তাই বিহারীলাল চক্রবর্তীকে 'কাব্যগুরু' হিসাবে মান্য করলেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু স্পষ্টত উপলব্ধি করেছিলেন যে বিহারীলালের নিশ্চিত ত্রুটি কোথায়। আজ আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে বিহারীলাল আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং সেই ব্যর্থতার ইতিহাস থেকে শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র-অনুসারী কিংবা অনুকারী কবিরা রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্রে রেখে আবেগের স্রোতে ভাসলেন, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষিত অন্তঃপুরকে আদৌ চিনতে পারলেন না। তিরিশ দশকের কবিরা এলিয়টের সঞ্জীবনে নিজেদের প্রস্তুত করতে করতে হৃদয়কে বুদ্ধির দ্বারা পরিশ্রুত করে নিতে যেমন দ্বিধা করলেন না, তেমনই নিজেদের দশকেও একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠলেন। আজকের এই সময় জীবনানন্দকে নিয়ে যতখানি ব্যস্ত, ততখানি ব্যস্ত নয় তাঁর দশকের অন্যদের সম্পর্কে। কিন্তু একথা সবসময় মনে রাখতে হবে যে জীবনানন্দকে তাঁর সময়ের অন্যান্য কবিদের কাছ থেকে পৃথক করে নিয়ে শুধু তাঁরই কবিকৃতি নিয়ে প্রমত্ত থাকার অর্থ সেই পরিপূরকতাকে নষ্ট করে দেওয়া। আসলে বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং সর্বোপরি জীবনানন্দ-আসলে একই ঐক্যসূত্রে বিধৃত। এঁরা সকলে মিলেই বুদ্ধি এবং হৃদয়ের আন্তসম্পর্ক স্থাপনে সফল হয়েছে। এই ছ'জন কবির কবিতার দিকে মনোযোগ দিলে দেখা যায় বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং সঞ্চয় ভট্টাচার্য তাঁদের নিজ নিজ কবিতায় 'ইনটেলেক্ট'-এর প্রাধান্য দিয়েছেন। পাশাপাশি জীবনানন্দ কিংবা বুদ্ধদেবের মূল ঝোঁক আবেগের দিকে। কিন্তু ছ-জন কবির মিলিত কাব্য্যবিন্যাসের ক্ষেত্রে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- তা হলো কবিতার রসসৃজনে বুদ্ধি এবং হৃদয়কে যথাযথভাবে আত্মসৌকর্যে ব্যবহার করে নেবার নিভৃত শৈলীচেতনা। বাংলা কবিতার ইতিহাসে আমরা আজ নিরপেক্ষভাবে দেখতে পাচ্ছি একটি চূড়ান্ত সত্যের প্রতিষ্ঠাকে। তাহলো-তিরিশ দশকের কবিরা বুদ্ধি এবং হৃদয়ের আত্তীকরণের সফলতায় বাংলা কবিতাকে যে শীর্ষচূড়ায় নিয়ে যেতে পেরেছেন, সেই আত্তীকরণের তীব্র উত্থানের সফলতা পরবর্তী চল্লিশ দশকের কিংবা পঞ্চাশ দশকের কবিদের ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু দেখতে পাচ্ছিনা। চল্লিশ দশকের কবিদের অতিরিক্ত সমাজসংশ্লেষ যেমন তাঁদের তীব্র আবেগবন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছিল, তেমনই পঞ্চাশ দশকের কবিদের অতিরিক্ত আমি-প্রবণতা কিংবা নিজের মধ্যে ক্রমাগত সাঁতার দেবার প্রবণতাও তাঁদের আমিকেন্দ্রিক আবেগচর্চায় ধরে রেখেছিল। এরই সঙ্গে আবার পঞ্চাশের কোনো কোনো কবি সংবাদপত্রে স্থায়ী চাকরি নেবার সূত্রে ফিচারের ভাষাকে কবিতার মধ্যে সংক্রমিত করে কবিতা থেকে মননকে প্রায় নির্বাসনের দিকেই ঠেলে দিলেন। ফলে একদিকে কবিতায় যেমন জনপ্রিয়তার নকটার্ন এলো, তেমনি কবিতা হয়ে দাঁড়ালো কেবল মননহীন আমিসর্বস্বতার এক শাব্দিক স্বীকারোক্তি, যেখানে রইলো নতুনত্বের নামে একধরনের যৌনস্বেচ্ছাচার এবং আত্মকেন্দ্রিক অবক্ষয়ের দাপট। অবশ্য ব্যতিক্রম হয়ে রইলেন কেউ কেউ। যেমন প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত। যেমন আলোক সরকার। যেমন উৎপলকুমার বসু। যেমন শঙ্খ ঘোষ। প্রাগাধুনিক যুগপর্ব থেকে আধুনিক যুগপর্বে পৌঁছে 'আমি'-কে যতই প্রাধান্য দেওয়া শুরু হলো, ততই বাংলা কবিতায় দেখা দিতে শুরু করলো 'আমি'-র যৌনবিকার ও ক্রমাবনতি। আধুনিকতার বন্ধন এবং 'আমি'-র বন্ধন এই দুইয়ের বিস্তৃত হননমেরুতে বুদ্ধি এবং হৃদয় এই দুইয়ের সঠিক
ঐক্যনির্মাণের পথ গেল রুদ্ধ হয়ে। আসলে 'আমি'-কে বহুমুখী সম্প্রসারণের দিকে চালিত করবার প্রয়োজনীয়তা অনেক কবিই অনুভব করেননি। 'আমি'-কে বহুমুখী করে তুলতে পারলে এবং সেই বহুমুখী 'আমি'-র মধ্যে বৃদ্ধি এবং হৃদয়ের যথার্থ মিশ্রণ ঘটাতে পারলে। একজন কবি তাঁর কবিতাকে যথেষ্ট উচ্চতায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হবেন-এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। প্রাগাধুনিক যুগপর্বের কবিরা দৈব বন্দনায় অতিরিক্ত দৈব বন্দনায় স্ব স্ব আমিত্বকে বিসর্জন দিয়েছিলেন, যা কবিতার স্বাস্থ্যহানির কারণ। আবার আধুনিক যুগপর্বের কবিরা নিজ নিজ আমিত্বকেই এতখানি বড়ো করে তুলে ছিলেন, যা আসলে কর্তার প্রাধান্যকে ইঙ্গিত করে এবং এই অতিরিক্ত আমি-প্রবণতাও বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে সর্বনাশের কারণ হয়ে উঠেছে। এখন এই উত্তর আধুনিক বা পোস্টমডার্ন যুগপর্বে পৌঁছে গিয়ে আমরা স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি 'আমি' বাংলা Plural হয়ে গেছে এবং তারই ফলশ্রুতি:
ক. বাক্যবিন্যাসে কর্তার প্রাধান্য কমেছে
খ. ক্রিয়াপদের প্রাধান্য বেড়েছে
শুধু কবিতাতেই নয়, রাষ্ট্রে ও সমাজেও দেখা যাচ্ছে কর্তা বিপন্ন। ফলে যা কিছু বুঝ বা Known order, তা দ্রুত অ-বুঝ বা disorder-এর ভিতর গিয়ে এক আশ্চর্য ধরনের কমপ্লেক্সিটির প্রসেসকেই বড়ো করে তুলেছে। 'আমি'-র বহুমুখীত্ব থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে বহুরৈখিক জটিলতা-যার ভিতর আসছে ডিকনস্ট্রাকশান অফ এক্সপিরিয়েন্স কিংবা ইনডিটারমিনেসি ইন লেঙ্গুয়েজ। এলভিন টফলারের মতে (দ্রষ্টব্য- 'ফিউচার শক') আমরা আমাদের আমিকে নিয়ে গতির থেকে দ্রুতির জগতে চলেছি। অর্থাৎ তাঁর মতে:
শুধু 'আমি'-কেই আগলাতে চেয়ে কিংবা শুধু 'আমি'-কেই আঁকড়ে থাকতে গিয়ে আধুনিকতা নামক কনসেপ্ট টিও নিজেকে বিপন্ন করে তুলেছে। এই বিপন্নতায় কবিদেরও নতুন করে ভাবতে হবে। হৃদয় ও বুদ্ধির যথাযথ ঐক্যস্থাপনের মধ্য দিয়ে ভেদ নয়, অভেদেই হয়তো বা আশ্রয় নেওয়াটা ক্রমে ক্রমে অনিবার্য হয়ে দেখা দিচ্ছে।
সূত্র : শিকারী পরিবৃত জীবনানন্দ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন