পড়ার পাশে পাশেই অবিকল দেখা ও ছোঁয়ার প্ররোচনা জ্বেলে মাথার পাশেই সম্পর্কের তীব্র এক বালিশ হয়ে রয়ে যান কোনো কবি বা তাঁদের কিছু বই। এতই ভারী যে কিছুতেই নাড়ানো যায় না। নিষ্ঠুরতা ঢেলেও তোলা যায় না বইয়ের তাকে। তাদের আদর ওঠে। আদর খাই। কোলেপিঠে করি। গুপ্তমন্থন। গুহ্যসোহাগ। এক মানসপ্রান্তর থেকে আর এক মনাঞ্চলে নিয়ত কণার অভিসার। ক্ষত থেকে ক্ষতের শিশিরে। মুণ্ড থেকে মুণ্ডে চলা প্রাচীন জোনাকি। ধাতুভস্ম। প্রাত্যহিকের নানা সংঘাতেও তাদের অবস্থান ধাতুর শক্ত পাতে লোহার কীলের মতই অবধারিত। একরোখা। অনড়। বরং এক মেরুদণ্ডের সাথে আর এক মেরুদণ্ডের যুগলবন্দিতে অমার ভেতর চাঁদের উদয়। এই আত্মমেহনে তাঁরা সেতুর খরশান হয়ে, চিরাগের সুপ্তমেদুর হয়ে, কালকে ঘুলিয়ে দেওয়া জাদুজানলা। ইন্ধনের কারখানা খুলে বসে। কবি জহর সেনমজুমদার সেই দুর্ঘটেরই অন্যতম নাম।
বাংলা কবিতার এই কালখণ্ডে কবি জহর সেনমজুমদার এক স্বতন্ত্র মেরুর গ্রন্থিবীজ। পুরাণ মহাকাব্য আর চর্যাপদের অপার রহস্য কিংবা লোকজীবনের মৃত্তিকাভেদী তন্ত্র বা আউলবাউল ফকিরদরবেশের দেহতাত্ত্বিক জাদুবাস্তবতা- এই বহুধাপ্লাবী স্রোতস্বিনীকে পরাবাস্তবতার গোচরহীন রজ্জুতে জুড়ে বাংলা কবিতাকে এক অপূর্বকল্পিত প্রজ্ঞায় জারিত করলেন। এক আত্মগোপনক্ষম কালবৃত্তে উড়ে উড়ে তিনি নশ্বর-অবিনশ্বর ক্ষণকাল-চিরকালের চেতনাবীজকে উপ্ত করে গেলেন তাঁর কবিতায়। মাতৃভক্ত হেসেলাপ, কখনো তৃষ্ণিত ময়ূর হয়ে লিখে গেলেন দেশকাল মানজীবনের নিরবচ্ছিন্ন ইথারকথন। বাস্তব পরাবাস্তব আর অন্তর্বাস্তবের ত্রিবিধ জগতে সুতো ছেড়ে নিপুণ প্রাচীন ঘুড়িয়াল, কখনও প্রত্যক্ষকে আনলেন অপ্রত্যক্ষে আবার নিমেষে গোঁত মেরে ফিরে গেলেন অপ্রত্যক্ষ থেকে প্রত্যক্ষের সীমায়। বাংলা কবিতা বিশ্লিষ্ট হল অকল্পিত পরমের দিকে। তাঁর হাতে। তাঁর মহাপ্রেক্ষায়। যা আমাদের নিবিড় তাপে সেই গ্রন্থসূত্র আন্দোলিত হতে হতে তাঁর সুপ্ত তপাশ্চর্যই ক্রমে খুলে খুলে যায়।
বিপুলকালের ভেতর জহরের অন্তহীন পরিব্রাজকতা তার অধীতকে দিয়েছে এক মহাবিস্ময়ের তেপায়া কাঠের বাড়ি। এই ঘুলঘুলি থেকে ছোঁ মেরে ঢুকে মুহূর্তে দরজায়। আবার জানলা থেকে কাগুজে-হাওয়ায় উড়ে চিরায়ত জগজ্জননীর মুখোমুখি। আর্তি আর প্রার্থনা নিয়ে বহুরৈখিক জহর অন্ধকারের দাঁড়ে বসে জগজ্জননীর সাথে অন্ধনিবিড় বাক্যালাপ করে চলেছেন। আর উপস্থাপিত করছেন আজকের রক্তস্নাত বাস্তবতা।
তাঁর এই বিবিধ জাদুকরী আর তার বিহ্বল করা বর্ণচ্ছাটায়, কখনওবা তাঁর যৌন-ভবচক্রের সম্মোহনে আমাদের ছিপনৌকো সচরাচর তীরে ওঠে। কিন্তু প্রায়শই মুছে যায় মাঝ সমুদ্রে। আর জহর এই মহালোকের অর্জন নিয়েও গুটিকয় পাঠকের বাইরে বয়ে যান একা। এই নিয়তির ভেতরই জহর ঢুকে পড়েন মুহুর্মুহু মহাখননের প্রান্তরে। পাথর চিরে চিরে নখ উপড়ে যায়। তাঁর রক্তাক্ত আঙুল জগজ্জননীর গালে রাখেন। আর তাঁর আর্তস্বর লোহার কীল হয়ে ঘুরতে থাকে ব্রহ্মাণ্ডে। তার নীচে জহর তাঁর কোলের চরাচরে মা-বাবা-ভাই-বোন জগতসংসারের ছেঁড়া মুণ্ড নিয়ে বসে। হাড়িকাঠে ফুটে থাকে নিস্পন্দ নিথর এক জবা।
জহরকে পড়ার বিস্তর এক পাঠ লাগে। সময়সারণিহীন বহু অন্তর্জটিল গলিগুঞ্জর। সুড়ঙ্গসুপ্ত মহাকালের ঘুমের ভিতর থেকে পরিসরলুপ্ত শেওলাসুতোর বুনটে চলে যাওয়া। দেশ ও কালের আর্দ্রনমিত মহাযাত্রার কেয়ূরকঙ্কনের ধ্বনি, সেটুকু শোনারও ইশারাদীপ্ত এক প্রাণ লাগে। উৎসবউৎসবউৎসবের বিমূঢ় ফেনায় সেই উৎকর্ণ শ্রবণকে কবেই না হারিয়ে এলাম। আমাদের গরিবগুর্বো ডোঙা দুরূহের যাত্রায় গেল থকে। চুনোপুঁটির সম্বছর। অজানার ঝঞ্ঝায় আমাদের নিয়তি শুধু বুদবুদের চিহ্ন রেখে যায়।
জহরকে কতটুকু বুঝেছি, সে কথা নয়। জহর কতটুকু সে কথা জানাতেই মাথার পাশের সম্পর্কের নাছোড় বালিশের কথা এল। সেই তপ্তঅসীম উপাধানটুকুই হল 'আমার কবিতা', 'বিপজ্জনক ব্রহ্ম বালিকাবিদ্যালয়', 'ভবচক্র; ভাঙাসন্ধ্যাকাল' 'মহাজগৎকথা', 'বৃষ্টি ও আগুনের মিউজিকরুম', 'কাঠবিড়ালির কবিতা', 'দাঁড়কাক; শুধু দাঁড়কাক'। সতীনের মতো পড়ে। পড়ি। হাত বোলাই। দেখি। গান গাই। জাগি। জাগাই। মাখি। খাই। চুমু দিই। সূচ ফুটিয়ে রক্তকণা আঙুলের শীর্ষে নিই। মৈথুন করি। গলা জড়িয়ে ঘুমাই। জাগাই। রাগাই। সংলাপ করি। ইজের পালটাই। সাফ করি। যাকে মধ্যে রেখে আমার স্ত্রী আর এক বালিশে শুয়ে পড়ে। আমার অনন্তে কত দূরের নৌকো। জল ভাঙে। আলো পড়ে। জলে ভাঙা গান। অসীম কালের। অন্ধকার গৃহ সন্নিকটে জহর পথিকের ধুলোর পোশাকে দাঁড়িয়ে। শিস দেয় দেউড়ির আলো। আমার স্ত্রী দরজা খোলে। মাটির হাঁড়িতে ফোটা তণ্ডুল। ফুঁ দিয়ে আগুন শূন্যে তুলি। ভাপ তুলি। অদৃষ্টবাদীদের এই রান্নাবান্না। ভক্ষণ শেষে আমরা তেপায়া পাথরের টেবিলে হাড়ের তাস খুলে বসি। সিগার জ্বলছে। ধোঁয়া। অন্নপূর্ণা বাসনকোসন ধুয়ে শূন্যে তারার রঙে বসে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন