কতলার ফ্ল্যাটে ঝগড়ার আওয়াজ দোতলায় এসে পৌঁছচ্ছে বিশদে। জলের পাম্পও সেখানেই। ছাদে ট্যাঙ্ক ভ'রে জল নিচে পড়ছে। তার আওয়াজও এসে পৌঁছচ্ছে। আর সবটার মধ্যে মিশে যাচ্ছে চারতলার কিশোরীর শিক্ষার্থী গলার ভজন। তিনতলায় শব্দ নেই। সবার মাথার উপরে শূন্য। বাড়ি যত উঁচু হয় শূন্য সেইমতো পিছিয়ে যায়। প্লেন গেলে বা মেঘ ডাকলে জানতে পারে নির্বিশেষ সব তলাই। মোবাইল চালু করতে ভুল হয়ে যায় আমার প্রায়ই। ফলে প্রতীক, ধীমানের ছেলে, ঠিকঠাক বাড়ির আন্দাজ পাচ্ছে না। রাস্তা থেকেই চেঁচিয়ে ডাকবে কিনা যে কোন উদ্দেশে, ভাবছে। তার হাতে খাম। খামে কবিতা। শব্দ দিয়ে গড়া।

মনে করি, যেসব গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিলাম। মল্লেশ্বর গোয়ালপাড়া রাজনন্দগাঁও কিম্বা কিরগুল। মনে করি নাকি মনে পড়ে। আমাদের বেসমেন্ট নেই। ভিত ও গাঁথনি। শিকড় নেই। টিএমটি রড। মনে পড়ে চারার নিচে ফিনফিনে সূতোগুলিকে। ঝড়ে উপড়ে পড়া অশ্বত্থের নিচে অজস্র সরু মোটা আঙুল। একটি গাছের ভদ্রাসনের শুরুটা। প্রতীকের হাতের খাম। ডাকের শুরুটা। শিকড়ের পাশ দিয়েই উঠে জল চলে যাচ্ছে ট্যাঙ্কে। আবার ফিরে যাচ্ছে একতলায়, খালে, শূন্যে। রোদ আছে কিম্বা নেই।

নদী পলি রেখে যায়। নদী জানে না। আমরা বলি। নদী যে জানে না সে কথাও আমাদেরই। ভাটায় তখন চিমনীগুলো ধোঁয়ামুখর আর দশ বিশ মানুষের হাতে মাথায় চুল্লিতে এবং চারপাশে নাবালক এবং সাবালক ইট। আমাদের ইট এসেছিল বিদ্যা সিং-এর গোলা থেকে। সেসব লুকিয়ে রয়েছে নানা পলেস্তারা ও রঙের আড়ালে। বিদ্যা সিং-এর কড়া মালিকানা থেকে রামপরবেশের মাটিমাখা আঙুল। পলিমাটি থেকে ভাট্টির ধকধক করা আগুন। চিমনির ধোঁয়া থেকে কামিনের মাথার বিড়ে। সব মিলিয়ে এক একটা ইট। বাড়ির মৌলিক শরীরের প্রোটন নিউট্রন। সে কি প্রান্তিক স্টেশন। তাহলে ওই ঝগড়া, ভজন, জল পড়ে যাওয়া, এরা কারা। তিনতলায় সদ্য আসা বাচ্চাটি আজ স্কুলের গাড়িতে উঠছে প্রথমবার। চারতলার সান্যাল বাবুর ফুরনো দিন, কাচঢাকা গাড়িতে কবেই মিলিয়ে গেছে দূরে। বাতাসভরা শোকের অগুরু, সেই বা কোথায়। কেবল ফ্ল্যাটের ভিতরে যত ফ্ল্যাট, তাকে ঘিরে যেসব, তারা দৃশ্যে নেই, মিশে আছে রূপে রূপান্তরে আর অরূপে।

মোবাইলে ক্যামেরা থাকায় খুবই সুবিধে হয় আজকাল। টানেলের পর টানেল। ঝর্ণা। জঙ্গল পাহাড় এবং শুভ দীপাবলী। পাহাড়ের গা থেকে ৫০০ ফুট গভীরে গুহায় পাথরে পাথরে প্রকৃতির নিজস্ব আর্ট গ্যালারী। তার গায়ে দাঁড়িয়ে নিজেরই ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ চারপাশ শূন্য হয়ে যায়। যেন কতকাল থেকে এখানেই বসবাস। প্রাগৈতিহাসিক কোন পদ্ধতিতে এসব মূর্তি গড়ে তোলা। গুহার বাইরের বনজঙ্গলে ফলমূল পাখি ঝর্ণা আর রাতে গুহামুখে জ্বালানো আগুন। আগুন এক ধারাবাহিক। শরীর মন চকমকি উনুন দাবানল। জলও। উপচানো ট্যাঙ্ক থেকে চিত্রকূট এবং অক্ষরের কালজানি পুনর্নবা। থাকতে থাকতে মনে হয় বাড়িই তো। একতলা বা বেসমেন্ট, ছাদ এবং আকাশ সবই তো। তাদের কারও হাতে খাম। খামে কবিতা। কবিকে খুঁজছে।

নিত্য এবং নিমিত্তের দেওয়াল খাট আলনায় ঘুরতে ঘুরতে চোখ ঘড়িতে যায়, সময়ে। চমকে উঠে লজ্জা পাই, রাগ হয় নিজের উপর। তাড়াতাড়ি চালু করি মোবাইল। ৬ নম্বর মিসড্ কলের পর ৭ নম্বরটি ঢুকে পড়ে। ধীমান। আরে, ফোন বন্ধ করে বসে আছিস। আমার ছেলেটা তোর বাড়ি খুঁজে পাবে কি করে।। ওর কাজের জায়গায় অ্যাবসেন্ট হয়ে যাবে যে। দ্রুত পায়ে ঘরের দরজা বারান্দা সিঁড়ি এতসব নির্মিতি পেরিয়ে, কথা, জল ও হারমোনিয়ামের মিশ্র কলাবৃত্ত পেরিয়ে নিজেই বেরিয়ে পড়ি। খামটিকে খুঁজে পেতে। কল করি, হ্যালো প্রতীক, হ্যালো, শুনতে পাচ্ছিস।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন