসা।দয়া
আগুনের উত্তাপে আমি উজ্জীবিত হই নতজানু নবজাতক
তথাপি আগুনকে ভয় করি-আগুন আমার স্নেহাতীত আকুতি
আগুনকে জড়িয়ে ধরার জন্য আগুনের সঙ্গে কথা বলি
আগুনের সঙ্গে বিলীন হই মাটিতে
আগুনের শেষ কৃ্তিত্বে আমি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিই
আগুন পোড়াতে পারে না কথা এবং কাজ
সেইজন্যই আগুন আমার আপন।
সুরেশ ভূঞার কবিতা
অসমিয়া থেকে বাংলা অনুসৃজনে : বাসুদেব দাস
লাল রং আমার অতি প্রিয়
লাল আমার প্রিয় রং
আমার জন্মের সময় পূবের আকাশ লাল হয়ে
উজিয়েছিল নাভির দিকে।বাবা মাকে একটা লাল
গোলাপ উপহার দিয়েছিল সেদিন। আমার প্রতিটি
জন্মদিনে মা-বাবা মন্দিরে মন্দিরে
অর্ঘ্য দিয়েছিল একটি রক্ত জবা।
মা যাবার দিন পশ্চিম সাগরে লাল হয়ে ডুবেছিল
সূর্যটা। বাবা শেষবারের মতো মায়ের
শিরে লাল সিঁদুরেরর ভালোবাসা পরিয়ে দিয়েছিল।আমার প্রতিটি
নিঃশ্বাসে দেহের প্রতিটি রন্ধ্রে লাল গুলি
দ্রুত দৌড়েছিল।
আমার জীবনের শুভ লগ্নে
শিরের সিঁদুর। যজ্ঞের জবা। আর-
ফুলশয্যায় গোলাপের লাল গুলি আমার প্রিয়
ছিল।
লাল আমার প্রিয় রং।
প্রিয় হওয়ার জন্যই আদর করি লাল রক্ত,
যেভাবে লাল গোলাপ। রক্ত জবা। লাল সিঁদুর।
লাল হওয়ার জন্যই আমার
প্রিয় হল রক্ত;
হিন্দুর। মুসলমানের। খ্রিস্টানের।
অসমিয়া, বাঙালি, মারাঠির।
অথবা-
আপনার, আমার
আপনজনের…।
লাল হওয়ার জন্যই আমার প্রিয়
প্রতি ফোঁটা রক্ত;
প্রতি দেহ, প্রতি জীব।
রক্তের কোনো স্বার্থ থাকে না
রক্ত কোনো শ্রাদ্ধ পাতে না
রক্তের কোনো জাতি নেই
রক্ত কোনো ধর্ম-বর্ণ মানে না।
এখন
একগুচ্ছ গোলাপ, রক্ত জবা অথবা
প্রিয় সিঁদুরের চেয়েও আমার
অতি প্রিয়
রক্ত। কেবল-
যেখানে লেখা হয়
প্রেম ভ্রাতৃত্বের এক অঘোষিত দস্তাবেজ।।
দপদপ করে জ্বলতে থাকা আগুন
আর খড়িটার মধ্যে
প্রেম ছিল না বলে বললে ভুল করা হবে
খড়িটা জ্বলতে জ্বলতে
আগুনকে উজ্জীবিত করে, উত্তাপ বাড়িয়ে
আগুন খড়িটাকে ছাই করার পরে
আগুনের অস্তিত্ব শেষ হয়ে পড়ে
তথাপিও বাতাসে গন্ধ করতে থাকা মুখোশগুলি
তপ্ত ছাইয়ে উষ্ণতা নিয়েই ভালোবাসে ।
আজন্ম প্রেম!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন