শব্দ, নৈঃশব্দ্য… কতটুকু শুনতে পাই, কতটুকু দেখতে পাই! দূরবিন্দু অসীমে, তবুও… আর শোনার কম্পাঙ্ক, ২০হার্জ থেকে ২০,০০০… কতটুকু! তাই যা পেলাম, কতটুকু প্রকাশিত হ’ল, নীরবতায় থেকে গ্যালো? থেকে গ্যালো! হে শৈশবের বিশ্ব, কৈশোরের বিশ্ব, যৌবনের বিশ্ব, প্রৌঢ়ত্বের ও বার্ধক্যের বিশ্ব, নবজন্মের সেই স্পন্দনের কাছে আমি যে ‘কান পেতে রই’ … মৃত্যুকে আঘাত ক’রে দেখি, বলি – ‘কথা কও, কথা কও’…
ফিজিক্স ল্যাবের টিউনিংফর্কে, হাতুড়ির আঘাত যে উৎস কবিতা লুকিয়ে রেখেছিলো, রাতের নীরবতায় ‘হরিবোল’ যে শৈশবকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো, সমুদ্রের হাহাকারের কাছে যে কৈশোর অবলীলায় কেঁদেছিলো, যে সঙ্গমধ্বনি নগ্ন হয়েছিলো বন-বাংলোর মধুচন্দ্রিমায়, যে বার্ধক্য চঞ্চল হয়েছিলো পাহাড়ি ঝরনার শব্দে, সেখানেই আছে নীরবতার কবিতা কবিতার নীরবতায়। ‘দ্যাখা না-দ্যাখায় মেশা’, শোনা না শোনায় যে নেশা তার বিস্ময়, বিমূর্ত ‘জাগরণে যায় বিভাবরী’। নীরবতা লুকিয়ে রাখে সেই সম্ভাবনা যা কবিতার আদি ও অন্তহীনতার সুর স্বর রে রে রা রা… গর্ভমতের আমি, f(x) নামের লোকটা সেখানেই দিয়েছিল ‘লকার খুলে, লক খুলে, কল খুলে, পানীয় জলের আহা!’
নৈঃশব্দ্য টের পেতেই এই শব্দ যেমন একদিকে ওয়ার্ড, অন্যদিকে সাউন্ড। ওয়ার্ড এবং সাউন্ডের পরস্পরমুখী চলনে ধ্বনিগত সম্পাদনাকে ভাবনার প্রতস্পর্ধী মুখে পুষ্টি দিতে চেয়েছিলো একজন। স্পেস যেমন, শব্দকে তার অবস্থানে আলো দ্যায়, তেমনই নীরবতা দ্যায় সম্ভাব্য বেজে ওঠাকে বহুমাত্রিক চলন। স্পেস ও নীরবতাকে(নৈঃশব্দ্য) একজন যখন ভাবনা ও চর্চার অগ্রগতিতে সম্পাদনা করে, তখন কবিতার ব্যঞ্জনা দৃশ্যে ও শ্রাব্যে একই সাথে আলোকিত ও ধ্বনিত হয়। এই রসায়ন, এই রস, এই আয়ন… এসো সেই নিজস্ব সমীকরণে, না অন্য ওনা মাখিয়ে না দিই…
সে এক স্বদেশ, সে এক দেশ… সমস্তটাকে উড়িয়েছিলো। ভেবে দেখুন সেই স্পেস কোন বোনাতে বুনেছিলো নতুনের স্পর্ধা। আপেলকে ঘুম পাড়িয়েছিলো দাঁত দিয়ে জাগানোর জন্য। এই ঘুম ও জাগার মধ্যেই নীরবতার বীজটি, জেগে ওঠার পরের সম্ভাবনাকে দিয়েছিলো জল ও বাতাস। এক সচেতন কারিগর অভ্যাসকে দিয়েছিলো নতুন উচ্চারণের ধাক্কা। সেই কত দশক আগে। কত দশক পার ক’রে সে চ’লে গ্যালো বিমূর্ততাকে আশ্রয় ক’রে। আকবরের তার বেজে উঠলো, কিন্তু ওই শীতের ঘাম!
আমরা শুনেছিলাম শিকারের আর্তনাদ, শিকারির মাংস খাওয়ার শব্দ, তারপর এক নীরবতা, পরবর্তী শব্দের অপেক্ষায়। ‘মুরগি কাটলে যে সুর কাঁপে রক্তের নিচে’, যেমন ‘উচ্চারণে চাপ দিলে পাহাড় পর্বত হয়’… এক নীরবতা বন্ধুত্ব করে আর এক নীরবতার সাথে। বাজিয়ে তোলে মধ্যবর্তী সংযোগটিকে।
দেবারতি’র কাছে দেখেছিলাম ছায়া ও জলের সেই অন্তর্ঘাত। একা একার লন্ঠন, একা একার ধুকপুক… কল্পিত শূন্য ও পূর্ণতার মধ্যবর্তী হাহাকার। শুনেছিলাম তার পায়ের শব্দ , জলে নামার শব্দ। সে গ্যালো কোথায়! সে কি শ্মশানের ছাই ধুয়ে নিয়েছিলো! ভাবতে ভাবতে সেই মেয়েটিকে দেখি যার পুজো করেছিলো এক অনন্ত নীরবতা… এই নিস্তব্ধ পরিবেশ।
ঘুরে যাই। বারীনের ‘শব্দের প্ল্যান’। তাকাই। ‘শব্দের ভেতরেই শব্দের প্ল্যানগুলো ছিলো’- আমি পেয়েছি সেই নৈঃশব্দ্য যার জন্য রাখা ছিলো ‘কাঁপন পরিযায়ী’। গঠনে সেই নীরবতা শব্দের প্ল্যানে ঢুকে পড়ে, ভেবে দেখুন তো ঢুকে পড়ে না কি! সেখানে ‘অণুবাগান’ তৈরি হয়। আমরা গঠনের মধ্যে শুনে নিই ‘শ্রবণের মধ্যে শ্রাবণ আসছে’…
মনে পড়ে ক্লাসরুমের সেই দিনের নীরবতার কথা, মনে পড়ে, পড়া হচ্ছে ‘The listeners’ … নীরবতা ছিলো বলেই থেকে গিয়েছিলো কবিতা, কবিতার নীরবতায়… ‘ ‘Tell them I came, and no one answered, That I kept my word,’ he said.’
নীরবতা বিষয় হতে পারে, কিন্তু রচিত নীরবতা এক বিমূর্ত প্রতিভায় থমকে দিতে পারে মন ও মন্তাজ। কবিতা সেই বিমূর্ততাকে ধারণ করে কখনো অন্ধকারে ফুটে ওঠা সুরের আঘাতে, মাংসের বয়ানে। সমীরণে দেখি ‘অপরিসীম খুলির সঞ্চার’। শিষ উঠছে কোথাও, কোথাও বা আশ্চর্য ডাকবাংলো সেই বাংলাডাকের… সেই সূর্যাস্তের দিকে রক্তমাখা হাতে দাঁড়িয়ে আছে যে নীরবতা, তা অনন্ত শয্যার অপেক্ষায় থাকে কি! না কি ক্ষয়প্রাপ্ত বালুকণা অপেক্ষায় থাকে আগামী ঘর্ষণের! এ রহস্য ফুরোয় না।
Emily Dickinson, মনে পড়ে… ‘Silence is all we dread./There’s Ransom in a Voice—/But Silence is Infinity./Himself have not a face.’ এও এক অনুভব।
‘ছায়াভাষা’-র পরে ম্যাজিক, সেখানেও নীরবতা নির্মাণের। যখন পড়ি সেই শূন্যস্থান, যখন বেজে ওঠে ‘একফোঁটা গড়ানো আবেগের ঝিলমিলিনিয়াম’ তখনও এক নৈঃশব্দ্য অপেক্ষা করে হেঁটে যাওয়া সূর্যাস্তের।অপেক্ষা থাকে ‘রোদগ্রাফ’-এর। ‘পোয়াতিমা’-র নীরবতায় কান পাতি, শুনি শব্দের আকাঙ্ক্ষা। এভাবেই ‘ফোঁটা ফোঁটা পৃথিবীর শব্দ’, এভাবেই প্রণবীয় চেতনাতিমায় গ্রাফের ওঠানামা।
তাকিয়ে আছি প্রদীপের নীরবতায়। পাখিকোণে পাখাটানা ‘কয়েকটা পাখি স্ফুরিত’। আহত সিংহটি নীরব। তবুও রাজার রক্তপাত চেটে খাচ্ছে রাজা। আনত। বন্যতা অপেক্ষা করছে আগামী গর্জনের, হরিণটিও… ছায়াসাম্রাজ্য ফেলে এগিয়ে গ্যালো মূর্তিটি। ‘পাখিদের দরাজঘর’ বন্ধ করলো কে! ভেঙে গ্যালো মূর্তিটি। তৈরি হ’ল নীরবতা।
মুক্তির সাদাকালো দেখলো ছেলেটি। ছোটার মাঝে ছোটার পরে ছুটতে ছুটতে ছুট ছুট ছুট… ছেলেটি দেখলো ‘মহাকালো মাঝে’ শব্দ নৈঃশব্দ্যের বিবাহ। দেখলো জেব্রাখুন , জেব্রাখুন…
(নীরবতায় আশ্রয় পেলো স্বদেশ সেন, দেবারতি মিত্র, বারীন ঘোষাল, প্রণব পাল, প্রদীপ চক্রবর্তী ও সব্যসাচী নিজে)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন