সেই দুর্লভ কবি, জীবনানন্দকে নিয়ে লিখলেন,- 'সংশয়ে সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে দেখে দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে
একদিন সচেতন হরিতকী ফলের মতন ক'রে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেকে গেল।' জীবনানন্দ সম্পর্কে এ যেন আমারই কবিতা। যেন আমিই ট্রামে পিষ্ট রক্তাপ্লুত কবিকে দেখে লিখেছি। যেন যন্ত্রণা ক্লিষ্ট হহৃদয়ের রক্ত কণিকা থেকে উচ্চারিত বেদনার মন্ত্রধ্বনি। অথচ পাঠক, এই কাব্য- পংক্তি আমার নয়। বিনয়ের। কবি বিনয় মজুমদারের। যাকে দেখার সৌভাগ্য হলো তাঁর কবিতা পড়ার প্রায় কুড়ি বছর পর। ঠাকুর নগর স্টেশান সন্নিকটে, শিমুলপুর গ্রামের 'বিনোদিনী কুটিরে। ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০০৩, কবির ৭০ তম জন্মদিবস অনুষ্ঠানে। আগের দিন রাত্রি সাড়ে দশটায় টেলিফোনে কণ্ঠস্বর এলো কোলকাতার গড়িয়া থেকে। গল্পকার তথা বিনয়ের বন্ধুবৎ উদয়ন ঘোষের কণ্ঠস্বর- উত্তর, কালকে কবি বিনয় মজুমদারের ৭০ তম জন্মদিবস উদ্যাপন হচ্ছে। সকাল আটটায় শিয়ালদা স্টেশানের পাঁচ নং প্লাটফর্ম থেকে বনগাঁ লোকাল। প্রথম কম্পার্টমেন্ট, বাকী কথা সাক্ষাতে হবে। * বলবো কী, বাকী রাত ঘুমোতে পারিনি। বিনয়ের যত কবিতা পড়েছি, যত আড্ডা হয়েছে বন্ধুদের সাথে বিনয়কে নিয়ে। যতকথা শুনেছি প্রেসিডেন্সি কলেজের বকুলতলায় অথবা কফিহাউসে হুবহু সব মনে পড়লো। মনে পড়লো উদয়ন ঘোষ যখন মৌরীগ্রাম ইরিমে তখন এক সান্ধ্য আড্ডায় বলেছিলেন 'বিনয়ের 'ফিরে এসো চাকা' পড়েছো। কিন্তু 'অম্লানের অনুভূতিমালা' পড়েছো? যদি না পড়ে থাকো, অথবা পুনর্বার পড়ো- 'সরস্বতী পূজা', 'সকল বকুলফুল', 'বিশাল দুপুরবেলা', কেমন মোহনা' কবিতাগুলি। সে সব কবিতা পুনর্বার পড়েছি। সে কথা যথাসময়ে হবে। তার আগে বলি, সেই রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। জীবনানন্দকে দেখা কখনোই সম্ভব ছিল না। কিন্তু বিনয়কে দেখবো। ওগো বিনয়, তোমাকে না দেখার বেদনার্ত সাগরে দেখার রোমাঞ্চকর আবেগ উথলি উঠিছে। সে এক স্বপ্নালোকের মুহূর্ত। আনন্দ আর কৌতূহল সঞ্চারী। ঘুমনো যায়।

ট্রেন ছুটছে পুবে, সকালের উজ্জ্বল রোদ্দুর সাদা মেঘের সঞ্চারে প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই বাংলায়। একটার পর একটা স্টেশান সরে যাচ্ছে পিছনে। প্রিয় কবিকে দেখার তৃষ্ণা, উৎকণ্ঠা-আনন্দের প্রত্যয় নিয়ে অবশেষে ঠাকুর নগর স্টেশানে পা রাখি। মনে হলো তীর্থক্ষেত্রে নেমেছি। প্লাটফর্মে কবিদের পদচারণা, দলবদ্ধ ভিড়ে নিজের আনন্দের কান্না লুকিয়ে রাখি। সমুজে মিশে যাওয়া বাঁক নেওয়া ট্রেনলাইন পেরিয়ে হাঁটাপথ ধরি অপরিচিতের মত। 'প্রথম মিলন কালে ছেঁড়াত্বকের জ্বালার মত গোপন, মধুর এ বেদনা' বুকে নিয়ে 'বিদেশী ভাষায় কথা বলার মতন সাবধানে' আমিও বিনয়ের প্রসঙ্গে আসি। মনে মনে নিবিড় উচ্চারণ করি,-

'সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কত বেশি বিপদ সংকুল। তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ, এ সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে সঞ্চারিত হতে চাই, চিরকাল হতে অভিলাষী সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালোলাগে বলে। তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু, মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।'

বর্ষাকালের কৃষ্ণবর্ণ মেঘ উধাও হয়েছে, পরিবর্তে আকাশের গায়ে ভেসেছে শ্বেতবলাকার মত মেঘমালা। পথের চারপাশে আম কাঁঠাল-নারকেল হিজলের নয়নাভিরাম সবুজ জঙ্গলে নেমেছে সকাল উতরানো ঘুঘু ডাকা দুপুর। নুয়ে থাকা আম্রশাখা সরিয়ে অন্য বাড়ির উঠোন দিয়ে প্রবেশ করি বিনয় উদ্যানে। বার বিঘা জমির প্রাঙ্গণ জুড়ে চমৎকার গাছগাছালি। বর্ষাস্নাত সবুজ কার্পেটের আঙিনায় ফুটেছে সুগন্ধি চাঁপা। বৃক্ষছায়ায় ছোটমঞ্চ। কয়েকশো কবি সাহিত্যিক, অনুরাগী, প্রতিবেশী স্বজন- সুজন। যাঁকে নিয়ে এই আনন্দ উচ্ছ্বাস, মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, সেই কবি একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছেন আগানে বাগানে, কি কখনো উত্তরের ঘরে জানালার গ্রিলে হাত দিয়ে বাইরের মানুষজনকে ভয়ভয় চোখে দেখছেন। অতঃপর তরুণ কবি অমলেন্দু বিশ্বাসের হাত ধরে কবি মঞ্চে এলেন। সত্তরটি গোলাপকুঁড়ির স্তবক দেওয়া হ'লো কবিকে। গোলাপের ভেতর নাক-মুখ গুঁজে দিলেন। দীর্ঘতর নিঃশ্বাসে গোলাপের সুগন্ধ নিলেন। নিজের দীর্ঘতর দু-একটি কবিতা হবহু বলে গেলেন। দু-একবার থামলেনও। বিস্ময়চোখে তাকালেন দর্শকের দিকে। তারপর একাই মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন নিজের ঘরে। ভিড় সরিয়ে কবি মৃদুল দাশগুপ্তের সঙ্গে ঢুকেপড়ি কবির ঘরে। তক্তাপোশে বিছানা। পাশে বেঞ্চের ওপরে একটি ট্রাঙ্ক। একটা ফাঁকা আলনায় একটা পাঞ্জাবী, দুটো লুঙ্গি, একটি গামছা। নিচে দু-চারটে ম্যাগাজিন। বাকি ঘর শূন্য। ১৬ ফুট বাই ১৪ ফুট মেঝের ওপরে দাঁড়িয়ে মৃদুল দাশগুপ্ত একটি দামী সিগ্রেট দিতেই কবি খুব খুশি হলেন। মেজাজ হাস্যময় হতেই পা-দুটো স্পর্শ করি। যেন পরম গুরুর চরণ স্পর্শ করলাম। চোখে চোখ রাখি, শ্রদ্ধায়-বিস্ময়ে মুগ্ধতা নিয়ে দেখি কবিকে। অনুক্ষণ দেখে দেখে, দৃশ্যত: কবির রহস্যঘেরা রূপটি ধরা পড়ে মর্মলোকে। দেখি, ঈষৎ শ্যামল বর্ণের নাতিদীর্ঘ মানুষটার হাত নেমেছে প্রায় জানু পর্যন্ত, আঙুলগুলো অপেক্ষাকৃত সবল এবং দীর্ঘ। সিগারেট ধরেন শিল্পীর মায়াবী নেশায়, কলম ধরেন যোদ্ধার মতন। আকর্ষণীয় দুটো চোখের মণি ধূসর, অনেকটা বড়। বহুক্ষণ ব্যাপী নিষ্পলক থাকতে পারেন তিনি। চোখের ভিতরে দৃষ্টি ক্ষেপনের তীব্রতা গভীর ও ব্যঞ্জনাময়, বিশ্বচরাচরে ব্যপ্ত সেই দৃষ্টি পলকহীন রহস্যে ঘেরা, তথাপি সেই দৃষ্টি জটিল নয়, শিশুর মত খেয়ালি সুদূরের পিয়াসীসুর রিয়ালিস্টিক।

আশ্চর্যের বিষয় এই, তাঁর কবিতার মতই বিনয়ের জীবন চেনা পৃথিবীর অভ্যন্তরে থেকেও ভিন্ন কক্ষপথে আবর্তিত। সেই ১৯৩৪ এ ব্রহ্মদেশ থেকে অদ্যাবধি শিমুলপুরের যে জীবন তা আমাদের কাছে প্রকৃতই অধরা। যা লেখালেখি তা প্রকৃত অর্থেই ত্রিশ বছর বয়সের আগেই। বাকি সব কক্ষপথে নেশাভাঙা মানুষের শিশুসুলভ উন্মাদনা। ভাবা যায়। ঐ পঁচিশ ছাব্বিশেই শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে রেকর্ড নম্বর নিয়ে পাশ করে তিন চারটি সম্মানীয় চাকরী ছুঁড়ে ফেলেছেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যায়ে গণিতের অধ্যাপনা এবং জাপানে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরীর আমন্ত্রণ পেলেও অনায়াসে উপেক্ষা করেছেন সব শুধু কবিতা লিখে জীবন কাটাবেন বলে। তাই তথাকথিত যশলোভী অর্থলোভী মানুষদের মত জীবন কাটাতে না পারা বিনয়ের কাছে 'আঙুর ফল টক' নয়। বরং এসব জাগতিক বৈভব তাঁর বোধ ও চৈতন্যের কাছে গুরুত্বহীন, অসার। ইত্যবসরে প্রায় এক নিঃশ্বাসে লিখে ফেলেছেন-'নক্ষত্রের আলোয়', 'ফিরে এসো চাকা', 'আমার ঈশ্বরীকে', 'অঘ্রাণের অনুভূতিমালা'। কিছু ব্যতিক্রমী গল্প, কবিতাবিষয়ক নিবন্ধ। তদুপরি চেকভের গল্পের অনুবাদ, চেকভের জীবনী। রুশভাষা থেকে 'আপেক্ষিকতত্ব' এবং গণিতের ওপর আশ্চর্য গ্রন্থ যা পৃথিবীর নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়- 'ইন্টারপালেশান সিরিজ জিওমেট্রিক্যাল এনালিসিস এন্ড ইউনিটাল এনালিসিস অফ রুটস অব ক্যালকুলাস'। ভাবুন পাঠক, ঐ ক'বছরে সৃষ্টির কী সব কান্ডকারখানা। আর 'ফিরে এসো চাকা' সে তো বিশশতকের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থগুলির অন্যতম একটি। এই কাব্য থেকে কতিপয় পংক্তি তুলে ধরলেই পাঠক বুঝতে পারবেন কবি বিনয়ের গাণিতিক প্রজ্ঞা, তীক্ষ্ণমেধা, অলৌকিক কবি প্রতিভা ও মাধুর্যবোধ বিশ্ব কবিতার কোন স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে। 'কাগজ কলম নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা প্রয়োজন আজ, প্রতিটি ব্যর্থতা, ক্লান্তি কী অস্পষ্ট আত্মচিন্তা সঙ্গে নিয়ে আসে।

সতত বিশ্বাস হয়, প্রায় সব আয়োজনই হয়ে গেছে, তবু কেবল নির্ভুলভাবে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না এখনো। সকল ফুলের কাছে এত মোহময় মনে যাবার পরেও মানুষের। কিন্তু মাংস রন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে।' 'অথবা করেছ ত্যাগ, অবৈধ পুত্রের মত, পথে। জীবনের কথা ভাবি। ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে পূনরায় কেশোদগম হবে না। বিমর্ষ ভাবনায় রাত্রির মাছির মত শান্ত হয়ে রয়েছে বেদনা হাসপাতাল থেকে ফেরার সময়কার মনে। মাঝে মাঝে, অগোচরে বালকের ঘুমের ভিতরে প্রয়াব করার মত অস্থানে বেদনা করে যাবে।"

"কিংবা দ্যাখো ইতস্তত অসুস্থ বৃক্ষরা পৃথিবীর পল্লবিত ব্যপ্ত বনস্থলী দীর্ঘ দীর্ঘ ক্লান্তশ্বাসে আলোড়িত করে জবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা।"

'আমি রোগে মুদ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায় আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে। আমি মুগ্ধ: উড়ে গেছে, ফিরে এসো, ফিরে এসো চাকা, রথ হয়ে জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো। আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন সূর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।'

এমন মননস্পর্শকারী বিদ্যুৎবাহী অলঙঘনীয় কাব্যবাক্য নিশ্চয়ই পাঠক আপনি এর আগে শ্রবণ করেননি, চাক্ষুষও করেন নি। এই কবিতাগুলির উৎসেও কি কম রহস্যময় জালের আবর্ত আছে? ৭৭টি কবিতার নতুন সংস্করণের নাম 'ফিরে এসো চাকা'। বইটি উৎসর্গ করলেন গায়ত্রী চক্রবর্তীকে। কে এই গায়ত্রী। গায়ত্রী সম্পর্কে বিনয় নিজেই বিভিন্ন সময় প্রশ্নকারীদের বলেছেন-প্রেসিডেন্সি কলেজের বাংলার অধ্যাপক যিনি তাঁর বাংলা ভাষা শিক্ষার শুরু সেই জনার্দন চক্রবর্তীর মেয়ে। ইডেন হিন্দু হোস্টেলে অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তী সুপারিটেন্ডেন্ট ছিলেন। সেখানে বিনয় ছিলেন দু'বছর। তখন বিনয় আঠারো আর অপরূপ তন্বী গায়ত্রী বারো-তেরো। কিছুদিন আলাপ চারিতা। এই ঘটনাকে আর পাঁচজনের মত আলাপ পরিচয় বলেছেন বিনয়। প্রকাশ্যে এক কথা বললেও ভাবের জগতে তা কোন গভীরতায় পৌঁছে ছিল তা বলা শক্ত। সত্তর জন্মদিবসে কয়েকজন অনুবাগী গায়ত্রীর প্রসঙ্গ তুলতেই কেমন যেন হয়ে গেলেন এবং বৃক্ষের সহজ দুলনে চোখ বন্ধ করে বললেন এসব গোপন ব্যাপার'। তারপর চুপ। বস্তু জগতের এসব কথা ও দৃশ্য বাদ নিয়ে আমরা যদি কবিতায় পৌঁছাই তাহলে স্পষ্টত। অনুভব করি গায়ত্রী থেকে কালজয়ী অলভধনীয় প্রেমের কবিতাগুলির সৃষ্টি। বিনয়ের মত পৃথিবীর দুর্লভ কবির পক্ষে শুধু গায়ত্রীর অবয়বে সীমাবদ্ধ থাকা সম্ভব নয়। গায়ত্রীর দৃশ্যমান তিলোত্তমা সৌন্দর্য বিশ্ব সৌন্দর্যের জন গায় বিনয়ের কবিতায়। গায়ত্রী একনা সাত সমুদ্র পেরিয়ে আমেরিকায় চলে গেলে তৌগোলিক দূরত্বে বিরহের দূরত্ব প্রায়জিদ। মসন বিচ্ছিন্ন নক্ষত্রের মত কবি নিজের অনুধ্যানে নি থাকেন গায়ত্রী। গভীর প্রেমানুভূতির মিয়াবা হেতু বেদন নিশ্চল কবির অন্তর্লোক জুড়ে যে কী হাহাকার। ওই পৃথিবীকে নানাবিধ আনন্দ' আছে বলে বেঁচে আছেন কবি। আকাশের সুযুরতা ছাড়া 'কোন দৃশ্য নেই', 'পূর্বপরিক্রমারও জোতিষ্কওচিত মধ্যে শুধু ধূমকেতু প্রকৃতই অগ্নিময়ী', ফলে কবি বিভেদে আবিষ্কার করেন অদ্ভুত এক গাণিতিক বিশ্লেষণে- দৃন্দ বিশ্বে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি অগ্নিকে, তারপর শূন্যকে, শূন্যের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় শুন্যও দৃষ্ট, দৃষ্টিগোচর। শূন্য নিঃসন্দেহে শূন্য। সম্পূর্ণরূপেই শূন্য। কিন্তু অদৃশ্য শূন্যতাও তো দৃষ্টিবোধ এবং ফলে দৃশ্য। অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি নক্ষত্রকে। সকল নক্ষত্রকে। তবে তারো চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসি আমার ঈশ্বরী অর্থাৎ নিজেকে।' মব একাকার করে দিলেন। নিজের ভিতরেই নিজের ঈশ্বর। গায়ত্রী থেকে বিশ্বচরাচর। সেই যে ঠাকুরনগর ছেড়ে সীমা চলে গেল সনীম অসীমের রহস্যময় অস্তিত্ব বিশ্বভূবন জুড়ে। সেই অসীমেই সম্পর্ক স্থাপন বিনয়ের। বিশ্বচরাচরের অংশীদার। ফলে নিজের জীবনের কথা আলাদাভাবে তাবার গ্রন্থ ওঠে না। পৃথিবীর ঘাস, মাটি পশু ও পাখি সবার জীবনী লেখা হলে। আমার একার আলাদা জীবনী লেখা না হলেও চলে যেত বেশ।/তার মানে মানুষের বস্তুদের প্রণীদের জীবন প্রকৃতপক্ষে পৃথক পৃথক অসংখ্য জীবন সব একত্রিত হয়ে একটি জীবন ঘেটে। জীবনের এই ভাবনার সঙ্গে বিনয় কবিতা সম্পর্কেও অনুজগ এক সহা অনুভব করেন। 'পৃথিবী জুড়ে আসলে একটিই কবিতা লেখা হচ্ছে, তাতে আমি দু একটি পংক্তি লিখেছি মাত্র।' কত যে বিস্ময়কর হহৃদয়হর্ষক পংক্তি তাঁর কবিতার শরীর জুড়ে রয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। প্রেম তাপ নিয়ন্ত্রিত কুসুমের অত্যাশ্চর্য সৌরভের মতই তার কবিতা। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় একবার এক নেশায়ু মন্তব্যে বলেছিলেন, বিনয় গু-গোবর নিয়েও সার্থক কবিতা লিখতে পারে-এতটাই ওর ক্ষমতা। বাক্যটি সত্য। চোখের সামনে যে কোন বিষয় নিয়ে কবিতার অবয়বে বিনয় গভীর দার্শনিক সত্যে উপনীত হতে পারেন। একদা মাঘের বিকাল বেলা, শান্তশ্রী প্রকৃতি জুড়ে মর্মরধ্বনি, নৈঃশব্দ ভেঙে দু একটি পাখির কলরব। কবি চেয়ে আছেন প্রকৃতির দিকে আর সাদা পৃষ্ঠা ভরে উঠছে ক্রিয়াপদে,- "মাঘের বিকাল বেলা জানালার কাছে বসে শুনি অনেক বিশেষ্য ডাকে ওইখানে গাছে বসে উড়ে। প্রত্যহই শুনি আমি বিশেষ্যের কাকলি, তুবও পুরাতন একঘেয়ে লাগেনা এদের ডাক কখনো বরং খুব বিশেষণ লাগে, মুগ্ধ হয়ে কান পেতে শুনি। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত যেন বাণী নেই শুধু ধ্বনি আছে। সর্বনাম বসে আছি পশ্চিমের জানালার কাছে অব্যয় কাগজ নিয়ে বর্তমানে ক্রিয়াপদ করি।" এ কবিতা পৃথিবীতে বিরল। বিশ্বলোক জুড়ে কেন একটিই কবিতা এবং একটাই গণিত সুশৃঙ্খলভাবে ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র, সেগুলো চিন্তায় ও অনুভবে বিনয় ধরে রেখেছেন শব্দ-অক্ষরের যাদুবিদ্যায়। আধুনিক প্রজ্ঞা ও জ্যামিতিক তত্ব সূত্রে মাটি, গাছপালা, পাখি-নদী, পাহাড় মেঘ চাঁদ, আকাশ নক্ষত্রপুঞ্জ ও মানুষের ভেতরে আরো গভীর মানুষমানুষীর সম্পর্ক ঘিরে কবিতার নির্মাণ চলে অহরহ। কবিতার শরীরেই কবিতার অত্যাধুনিক বিশ্লেষণী সারবত্তা ছড়িয়ে রেখেছেন প্রতীকী চিত্রের মতন। এ এক আশ্চর্য বিজ্ঞান ও সম্মোহনী ক্ষমতা বিনয়ের। 'সেতু চুপে শুয়ে আছে, সেতু শুয়ে আছে তার ছায়ার উপরে ছায়া কেঁপে কেঁপে ওঠে থেকে থেকে জয়ী হওয়া সেতুর বাতাসে।' অথবা, 'এতকাল মনে হ'তো, তুমিও এসেছো অভিসারে- চাঁদের উপর দিয়ে স্বচ্ছ মেঘ ভেসে ভেসে গেলে যেমন প্রতীতি হয়, মেঘ নয়, চাঁদ চলমান।' কিংবা, 'আমি যেই কেঁদে উঠি অনির্বাণ আঘাতে আহত তখনি সকলে ভাবে, শিশুদের মতই আমার ক্ষুধার উদ্রেক হলো, বেদনার কথা বোঝে না তো।' প্রেমের প্রতীতি কিংবা বেদনার কথা বিশ্লেষণ ধর্মী নয়, সৃষ্টির আনন্দ রহস্যের সঙ্গে একাত্ম হবার যে মন্ত্র তা-ই কবির নিজস্ব ভূবনে জাগ্রত রয়েছে অনুক্ষণ। এখানেই বিনয়ের নিজস্ব জগৎ। যাঁর অন্তর্লোকে একাত্ম হবার মন্ত্র জানা নেই তাঁর অবগাহন সম্ভব নয়। উপরিউক্ত পংক্তিগুলি প্রেমেরই নির্যাস। আধুনিক সময়ের জটিল আবর্তে একই ভৌগোলিক অবস্থানে প্রেমের সামাজিক স্বীকৃতি, উন্মেষ ও পরিণতি সর্বদা সম্ভব নয়। বরং ভৌগোলিক দূরত্বে আবহমান প্রেমের বিরহাতুর সৌন্দর্যের মাধুর্য চিরস্থায়ী। তাঁর 'ফিরে এসো চাকা'র প্রতিটি কবিতায় গভীর প্রেমের সেই শাশ্বত মন্ত্রোচ্চারণ। বিনয়ের কবিতা যতবার পড়া যায় ততবারই ভাল লাগে-বিষয়টা এরকম নয়, বরং একবার পড়লে বারবার পড়তে বাধ্য হতে হয় আর বারবার হৃদয়ের বর্ণময় পরতগুলো বিভাজিত হয়ে ইলেকট্রন প্রোটনগুলিতে ঢেউ তুলে। পুড়ে পুড়ে নিঃস্ব না হলে প্রেমের এমন হীরক স্মৃতি কাব্য সৃষ্টি সম্ভব নয়। সে কথা নাকি একবার অনুজ কবি অরুণ চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, 'কতটা পুড়েছ্যে হে, নিজেকে না পোড়ালে প্রেমের কবিতা লেখা যায় না।' মর্মান্তিকভাবে সত্য একথা। —'যে গেছে, সে চলে গেছে, দেশলাইয়ে বিস্ফোরণ হয়ে বারুদ ফুরায় যেন অবশেষে কাঠটুকু জ্বলে আপন অন্তরলোকে।'
তাঁর লেখার উৎসে আছে যে প্রেম, তা শরীরী কামোন্মাদমূলক নয়, অন্তত। 'ফিরে এসো চাকায়' সেই গ্লানি স্পর্শ করেনি। বরং প্রেমের অনন্ত আস্বাদ হেতু প্লেটোনিক বা ইউনিভার্সাল প্রেমের ব্যঞ্জনা পল্লবিত হয়েছে।

প্রেসিডেন্সি'র কিংবদন্তী সুন্দরী ইংরেজী সাহিত্যে রেকর্ড নম্বর পেয়ে চলে গেছেন আমেরিকায়। প্রেসিডেন্সির মেধাবী ছাত্র শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে রেকর্ড নম্বরের সঙ্গে প্রেমের সুনামি কম্পন নিয়ে চলে গেছেন শহর থেকে সবুজাবৃত নির্জন গ্রামে। একজনের পৃথিবীর সম্পদশালী দেশে অবস্থান। অর্থ, যশ, খ্যাতি-বৈভব। অন্যজন বেদনায় দীর্ণ, চিরবিরহী, শিশুর খেলায় আত্মমগ্ন একাকী উদাস। 'বেশ কিছুকাল চলে গেছো প্লাবনের মতো' একবার এসো ফের; চতুর্দিকে সরস পাতার মাঝে থাকা শিরীষের বিশুদ্ধ ফলের মত আমি জীবন যাপন করি।'

সরস প্রকৃতির মধ্যে থাকা শিরীষের বিশুদ্ধ ফলের মত একাকী কবির যাপিত জীবনও এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা, সেই অভিজ্ঞতার অগণন অনুভূতিমালায় প্রত্যহ অনুরণিত হয় পৃথিবী প্রকৃতি ও মহাবিশ্বের আলোকিত নক্ষত্র সমূহ। জন্ম থেকে অদ্যাবধি চেতনার বলয়ে কবির অন্বেষণ শেষ হয় না, তার জীবন ও কবিতা এক, অভিন্ন। ঐ যে কবিতায় লিখে দিলেন অমোঘ সেই কথা। 'আমি লিখেছি আমাকে নিয়ে, আমি অন্য কাউকে নিয়ে কবিতা লিখিনি। সবই আমার দিনপঞ্জি। দিনপঞ্জি লিখে এতোটা বয়স হলো / দিনপঞ্জি মানুষের নিকটতম লেখা।' সেদিক থেকে 'অঘ্রাণের অনুভূতিমালা'ও অত্যন্ত নিকটতম লেখা। যেমন ভূগোলের সুদূরতা আছে তেমনি অন্তর্লোকের সুদূরতা আছে, সেখানে বিচরণের মজা একান্ত নিজের। যেমন তীর্থক্ষেত্র বৃন্দাবনে গিয়ে গান গাওয়া, আবার শ্রীমৎ ভাগবৎ গীতা পড়া। দু'টোই কবির কাছে অভিন্ন আনন্দ এবং আশ্চর্যযভাবে রোমাঞ্চকর। বিশেষ করে 'প্রথম দু'তিন দিন বৃন্দাবনে গিয়ে আমি যে গান গেয়েছিলাম সেই গানটিই পুনরায় আমি গাইলাম বৃন্দাবনে-গীতা পড়া কী আরাম/ গীতা পড়া কী আরাম।' এর মধ্যে কী এমন আশ্চর্য শব্দ আছে? কিন্তু পাঠক দেখুন, শব্দ যে ব্রহ্ম তা অনুভব করা আমাদের কাছে সম্ভব হয় 'গীতা পড়া কী আরাম।' 'আরাম' শব্দটা ভাবুন।

বিশ্বযুদ্ধ মন্বন্তর, হিংসা, বিদ্বেষ, অপ্রেম, অবিশ্বাস, বিচ্ছেদের নির্মমযন্ত্রণা বিনাশী এক সহজিয়া শাস্তির নিবিড় আশ্রয় জেগে ওঠে। এর অর্থ ব্যাখায় সম্ভব নয়। পাঠক, নিজে পড়ুন, অনুভব করুন। বিনয়ের কবিতার ভুবন সতত অন্য এক গ্রহলোকে পাখা মেলে ওড়ে। যার ভিতরে নিবিষ্ট হলে 'ঈশ্বরীয়' স্পর্শ পাওয়া যায়। 'কী আরাম। কী আরাম। আত্মোপলব্ধির অনন্ত আশ্রয়-আনন্দ মথিত বিশ্রাম।

অসংখ্য কবিতার বলয় পেরিয়ে 'অঘ্রাণের অনুভূতিমালা' এখানে চেতনার প্রবাহ এলো। যেন অনন্ত পথ চলার দুঃখ বেদনা প্রেম দর্শন ও সত্যের বিরামহীন প্রবাহ। চেতনা-অবচেতনের স্তর ভেঙে মহাবিশ্বের কক্ষপথে বিচরণ। পৃথিবীর সর্বত্র আলোর দ্যোতনা; খনিজ দ্রব্য, উদ্ভিদ-প্রাণী-জীবজগৎ জড় ও নক্ষত্রপুঞ্জ সব কিছুর মধ্যেই কবি জীবনের সারৎসার খুঁজে পেলেন। নদী থেকে মহানদী, পয়ার থেকে মহাপয়ার। 'সরস্বতী পূজা-দ্বিতীয়', 'সকল বকুল ফুল', 'বিশাল দুপুরবেলা', 'কেমন মেহনা' কবিতাগুলি বিশ্বপ্রকৃতির অনুভূতিমালা।

'শতকরা একেবারে একশভাগ খাঁটি দর্শনের নাম সংজ্ঞা অনুসারে ধর্ম, মনে হয় চারিপাশে মহাকাশময় অনাদি সময় থেকে গণিতেরই মতো, বহু কবিতা রয়েছে চুপ চাপ পড়ে আছে কোনোদিন একে একে আবিস্কৃত হয় কোনো অঘ্রাণের রাতে রকুল বাগানে খুব মৃদু জ্যোৎস্নায়, সুডোল পাতার ফাঁকে, গহ্বরের মতো কিংবা ছিদ্রের মতন।

(সকল বকুলফুল)

'উপনদী যদি থাকে তবে বিপরীতভাবে মূল নদীটিতে পলি জমে, পলি ত্যাগ করে করে জল তার ভরটিকে ঠিক রেখে বয়ে যেতে থাকে। ফলে সব বুজে যায়, বোজে নদী বোজে মন, বোজে চোখ, মোহনা, কবিতা, ক্রমশ অপরিসর হতে হতে বুজে যায় পৃথিবীর পৃথিবী, জীবন।'

(কেমন মোহনা)

মহাপয়ারে লিখেছেন এ-সকল কবিতা। কল্পনা নয়। গণিত ও খাঁটি দর্শনের সঞ্চারণ কবিতার শিরা উপশিরায়। নদীর প্রবাহ জুড়ে যেমন সোনালি শস্য, গাছপালা, নগর সভ্যতার ধ্বংস ও নির্মাণ, সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সৌন্দর্য বর্তমান থাকে। পয়ার ও মহাপয়ার কবিতার চরিত্রও তাই। ফলে বিনয়ের কবিতা ভাবনার নিগূঢ় শিল্প প্রকরণে গণিত চিন্তার সঙ্গে কাব্য সৌন্দর্যের ক্ল‍্যাসিকাল রসায়ণটি প্রোথিত হয়েছে। তাঁর এই রসায়ন অনুভব করতে হলে কবিতার নিবিড়পাঠ ও ঘ্রাণ নেওয়া প্রয়োজন।

বিনয়ের কবিতা পড়া শুরু হয় কিন্তু শেষ হয় না। তাঁকে নিয়ে লেখারও শেষ নেই। বাংলা ভাষায় ঋষিতুল্য দুর্লভ কবির কবিতা বিশ্বকবিতার অলংঘনীয় অংশ। তবু শিমুলপুর 'বিনোদিনী' বাড়ির চাতালে গিয়ে কবির পাশে দাঁড়ালে ভেতরটা হু-হু করে ওঠে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাগুলো মনে পড়ে,- 'বিনয় তার বিদ্যুৎ চমকের মতন পংক্তিগুলি লিখে বাংলা কবিতাকে ধন্য করেছে, কিন্তু ক্রমশই জীবন থেকে সরে গেছে সে। তার কবিতা পড়ে আমরা বন্ধুরা বা পাঠকরা আনন্দ পেয়েছি, কিন্তু সে নিজে কি পেয়েছে? কিছুই পায়নি বলতে গেলে। এতটা না-পাওয়া কোন কবির সাজে না।' বিনয়ের সমকালীন এই কবিবন্ধুরা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন সত্য। সত্যিইতো এতদসত্ত্বেও তথাকথিত মান-যশ-খ্যাতি-অর্থ উপভোগময় প্রসন্ন জীবন তিনি পাননি। তাছাড়া পেলেই কী হতো? সমসাময়িক কত কবি, অ- কবিই তো সে অর্থে অনেক কিছু পেয়েছেন। তাতে বিনয়ের কী যায় আসে। অন্যদের প্রাপ্তি আর বিনয়ের প্রাপ্তির ভুবন আলাদা। শিল্প সহজে নড়ে না, সে বুকের ভেতরে বাস করে আর নাড়ায়। যাঁরা অবহেলায়, উপেক্ষায় ঘৃণায়, অপ্রেমে অথবা বুদ্ধির স্বার্থান্বেষী চাতুরতায় বিনয়কে সরিয়ে রাখেন তাঁরাও জানেন ভেতরে ভেতরে অগণন পাঠকের হহৃদয়ে সতত সঞ্চারমান। তাঁর বিরহাতুর বেদনাক্রীষ্ট জীবন, তাঁর প্রেম, আনন্দ, তাঁর অমোঘ সৃষ্টি, জ্ঞান ও দর্শন। এসব কিছুই আমাদের। কবিতার অলৌকিক ভুবনে আমরা বিনয়কে সর্বত্র দেখি। এমন দুর্লভ শাশ্বত কবিকে 'এ পৃথিবী একবার পায়, পায় নাকো আর।'

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন