একজন বিখ্যাত মূকাভিনেতার অন্তিম দিনগুলো  

পিটার ক্যারে



১.

 মূকাভিনেতা অভিব্যক্তি কুমারের হাতে ছোট একটি মেয়েলি হাতব্যাগ ছাড়া অন্য কোন 

লাগেজ না থাকায় সবাই অবাক হল। আলিতালিয়া এয়ারপোর্টে অভিব্যক্তি বা অভি’কে ঘিরে থাকা সাংবাদিকদের একজন ব্যাগে কি আছে জিগগেস করায় অভি তার বাদামি রঙের পার্সেল বা লাগেজের দিকে তাকিয়ে সাধারণভাবেই জানালো, ওই সামান্য দড়িদড়া আছে

-দড়ি? সে কী! কেন?

-আরো বড় কিছু বাঁধার জন্য!

অভি’র কথায় হেসে উঠল সবাই, অভি বুঝতে পারল না ওর কথায় হাসির কি আছে, তবে খুশিই হল!কারণ,ওর কাজ হাসানো নয়, ওর কাজ মূকাভিনয়ের সাহায্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা!যদিও তার এই নৈরাশ্যের আতঙ্কাভিনয় ইওরোপে খুবই চলছে তবে কেউ কেউ ভাবল এই দড়িদড়ার গল্পে হয়ত অভি তার ভবিষ্যৎ কাজের কোন ঈঙ্গিত দিতে চাইছে। অভি যেন কিছুটা আঁচ করেই রহস্য আরো বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই দড়িদড়ায় বাঁধা পড়ে আছে আমার প্রার্থনাগুলো, আমি তো এখন সবসময়েই প্রার্থনায় থাকি

সবাই অবাক হয়, মাথা নাড়ে

অভি অনিচ্ছুক ভাব দেখিয়ে তার লাগেজের ভেতরে থাকা নীল রঙের দড়িটি সাংবাদিকদের দেখায়। সেই তিপান্ন ইঞ্চির দড়ি আর অভি হিট করে যায়, সান্ধ্য-পত্রিকার প্রথম পাতায় চলে আসে তারা


২.

প্রথমে সত্যিই আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল! অভির মূকভানিয় যে এভাবে কাজ করবে এখানকার দর্শকদের মধ্যে এটা ও নিজেও ভাবেনি। কেউ কেউ তো চেয়ার ছেড়ে ভোঁ ভাঁ...পরে তারা ফিরে আসে স্নরকেল-ডাইভারদের মত সিক্ত মুখের মুখোস পরে, পরখ করে দেখে সেই ছেড়ে যাওয়া অডিটোরিয়ায়ম আগের মত আছে কী না!


৩.

অভি কিন্তু বিখ্যাত। তাকে নিয়ে তথ্যচিত্রও আছেআর বিখ্যাত বলেই সে বসে বসে ভাবছে,কোথায় গোলামালটা হল? সত্যিই কী সে আর আতঙ্কে স্পৃষ্ট করতে পারছে না তার দর্শকদের নাকি আতঙ্ক মূকাভিনয়ের মাধ্যমে এলেও একটি অনৈতিক কাজ? স্থানীয় কাগজের একজন সাংবাদিক তো এমনটাই লিখেছে....ভাবছে অভি, ভেবেই চলেছে...ভাবতে ভাবতে তার মনে হয়, হয়ত সাংবাদিকই ঠিক, দর্শকদের ভেতরে আতঙ্ক ছড়ানো কোন কাজের কথা নয়..তাহলে কি সে হাল্কা কিছু করবে, যাতে  হো-হো শব্দ হয়...হাসতে হাসতে হল থেকে বেরিয়ে আসে সন্তুষ্ট দর্শকরা....


৪.

বরাবরই বুকে দুরন্ত ঝড় তোলা মহিলারা অভির ঘনিষ্ঠ হতে চায়। তারা দামী সার্জনের মত বিছানায় অপারেট করে, তারা প্যাশনেট আর বুদ্ধিমান। তারা সহজে হারে না!


৫.

তবে কেউ কেউ ওকে ভুল বোঝে। ভালবাসার সময়েও নাকি মূকাভিনয় করে ও। এটা হয় না কী!একই কারণে অভিকে ঘৃণা করতে শুরু করা একটি মেয়েকে বলে ও, তুমি আমার সম্পর্কে যা বললে তা কিন্তু আমারই অনুকরণ...আমার মূকপ্রেমের অভিনয়ের অনুকরণ..তুমি আমায় স্রেফ নকল করছ, বুঝলে?                                                                              মেয়েটি বলে, তুমি হলে একটি মিচকে বেজন্মা...এবার বলো তোমার ওই লাগেজ না পার্সেল, ওতে কী আছে?                                                                                অভি হাল ছেড়ে দেয়, বলে, আগেই তো বলছি দড়ি আছে, আমার শো-এর জন্য                                 এবং অভি তার সেই পার্সেল খুলে দেখে মেয়েটি তার নীল রঙের সাধের দড়িটিকে, তার আতঙ্কের তিপান্ন ইঞ্চি লম্বাইকে প্রায় সমান সাইজের ডাঁটার মত কেটে রেখেছে, এবার চচ্চড়ি করলেই হয়!


৬.

সংগঠকদের কথা না শুনে অভি তার পরবর্তী দুটো শো কমিক রিলিফ হিসেবে করতে গিয়ে ব্যর্থ হল। সে ভয় দেখাতে জানে, আতঙ্ক ছড়াতে জানে, হাসাতে জানে না। অভি ভুল বুঝতে পারেড্যামেজ কন্ট্রোল করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয় সে আতঙ্কই ছড়াবে, তবে একটু অন্যভাবে

“দু ঘন্টার অনুশোচনা” এই নামের ‘শো’ ঘোষনা করে দেয় সে, টিকিট বিক্রি হয় হু হু করে। অভি প্রেমের আবহ তুলে ধীরে ধীরে এক জটিল মূকাভিনয়ের স্তর ভেদ করে সরে যায় তার অভিজ্ঞতাময় আতঙ্কের দিকে। সেই মারাত্মক ভয়াবহ আতঙ্ক যা দর্শককে সিঁটিয়ে দেবে, ত্রস্ত করে তুলবে! তাই হয়। সে যত অনুশোচনা থেকে একাকীত্ব হ’য়ে আতঙ্কের দিকে যেতে থাকে, দর্শক ভয় পায়, রক্তশূন্য হয় ভয়ে আবার এই আতঙ্কের স্বাদ দ্রুত নিতে থাকে। ভারতীয় রেস্তোঁরার ঝাল, মশলাদার খাদ্য যেভাবে সাহসী বিদেশি টুরিস্টরা খায় অনেকটা সেভাবে


৭.

এবারে মেয়েটি বলল, কি করছ তুমি এসব?আমার তো গা ঘিন-ঘিন করছে, মনে হচ্ছে কেউ নিজের বিকলাঙ্গ পায়ের প্রদর্শন করছে, যেভাবে বিকলাঙ্গ তুর্কি ভিখারিরা করে থাকে। ছিঃ! কিছুটা রেগে গেলেও অভি কিছু বলে না। মেয়েটির ব্যাখ্যায় সে বিচলিতও হয় না, সে এসব ভাবেনি এমন তো নয়। কিন্তু সে কী করতে পারে?আতঙ্কের শো-ম্যান সে, আতঙ্কর মার্কেটিংই সে এতদিন করে এসেছে। মেয়েটি অভির নীরবতাকে ওর প্রতি অবহেলাসূচক মনে করে একটি নিখুঁত ভুল বোঝাবুঝির দিকে এগিয়ে যায়। অভিকে আঘাত করার জন্যই ওর গালে সপাটে থাপ্পড় মারে।                                        আর..


৮.

আর সেই ছেঁড়া নীল দড়ির গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। তার বাদামি রঙের পার্সেল বা লাগেজের ক্ষুদ্র সংস্করণ গেটের মুখে বিক্রি হতে থাকেআতঙ্কের স্বাদ পাওয়া দর্শক আসতে থাকে, আসতেই থাকে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভি শুনতে পায় অজস্র হাতের চাপে বাদামি রঙের ছোট ছোট পার্সেল বা প্যাকেটগুলি ছিন্ন হচ্ছে, ফেটে যাচ্ছে!এই শব্দে তার কেন জানি হঠাৎ মনে পড়ে যায় আচম্বিত শব্দের মাঝে আমেরিকান মেট্রনদের মুসলিম প্রার্থনা-পতাকা কেনার কথা


৯.

অভি খুব মনযোগ দিয়ে অ্যাশট্রেতে সিগারেটটা পিষে ফেলছিল। ভয় পেয়ে গেছে ও। পালিয়ে এসেছে এই মোটেলের নির্জনতায়এয়ারকন্ডিশনারের শব্দে নিমজ্জিত হতে হতে অভি বুঝতে পারে ওর আতঙ্কের ভাঁড়ার শেষ হয়ে আসছে। ও এখন ক্লান্ত, রিক্ত। নতুন আতঙ্কের মূকাভিনয় চাইছে আতঙ্কে অভ্যস্ত দর্শকরা। অভির সেই ক্ষমতা আর নেইসে নিয়ন্ত্রিত আতঙ্কের ফেরিওয়ালা, তার ঝুলিতে এর বেশি আর কিছুই নেই। সেই কবে থেকে সে ভয় দেখাচ্ছে, দেখতে দেখতে ভয় আর ভয় হয়ে নেই,সয়ে গেছে দর্শক নতুন কিছু চায়।নতুন ভয়,নতুন আতঙ্ক!হতাশ অভি তার পার্সেল খুলে টুকরো করা নীল দড়িগুলোকে টয়লেটে নিয়ে ফ্ল্যাশ করে দেয়। জলের তোড়ে দাড়িগুলো চলে না গিয়ে ভাসতে থাকে কমোডের ভেতরে, সমুদ্রে যেভাবে ভাসে বয়ে আসা দলা পাকানো আবর্জনা


১০

অভি সাংবাদিক সম্মেলন ডাকে। সাংবাদিকদের বলে, অনেক হয়েছে, আর নয়। সে অবসর নিচ্ছে...একটি মুখেও কোন উৎসাহ খুঁজে পায়না অভি, তাকে ম্রিয়মান দেখায়, ছোট্ট দেখায়, রসুন-রঙা হতে থাকে সে ফ্যাকাশে হওয়ার বদলে...সাংবাদিকদের অভি জানায় তার এই মূকাভিনয় এই মুহূর্ত থেকে জনগনের সম্পত্তি, সে আজীবন তাদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে, যে কোন প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে দ্বিধা করবে না....বলার সময় গলায় জোর পায়না...সাংবাদিকরাও নিরুত্তাপ...তার বিদায় ঘোষনায় কোন নাটকীয়তা নেই,উত্তেজনা নেই। সে বসে থাকে চলন্ত গাড়ির পেছনে রাখা ফারের অবনত ম্যাসকটের মত!


১১.

তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, মৃত্যু মানে কী? সে উত্তর না দিয়ে ক্যামেরায় ছবি তুলতে থাকল প্রশ্ন-করিয়েদের


১২.

কে যেন বিয়ে ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করায় সে তিউনিসিয়ায় বানানো সস্তার আয়না বের করে দেখাতে লাগল


১৩.

আভি বুঝতে পারছে সে আর জনপ্রিয় নয়। সে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে দর্শকদের কাছে। তার কাছে আর কোন আতঙ্কের বিস্ময় নেই। সে সাংবাদিকদের কাছে সহজ প্রশ্ন চাইছিল, তার  কাছে সত্যিই কাউকে খুশি করার মত কোন সঠিক উত্তর ছিল না

 

১৪.

তাকে প্রশ্ন করা হল, এরোপ্লেন নিয়ে। সে উত্তর না দিয়ে আকাশে তিনপাক চক্কর দিয়ে ল্যান্ডিং-এর সময় আহত হল


১৫.

নদী কাকে বলে? ওই নদীর জলেই ডুব দিল সে, উত্তর না দিয়ে


১৬.

আশ্চর্য আজ অভির ফিল্ম তোলা হচ্ছে, এই দৃশ্যে সে এগিয়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। ধূসর স্যুট। নিখুঁত, কামানো গাল, ছোটখাটো চেহারা। এগোচ্ছে অভি, জনা তিরিশেক দর্শকের ভিড় ঠেলে। এর মধ্যে কিছু বাচ্চাও আছে যারা একটা প্লাস্টিকের খেলনাজাতীয় কুকুর নিয়ে খেলে যাচ্ছে। অভি এগোচ্ছে। রোল করছে ক্যামেরা। অথচ কোথাও কোন আতঙ্ক নেই, সবাই জানে মূকাভিনেতার কাছে আর আতঙ্ক পাওয়া যাবে না, তবু এই ছোট ভিড়টা আছে এখনো। অভি এগিয়ে যাচ্ছে নদীর দিকে, পাথেকেই যা অনেকটা গভীর। অনেকে ভাবছে এটা বোধহয় নতুন কোন আতঙ্কের খেলা, নদীর জলে এবার অভি আতঙ্ক নিয়ে আসবে....অভিব্যক্তি কুমার নদীতে নেমে গেল...গলা অব্দি দেখা যাচ্ছে এখন...এবার পুরোটাই জলের তলায়...এক কনস্টেবল তাকিয়ে আছে অভির পুনরুত্থানে হাততালি দেবে বলে...কিন্তু কেউ উঠছে না...ধীরে ধীরে নিস্তরঙ্গ হয়ে যাচ্ছে নদীর জল...

অভিব্যক্তি কুমার আর উঠল না!

এই শেষ-শো যারা দেখছিল তারা ছিল শুধুই দর্শক, আবেগহীন। তারা অভিব্যক্তির কাছে কিছুই চাইছিল না। অথচ  বছরের পর বছর এই মানুষটাই তার দর্শকদের আলোড়িত করে দিত, আতঙ্কে বাকরুদ্ধ করে দিত...কী ভাবে? এই বিস্ময়টাই কি থেকে গেল শেষ পর্যন্ত...


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন