মন্থর হয়ে যাওয়া

মূল লেখক : সামান্তা শোয়েবলিন

অনুসৃজন : সুদীপ বসু


  তেগো নিজের জন্যে ডিম ভেজেছিল। কিন্তু টেবিলে যখন খেতে বসল দেখলাম একদৃষ্টে প্লেটের 

দিকে তাকিয়ে আছে। খেতে পারছে না। 

বললাম, 'কী হল তেগো?'

সে প্রথমেই কিছু বললো না

তারপর বললো 'খুব চিন্তা হচ্ছে। বোধহয় খুব স্লো হয়ে যাচ্ছি।'

সে অকারণে তার দুটো হাত এপাশ-ওপাশ করতে লাগলো আর আমার দিকে বারবার ঘুরেঘুরে তাকাতে লাগলো। যেন আমার কাছে কোনও উত্তরের অপেক্ষা করছে।

'তুমি যে কী বলছো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না' আমি বললাম, 'আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।'

'তুমি লক্ষ্য করোনি ফোন ধরতে আমার কতক্ষণ লাগছে। অথবা দরজা খুলতে কিম্বা একগ্লাস জল খেতে দাঁত মাজতে... খুব কষ্ট হচ্ছে।'


একটা সময় ছিল যখন তেগো ঘণ্টায় তিরিশ মাইল বেগে উড়ে যেতে পারত। সার্কাসের তাঁবুটা ছিল আকাশ। ক্যাননটা টেনে নিয়ে যেতাম রিঙের মাঝখানে। তীব্র আলো দর্শকদের আড়াল করে রাখতো  কিন্তু আমি তাদের গর্জন শুনতে পেতাম। ভেলভেটের পর্দা সরে যেত। রুপোলি হেলমেট পরে তেগো এসে দাঁড়াতো। সে উত্তাল দর্শদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়াতো। রিঙের বালির উপর তার লাল স্যুট ঝলমল করে উঠতো। তেগো উঠে যেত উপরে। ওর রোগা শরীরটা নিয়ে ক্যাননের ভেতর সেঁধিয়ে যেত। 


আমি পাউডারটা প্রস্তুত রাখতাম। অর্কেস্ট্রা থমকে যেত আর তারপর পুরো খেলাটাই চলে আসতো আমার হাতে। চারদিক থমথমমে। শুধু মাঝেমাঝে পপকর্নের প্যাকেটের আওয়াজ আর কাশির শব্দ। আমি পকেট থেকে ঝলমলে (যাতে দূর থেকেও চোখে পড়ে) দেশলাই-বাক্সটা বার করতাম। বাক্স খুলে, একটা দেশলাই কাঠি বার করে বাক্সের গায়ে লাগানো বারুদের ওপর রাখতাম। সব চোখ তখন আমার দিকে, হঠাৎ জ্বলে উঠতো আগুন।  অগ্নিস্ফূলিঙ্গের শব্দ চিড়চিড় করে ছড়িয়ে পড়তো চারদিকে। আমিও নাটকীয়ভাবে কয়েকপা পিছিয়ে আসতাম যেন মারাত্মক কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ভয়ে বোবা হয়ে যেত দর্শকরা —তারপর হঠাৎ... 'বু—উ—ম্'... তেগো তীর বেগে বেরিয়ে আসতো ক্যাননের ভেতর থেকে। 


তেগো ডিম ভাজার প্লেটটা সরিয়ে রেখে অতি কষ্টে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। এখন তার বয়স অনেক বেড়েছে, মোটা হয়ে গেছে। সে এখন খুব কষ্ট করে জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়। যেন শিরদাঁড়া চাপ দিচ্ছে লাঙসে। মাঝে মাঝে তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে আজ নিঃশব্দে সে রান্না ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো।


'আমি খুব স্লো হয়ে যাচ্ছি।' সে বললো। ডিম ভাজার প্লেটের দিকে তাকালো।


'মনে হচ্ছে আমার সময় শেষ হয়ে আসছে।' 

আমি প্লেটটা আমার দিকে টেনে নিলাম। আমি জানতাম এবার সে রেগে কাঁই হয়ে যাবে।

হল না। তেগো বলে উঠলো, 'এরমটাই হয় যখন, যে কাজটা তুমি ভালো করতে পারো, সেটা আর করতে পারছো না। তারপর তুমি মরে যাও।'

আমি ডিম ভাজায় কামড় দিলাম। ঠান্ডা হয়ে গেছে। তেগোর সঙ্গে এই আমার শেষ কথাবার্তা। এরপর বসার ঘরের দিকে সে সবেমাত্র দু-তিন পা টলতে টলতে এগিয়েছে, হঠাৎ হুড়মুড় করে পড়ে গেল। 


কয়েকদিন বাদে একটি স্থানীয় সংবাদপত্রের জার্নালিস্ট আমাকে ইন্টারভিউ করতে এলো।  একটা ফটো, রুপোলি হেলমেট আর লাল স্যুটে তেগো আর তার পাশে দেশলাই-বাক্স হাতে নীল স্যুটে আমি —তার নীচে সই করলাম জার্নালিস্ট মেয়েটি তেগোর সম্বন্ধে আরও কিছু কথা জানতে চাইল। ওর মৃত্যুর সম্বন্ধে। কিন্তু আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। মেয়েটি তবু বসে রইলো।

'কফি খাও?' আমি জিজ্ঞেস করলাম।

'ও। হ্যাঁ' মেয়েটি বললো।

মনে হল সে আমার কাছ থেকে আরও অনেক অনেক কিছু জানতে চায়। 

আমি রুপোলি দেশলাই-বাক্সটার বারুদের গায়ে কাঠি ঠুকে স্টোভ জ্বালাতে গেলাম। জ্বললো না।

আজ আগুন আর কিছুতেই জ্বললো না।





পরিচিতি:

সামান্তা শোয়েবলিন

জন্ম: ১৯৭৮। আর্হেন্তিনায় বুয়েন্স এয়ার্স শহরে। মুলত ছোট গল্পকার এবং অবশ্যই অন্য  ঘরানার। এখনও পর্যন্ত প্রকাশ পেয়েছে তিনটি গল্প সংকলন, একটি উপন্যাসিকা ও একটি উপন্যাস। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'ফিভার ড্রিমস' ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজের জন্য '২০১৭' সালে শর্টলিস্টেড ছিল। তাঁর গল্প 'দ্য নিউইয়রর্কার' 'গ্রান্টা' 'হারপার্স' ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। পেয়েছেন 'ন্যাশানাল বুক অ্যওয়ার্ড ফর ট্রান্সলেটেড লিটারেচার।' অনুদিত গল্পটি তাঁর 'মাউথফুল অফ বার্ডস' বইটি থেকে নেওয়া। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন