জ্বলে ওঠা আগুনের ছায়া ও আলোর নাচ। যূথবদ্ধ, আষ্টেপৃষ্টে একে অপরকে জড়ানো- প্রতিটি শব্দের হাতে এক এক টুকরো আগুন। প্রতিটি শব্দের গলায়, নীচু, শক্ত উঠে আসছে প্রার্থনা। ডাকা হচ্ছে অশুভতাকে। স্বরের পরিবর্তনে, ডেন্ট্রিলোকুইজমে মনে ভয় ও বিস্ময় জেগে উঠেছে। স্বরের এই যে পরিবর্তন- এমন নয় যে এর মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই, কোনো প্রত্যাদেশ নেই। রাশি রাশি জ্বালানি দিয়ে তৈরি নরকাগ্নি, হেলফায়ার, নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছু। শব্দের ক্ষমতা নেই ইচ্ছেমতো এই মায়াস্বর সৃষ্টি করা বা সহসা ছেড়ে যাওয়ার যদি না আগুনের তাপে, বিকিরণে, রঙের পরিবর্তনে তেমন কোনো নির্দেশ বা সঙ্কেত থাকে। জ্বলে থাকা আগুনের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে শব্দের শরীরেও জ্বলে ওঠে আর এক ধরনের আগুন। হাতে ধরে রাখা টুকরো আগুন সেই শব্দের শরীরে গলে মিশে এক হয়ে যায় তখন। সেই অশুভ শক্তি জেগে ওঠে শব্দের মধ্যে- শেষ পর্যন্ত, যা, কবিতা হয়ে উঠবে।

এটা তো ঘটনা যে সত্যিই তেমন কোনো কাজ কবি করেন না, যদি না তিনি ত্রাণ দেন নিরাময় দেন পাঠককে। একজন খাঁটি ডাইনি চিকিৎসকের মতো শব্দকে Sham থেকে মুক্ত করে, যিনি ওষুধ মাখিয়ে দেন তার সর্বাঙ্গে, যে ওষুধ তৈরি হতে পারে parsley, aconite, belladonna, ঝুল, বাদুড়ের রক্ত ও শিশুর চর্বি থেকে। চারপাশের স্পেস বাড়িয়ে তিনি উড়তে প্ররোচনা ও প্রশিক্ষণ দেন শব্দকে। এইটুকুই তো কাজ কবির! শব্দের কাঁধে ইচ্ছে-ডানা জুড়ে অনন্ত শূন্যতায় তাকে ছুড়ে দেওয়া ছাড়া আর কীই-বা করতে পারেন তিনি!

পারেন। একজন কবিই হচ্ছেন শব্দের সমূহ রোগলক্ষণ জানা উইচ-উক্টর, শ্যামান, মেডিসিনম্যান। তিনিই পারেন উত্তেজনা সম্মোহন ও দিবাস্বপ্ন এনে দিতে শব্দের আত্মায়। দরকার নেই জানার কীভাবে করেন তিনি সেটা। জড়িবুটি গাছগাছড়া শেকড়বাকড় কুমিরের কলজে পশুনখ অস্ত্রের কী বিপুল সংগ্রহ যে তাঁর- তা জানার চেষ্টা জানার ইচ্ছে কোথায় আমাদের? জানার দরকার কোথায়?

দরকার থাকে কিন্তু। শব্দের ভেতর এক অশুভ শক্তি ভর করে- যখন সেই শব্দ কবিতার, সেই শব্দ কবিতার জন্য। যে মুহূর্তে এই অশুভ শক্তি আসে, কিছু একটা সরে যায়। শব্দ থেকে- যা রেফারেনসিয়াল। কোনো কিছু স্থির রেফার করা থেকে শব্দ তার ঝিমঝিমে লালাসিক্ত আঁঠালো শুকনো ঠোঁট তখন অনিচ্ছুকভাবে, অনাগ্রহে সরিয়ে নিচ্ছে। তার ঘোলাটে হলদে চোখে তখন অন্য কোনো জগতের শীতলতা, ছায়া। (ভাষাকে হিমায়িত না করে কবিতা সম্ভবই নয়। উচ্চতম উত্তাপময় শব্দগুলো- এমনকী 'উষ্ণ' এই শব্দের মধ্যে হাড়-কাঁপানো শীতলতা তখন) এমন নয় যে এভাবে ভাষাকে পুরোপুরি নির্বাসন দেওয়া গেল তার বস্তুজগৎ থেকে। কিন্তু চিহ্নিতের অন্ধতা, অনিবার্যতা থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করা হল ভাষাকে। ডাইনির পায়ের চামড়ার সংবেদনশীলতা যেমন সাধারণ মানুষের থেকে অন্যরকম, অশুভ শক্তিসম্পন্ন ভাষার 'বিষয়' বা 'চিহ্নিত' তেমনি হাওয়ায় ভেসে যায়, অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন দুধের রং হয়ে উঠতে পারে গাঢ় খয়েরি বা হিংসুটে সবুজ, একের পর এক শুকিয়ে যেতে পারে তাজা নাশপাতি গাছগুলো। কবি তখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না তাঁর ভাষার টার্গেটকে। পাঠকও আর 'উপভোগ' করেন না কোনো লেখাকে। লেখকের কবিতা আর পাঠকের কবিতার মধ্যে তখন একটি মজে যাওয়া জলাভূমি। একটা পুরোনো লোহার ব্রিজ, যার মরচে পরা পাতের ওপর ঝনঝন করে ওঠে দু-হাজার ঘোড়ার খুর।

কবিতার ভাষায় বা ভাষার কবিতায় থাকে এক দৃষ্টিশক্তি, এক ওভারলুকিং পাওয়ার। ওভারলুক বলতে সাধারণভাবে বোঝায় ওপর থেকে দেখা, কড়া নজর বা সার্ভেইল্যান্স, অথবা উপেক্ষা করা। কিন্তু যে মুহূর্তে 'পাওয়ার'- এই শব্দটি এসে জুড়ে যায় 'ওভারলুক'-এর সঙ্গে, তখন বিষ চলে আসে। দৃষ্টির বিষাক্ত চলে আসে। তখন ভাষার দু-পায়ের তলায় হাতের চেটোয় নুন রগড়ে গরম জলে দিলেও কোনো নির্বিষণ ঘটে না। স্বাভাবিক জীবনে আর ফেরানো যায় না তাকে।

সমস্যা শুধু একটাই। তাঁর নিজস্ব জাদুবিদ্যার জোরে ভাষার মধ্যে এই অশুভ শক্তি কবি আনতে পারেন না। যেহেতু কোনো কিছুরই নিয়ন্তা, নিয়ামক তিনি নন। এই জোর তাঁকে সংগ্রহ করতে হয় কোনো অশরীরী দুষ্টশক্তির থেকে- নীল তিমির মতো বিশাল ও অন্ধকার মাখা রহস্যময় এক ভাষার ক্রমপ্রবাহ থেকে। এই ভাষাকে তিনি অস্বীকার করবেন না। কোয়ান্টাম তত্ত্বের বস্তুকণার অনিশ্চিত আচরণের যুক্তিকে মাথায় রেখে তিনি বলবেন না, যা মাথায় আসে মুহূর্ত-কণায়, তিনি তা-ই লিখতে বাধ্য শুধু। তিনি জানাবেন না তিনি কী লিখছেন, তিনি লিখবেন না তিনি যা জানছেন- শেষতম নিয়ন্তার এই দর্পিত মুখশ্রী না থাকাই ভালো কোনো কবির।

কিন্তু দর্পিত মুখশ্রীই না থাকে যদি- কী বা অর্থ হয় তাঁর অশুভ দৃষ্টির, তাঁর সৃষ্টির, তাঁর আত্মদর্পণের।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন