কী যেন বলতে চাওয়ার ঘূর্ণি সাবেকের পা ছুঁয়ে একলা হয়ে যেতে চেয়েছিল
তুমি তার আষ্ঠেপৃষ্ঠে সম্পর্কের পশরা সাজিয়ে দিলে
তুমি তার টুংটাং নিয়ে অনেক তলের স্থির নিরবধি লক্ষ করে যাচ্ছিলে
তুমি তার ঘাগড়ার নীচে বসন্ত বনের কয়েকটি ফুলের ফুটতে থাকায় অনুঘটক
ফিরতে পারছিলে না আর বিকেলবেলার ফুটনোটে
ঝঞ্ঝা নিজস্ব ভঙ্গিতে জুড়িয়ে যাচ্ছিল যৌনক্রমে...

শৌখিন ফুটে উঠবে দূরের বসার ঘরে, আলোর কিসমিস ঘিরে পতঙ্গ ঠোঁট
কোনো এক প্রাচীন কিস্যার গা থেকে খুলে-খুলে পড়বে নিকানো ডাঙা
পথের প্রায় অন্তে এসেও বাদামি বরফ ভুলে যাবে অভিসার
তুমি তার ভূমি আমূল নাড়িয়ে বাঁকানো হাতের আঙুল নাড়াবে
প্রিয়-কে প্রিয়তম করতে আর কোনও উপাদান সেভাবে ছিল না
ডুবে যাওয়ার আগে বরফে ঘূর্ণির রং আমরা অনেকেই দেখে যেতে থাকব...

রোদ উঠেছিল বেশ। শীতটাকে মাখো-মাখো করে রাখছিল। আমেজ নিজেই চা বানিয়ে দিয়েছিল সাতসকালে। বাইরের কাঠখোট্টা বারান্দাটাকে কাশ্মীর বানিয়ে দিয়েছিল দুটো লেজঝোলা। তাদের কিচির মিচির মেশানো হালকা বাতাস দখিনা সমীরণ হতে চাইছিল। এই চাওয়াটাই একটা নেশার উপকরণ। আমি মোহিত হব কি হব-না ভাবতে ভাবতে দরজায় বেল। নিশ্চিত আজকের খবরের কাগজ। একদম ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল জানালা টা। বাইরের বারান্দার গায়ে জলপ্রপাতের মত ওটা ঝুলছিল। আমি কি উঠে যাব? নাকি রোদের রিডগুলোতে নিজেকে সা-রে-গা-মা করে রাখব? নাকি কল্পিত কোনো চন্দ্রমল্লিকার টবে, কী জিনিয়ার টবে বিন্দু-বিন্দু জল পড়ার ব্যবস্থা করব? আমার বাড়িতে তো কোনও ফুলগাছ নেই। বারান্দায় বসে অবশ্য একটু নিচু করে চোখ রাখলে পাশের বাড়ির ফাঁকটাতে ফুল ফুটে থাকে। বড়ো যত্ন করে এক বৃদ্ধ। ফুল ফোটানোর মত মুখটা তাঁর। মাঝে-মাঝে বৃদ্ধাও আসেন নিড়ানি হাতে। মাটিতে টবে গাছ বাড়তে থাকে, ফুল ফুটতে থাকে।
খবরের কাগজটা জারজ শালা। মাথা আছে তো ধড় নাই। ধড় আছে তো মুন্ডুহীন। ছারপোকায় পেচ্ছাপ করে রেখেছে। মশাদের বীর্যপাতে লাস্য। ৫৭ ধর্ষণ, ১১৩ কেপমারি, ৬৪ রাহাজানি। ১২ দলবদল, ১৩ খুন, ১৪৪ সীমান্তে পাচার। ১৭ আর্থিক ঘোটালা, জড়িয়ে কয়েক লক্ষ কোটি। রাজনীতির নেংটি ইঁদুর দাঁতে কেটেছে দিস্তা কাগজ। খেলায় মাল ছড়ানো, সিনেমায় মাল ছড়ানো, মালামাল বিজ্ঞাপন। তবু রোজ আসে রোজ কুঁতকুঁতে চোখ গোল হয়ে ঘোরে। সকালবেলার শীতেরও একবার মৈথুনে প্রবৃত্তি হয়। সবকিছু দুমড়ে পিচ্ছিল দুপুরের যোনিতে গমন করতে চায়।
বলতে চাওয়াগুলি জড়িয়ে জড়িয়ে ওঠে বাস্পাকারে। গুম মেরে থাকে। হালকা মেঘ ঘন হতে থাকে। যুদ্ধযাত্রা প্রস্তুত। ঘূর্ণি ঘুলিয়ে ওঠে। বলতে চাওয়াগুলি ঝাপটাতে থাকে। আছাড়-পিছাড় খায়। সবকিছু টালমাটাল করে ভেঙেচুড়ে সর্বনাশের গোড়ালি নড়িয়ে মাথাকে বনবন করে ঘোরাতে থাকে। আমি কি পড়ে যাব? এই বিপাকে কাৎ হয়ে পড়ব কলাগাছের মতো? নাকি এক দমকা বাতাস আমাকে উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে কোনো অস্তিত্বহীনতায়? আমি কী? আমি কেন? এসব এখন আর খুব জরুরি মনে হচ্ছে না। শুধু জানার ইচ্ছে আমি ঠিক কোথায়? একটা সামান্য স্থান, একটা কয়েক ফুট, একটু পায়ের নীচে মাটি হোক পাথর হোক বালি হোক কিছু হোক, আছে তো? সংশয়, আছে তো? একা হয়ে যাই বুঝি! একা, একা। এই ঘূর্ণিটাই আমাকে একা বানিয়ে ছাড়ল। আমার ভূগোলে নিয়ে এল এক বিরাট  পরিবর্তন। এক সময় আমি আর ঘূর্ণি সমার্থক হয়ে উঠলাম। সেও কেমন একা হয়ে গেল। শীতের রোদ আমেজ ভেতরে ঢুকে ঘূর্ণি আর তাতেই একা।
সিগারেট আমায় মাঝে-মাঝে উদ্ধার করে। খাদের কাছ থেকে বাঁচিয়ে দেয়। এখন তার স্মরণ নেওয়া যেতে পারে। শীত-রোদের আমেজের পরও আমার আরেক ধরনের একটা আমেজ চাই। এর পরপরই আসবে রান্নার মাসি। আসবে কাজ করার মেয়ে। আমাকে তাদের সঙ্গেই কাটাতে হবে দু-দন্ড। নিত্যকার জাবর কাটার মরশুম। এই গতানুগতিকতার মধ্যে কি কোনও প্রেম আছে? আছে কি যৌনতা? শুধু অভ্যাসের খড়কুটো জাপটে ধরে ভেসে ভেসে চলা। চাল নেই? আনতে হবে। লবণও কি বাড়ন্ত? সব্জীতে বেশি নুন দিও না। প্রেসার বেড়ে যাবে। নুর, ঘরের কোণাগুলোতে কী ধুলো কী ধুলো! পরিস্কার করে নিও। আর ঝুল বাড়িময়। ওরা শুধুই আমার নিশ্বাসে ঢুকে পড়ে। ঝুলঝাড়াটা কি ফতুর হয়েছে?
তার চেয়ে এইতো এই রোদের আমেজে, এই ঘন মেঘ ঘূর্ণির মধ্যে বেশ আছি। থাকুক না সেখানে বলতে চাওয়ার আকূতি। নাহয় বলতেই পারলাম না। আছাড়ি-পিছাড়ি খেলাম। উড়তে লাগলাম, কল্প যৌনতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকলাম, পাশের বাড়ির ফুল দেখতে দেখতে মাম হয়ে গেলাম।
এসব ঠারে-ঠোরে কথা বলার জন্য কবিতা লেখা হয় নাকি? যাচ্চলে। আমি তো ভাবছিলাম তোমার কথা। তুমি এবং মৈথুন। মৈথুন আর তুমি। তুমি সর্বনাম। মৈথুন ক্রিয়া। তো তোমার চারপাশটা খুব সাজানো গোছানো। তুমি নিজেও সাজানো। তুমি মানে একটা সম্পর্ক। গুছিয়ে তোলা একটা জীবনের সুখি সুখি ভাব। আমি সর্বনামের ওপর ক্রিয়া বসাতে কোনও উদ্যোগ নিই না। কেন? কেন? আবার ঝাপট। সুখি ভাবটা ছিঁড়ে খুঁড়ে যাবে এই ভয়ে। নাকি আরও সুখ আমার সইবে না? এ আমি কোথায়? কিসের জন্য সেই থেকে বসে আছি? কোথা থেকে কোথায়ই বা যাওয়া যেতে পারে? দহন শুরু হবে কি এখান থেকেই। হোক তবে। পুড়তে পুড়তে ছিলা টান রেখে যাব।
আমার একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে আমি মনে করি। আর তাতেই স্মৃতি দুলে দুলে আসে। স্মৃতিই কি ইতিহাস? এমত প্রশ্নে আমি তোমার দিকেই ফিরে তাকাতে পারি! তুমি আর আমি কি আলাদা অস্তিত্ব? আবারও প্রশ্ন? এত প্রশ্ন কেন? আমি সাকার, তুমি নিরাকার। তোমাকে আমিই বানাই শত ফুলে সহস্র ভঙ্গিমায়। তোমাকে সুন্দর থেকে সুন্দরতর করতে করতে পথ হাঁটি, দৌড়াই। নিজের রসস্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে চলি অন্য কোথাও। নিজের আনন্দে তোমাকে পাগল করি। তুমি অনায়াসে হাত মেলে দাও। টোয়ে ভর দিয়ে দাঁড়াও নতুন বিভঙ্গে। তোমার চুল উড়তে থাকে। ঠোঁটদুটো সামান্য ফাঁকা। চোখ মৃদু খোলা। তোমার স্তনভারে তুমি সামান্য ঝুঁকে। নাভীতে মন্ডলাকার তারা ফুটে আছে। তুমি সমর্পণের সমস্ত উপকরণ সাজিয়ে নির্নিমেষ আমার দিকে। আমি যৌনতায় মুগ্ধ হয়ে পড়ি, হয়ে পড়ি মূঢ়। যেন তোমাতে গমন এক অবধারিত প্রক্রিয়া। আমি তোমাতেই লীন হই, তুমি আমাতে। আমাদের আলাদা অস্তিত্ব কষ্টকল্পনা। 
পুরোনো গল্প ঘুমোতে জানে না। সে তার শরীর থেকে গয়না খোলার মতই নিত্য নতুন ডাঙা দেখায়। সেই ডাঙার ভূগোলে এমনই মহিমা যে আমাদের শরীরে রোমাঞ্চ জাগে। আমাদের ভ্রমণ তার প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি চিহ্নে। বর্ণনাতীত এক ভ্রমণে আমরা পাল্টে-পাল্টে যাই। নিজেকেই অচেনা মনে হয়। তখনও তুমি আমার মধ্যেই আসীন। আমি তোমাকে ঘর দেখাই দরজা দেখাই ঘুলঘুলি দেখাই। আমি তোমাকে আড়াল দেখাই অজানা শোনাই জানা গানের দু-চার কলিতে তুমি ঘুমিয়ে পড়। আর আমি তোমার মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে কখন নিজের চুলেই বিলি কেটে যাই। এই ডাঙা-ডাঙা খেলা চলতেই থাকে। আমি তার মোহে আর মস্তিতে বিহ্বল হতে থাকি। আমার জানালা খুলতে থাকে, আমার ঘুলঘুলিগুলো আকাশ হয়ে যায়। এই বিশাল আকাশের নীচে আমি তোমাকে নিয়ে একজন হয়ে থাকি। আমার চোখ থেকে এবারে জল এলে আমি তোমাতেই নিমজ্জিত হই।
অভিসার। হাঁটছি আমি। আমার ভেতরে হাঁটছে আরেকজন। চিহ্নিত স্থানে পৌঁছুতে হবে। নয়ত মিলন হবে না। কার সঙ্গে কার মিলন? আমার সঙ্গে আমার। আমার বাইরের সঙ্গে আমার বাইরের। আমার ভেতরের সঙ্গে আমার ভেতরের। আমার বাইরের সঙ্গে আমার ভেতরের। আমার ভেতরের সঙ্গে আমারই বাইরের। এত আশা এত শ্রম এত আকাঙ্খা। মনে হয় এই বুঝি পথ শেষ হয়ে এল। এবার মধুর মিলন। কিন্তু কই! শেষ হয়েও হয় না যে। চিহ্নের নামগন্ধ নেই। আবার কিছু অণুচিহ্ন দেখিয়ে সে সরে গেছে অন্তরালে। জল শেষ হয়ে বরফ। বরফের ঘনত্ব বেড়ে বেড়ে তার রঙ পালটে যায় বুঝি। বাদামি হয়ে ওঠে। যেন রক্ত লেগেছে। অভিসার ভুলে যেতে হবে এইবার।
এই চরম ঠান্ডায় আবার বুঝি সেই ঘূর্ণি ফিরে আসে। অবাক। কিন্তু ঘুরে আসে। আমি তার পদচারণা শুনতে পাই। আমি তার লাস্যে ছড়িয়ে পড়া দেখতে পাই। আমি তার অনুরণন অনুভব করি মর্মে মর্মে। আমি কোথা থেকে শুরু করেছিলাম ভুলে যাই, কোথায় রয়েছি অনুমানেও আসে না, কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারি স্রেফ জানিনা, জানিনা। তবু একটা অস্তিত্ব। যে বয়ে চলেছে তারই ভেতর আরেকটা অস্তিত্ব। সে হয়তো আরেক আমি কিংবা তুমি যা আমারই প্রতিফলন। এই চক্রাকারে ঘূর্নির উপর থেকে আরও উপরে উঠে যাওয়ার মধ্যে আমি মিশে আছি। ঘুরছি বনবন করে। আর দেখছি বরফের রং কেমন পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। আমি আমাতেই মৈথুনে প্রবৃত্ত হই। খবেরর কাগজটা নাকের সামনে দুলতে থাকে। অসার। সে তো সামান্য কয়েকটা ঘটনা মাত্র। আমি ঘটনাতীত হতে থাকি।
(নিজের একটি কবিতা নিয়ে এই কথকতা)
জানুয়ারি- ২০১৫

(‘রিলেদৌড়ের অনিঃশেষ গদ্যগ্রন্থে সংকলিত)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন