নীরব নির্জনে দৃষ্টিভাষা চলেছে সময়প্রবাহের দিকে। নীরবতা যার নিত্যসঙ্গী সেও কিন্তু স্থির নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে আমাদের সমাজ, সে হাজার বছর আগের সীমায় থমকে গেল না তো! কিন্তু সত্য হল সমাজ চলছে, সভ্যতাও তার চলমানতাকে নানা চিহ্নের মাধ্যমে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরতে চাইছে। আর যে চলছে তার চলার মধ্যে বলাকথার বদলে যাওয়া চিহ্নগুলোও একটু একটু ফুটছে। অথচ অনেকেই গুছিয়ে বলতে পারে না যে আমাদের।

'ডুরে গামছার বয়স কত হ'ল কার পাশে বসে মুখ লাল হয়ে উঠলো নো নান্ না হ'য়ে উঠলো মানুষ'

(স্বদেশ সেন)

এই হল বদলে যাওয়া ভাষাচিহ্নের একটি অধুনাস্তিক উদাহরণ।

আমাদের প্রতিমুহূর্তের বাস্তব যখন একটু বড় পরিসরে পৌঁছায় তখন চারপাশে আশ্চর্য অস্থিরতার জন্ম হয়। আমাদের ভেতরে ভেতরে না-অস্তিত্বের খেলা চলে। কোথায় চলেছি আমরা! কোথাও কি হারিয়ে যাওয়ার সময় এল! না এই অস্থির কুসুমে আরেকটি বীজের জন্ম হবে নতুন আধুনিকতার হাত ধরে!

এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হলেই তখন বদলের ডাক আসে। স্বাভাবিক কৌতূহল থাকে সৃষ্টির উৎস নিয়ে। প্রতিটি ডাকের মধ্যে উৎসের সন্ধান। খুঁজতে খুঁজতে যাওয়া- আসার পথ বেয়ে আমাদের জীবন। যে জীবন শুধু গার্হস্থের নয়। কখনও শিল্পের, কখনও কবিতার, কখনও সভ্যতার। এক জীবন থেকে আরেক জীবনের জন্যেই আমাদের চলমানতা, সময়ের প্রবহমানতা। একে মানতে হবে।

ব্যক্তির জীবনসত্তারও একটা আঙ্গিক রয়েছে। নিজস্ব ভাষা রয়েছে। যে ভাষা আঞ্চলিক হতে পারে, আবার পরিশীলিত নাগরিক। কিন্তু ঐ জীবন যখন নিজেকে অন্য এক আঙ্গিক দিতে চায়, ভাষা দিতে চায়, তখনই দ্বিতীয় সত্তার জন্ম হয়, বা সত্তার দ্বিতীয়তা। কবিতা হল ব্যক্তিজীবনের এই দ্বিতীয় সত্তার প্রকাশ, নিরবচ্ছিন্ন নিহিতের প্রকাশ।

একজন কবি লিখতে লিখতে দ্বিতীয় জীবনে এসে পৌঁছান। সময় ও তাঁর প্রকাশের ভাষা নিয়ে এই দ্বিতীয় জীবন হল অতিক্রান্ত পথ। নিজেকে অতিক্রম করে অন্য এক আঙ্গিকের পথে সময় যেতে চায়, কবিও যেতে চান। যদি এমনটি না হয় তাহলে অসাড়তার জন্ম হবে। কবিও গতানুগতিক হয়ে পড়বেন।

একটু একটু খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে হয়তো পঞ্চাশ বছর পর দেখা গেল কবিতার দ্বিতীয় জীবন প্রথম জীবন থেকে একেবারে নতুন হয়ে এল, কিন্তু এই যাত্রাপথে প্রতিদিন একটু উন্মোচন আর অতিক্রম নিয়ে প্রবহমানতার ইতিহাস। ভাষাবদল আর টেকনিক বদল নিয়ে কবিতার বিবর্তনের ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস।

কবি যখন বদলটি টের পান, বলেন 'ফুলোৎসব', আর বলেন।

'ফুলোৎসব আজ। পাপ-দুঃখ কথা-কটা থাক্ না! চাগায় যদি গালচে গোটা করে ঢেকে দাও।

ফুলের মুখে মুখে কষ! বেশি করে আলো ফেলতে হয়।'

(দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়)

এই পথেই আলো পড়ছে আমাদের মুখে। পথের আলো, আলোর পথ হয়ে উঠছে। এই পথে ধারার সঙ্গে বিধারার একটা লড়াই লেগে আছেই। মানে ব্যতিক্রমের লড়াই, ঐতিহ্য ভাঙার লড়াই। তারপর চলতে চলতে মনের সঙ্গে চোখের সমঝোতা হয়। সমঝোতা ও বিরোধের মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসে তৃতীয় একটি পথ।

পথের শেষ নেই। আমাদের চোখসওয়া হয়ে গেলে মন আবার নতুন কিছু চাইবে। মন চাইবে, উসখুশ করবে কিন্তু বলতে পারবে না, বুঝে নিতে হবে। তা যিনি বোঝার তিনিই বুঝবেন। আর বুঝবেন কালচিহ্নের উপর নরম স্পর্শ রেখে, মনের পাতায়-

'শব্দের পাশে অসেতুসম্ভব শব্দের সেতুবন্ধনের খেলায়

নিঃসঙ্গ নির্জন একলামো মাখা পৃথিবীতে

যোগমান মন্ত্র শিখে নিতে...'

(সমীর রায়চৌধুরী)

সময়ের নিরিখে ভাব বদলায়, বিষয় বদলায়। কবিতার ব্যাখ্যায় অনেকদিনের একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে তার ভাববস্তু নিয়ে নিজস্ব অনুভবের কথা বলা, কিন্তু কবিতা তো বদলায় অবয়বের হাত ধরে। এই কারণে গঠন নিয়ে না বললে রূপান্তরকে পাঠক বুঝবেন কী করে!

কবির সঙ্গে পাঠকের সংযোগসেতুটি প্রথমত ধ্বনি। ধ্বনি আসে শব্দের মাধ্যমে। কিন্তু সেই শব্দ কী হলে, কেমন হলে পাঠক সহজসংযোগটি পেয়ে যাবেন তা নিয়ে বিভ্রান্তির শেষ নেই। দুর্বোধ্যতার অভিযোগ তাই চিরকালই কবির অলংকার হয়ে উঠেছে। যিনি আগামীকে চিহ্নিত করতে চান তিনি এই অলংকারকে স্বাভাবিক মনেই গ্রহণ করেন।

সাহিত্যের ভবিষ্যৎ স্পর্ধার জলে, আলোতে অঙ্কুরিত হয়। কবি তাকে লালন করেন, পালন করেন, কিছুটা দুঃসাহসিকতা দিয়ে।

বিজ্ঞান তো অনেকটাই অগ্রগতি দেখিয়েছে, যাতে সভ্যতারও বিকাশ ঘটেছে পরতে পরতে, তবে শব্দ নিয়ে আমাদের সংস্কার খুব পুরোনো। এখন ভেবে দেখা দরকার -

১. শব্দ কখনও একমাত্রিক হতে পারে না।

২. শব্দ দিয়ে চিহ্নিত বস্তুর ধারণাও চিরকাল এক নয়।

৩. শব্দস্থিত বোধ তার নির্ধারিত সীমা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লঙ্ঘন করে। ব্যক্তিও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অতিক্রম করে পূর্ববর্তী ধারণাকে।

এসব যদি না ঘটে তাহলে ধরে নিতে হবে কোথাও একটা গোলমাল আছে, যা স্বাভাবিক নয়। আমরা স্বাভাবিকতার লক্ষণগুলি চিহ্নিত করতে চাই, যা প্রবহমানতার সূত্র মেনে নতুন সম্ভাবনাকে ত্বরাণিত করবে। অন্তর থেকে অন্দরমহলে চলাচলের সরুপথ, মুখ বাড়িয়ে দেয় আরেকটি মৌলিকতা, দিশা হারাতে হারাতে আরেকটা দিশামুখ

'কী এক অমোঘ টান বোধের চাঙড় ভেঙে

গভীর মিথেন ডুবে যেতে পারলে পুনরায় পিতৃপুরুষের কথোপকথন -

ঘুম ও মহাঘুমের মাঝ বরাবর যাওয়া আসা

চোরাকুঠুরি, নিচেই গোপন সুড়ঙ্গপথ।'

(প্রত্যুষপ্রসূন ঘোষ)

সুড়ঙ্গটি কবি দেখছেন, পাঠক দেখছেন না। তাঁর জন্যে দিশামুখটি শুধু খুলে রাখা হল। কবির সঙ্গে পাঠকের সংযোগ তখনই সম্ভব হবে যখন পাঠক নিজে থেকে কবির দিকে এগিয়ে আসার জন্যে পা বাড়িয়ে দেবেন। বোধের দরজাটি খুলে যখন কান পেতে শুনতে চাইবেন সেই আহ্বান, যা একমাত্র পাঠকের জন্যেই নির্ধারিত। তাহলে আর কোনও তর্ক নেই, বিভ্রান্তি নেই। একে অন্যের সঙ্গে ধ্বনিতে ধ্বনিতে সম্পৃক্ত হতে থাকা। ভাবনার অংশীদার হতে থাকা।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় অনেকেই নিজের বোধ এবং সময়ের সংঘাতকে চেতনা দিয়ে, বিশেষ করে বিজ্ঞানচেতনা দিয়ে অর্থাৎ যুক্তি-তর্ক-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঝেড়ে-বেছে গ্রহণ করতে পারছেন না। তাহলে কি বলতে হবে জীবনানন্দর পর বাংলা  কবিতার একটি স্বতন্ত্র সুর বা মেজাজ বা ঘরানা এতদিনে জমে ওঠার প্রয়োজন ছিল, তা এখনও সম্ভব হয় নি?

কোথাও কোথাও বলা হচ্ছে- যা পেরিয়ে এলাম তা একেবারে অন্তঃসারশূন্য। কেউ কেউ ঘোলা জলে মাছ ধরা দেখেছেন। পাঠককে কবিতাবিমুখ হওয়ার পেছনে কবিদেরই তাঁরা অভিযুক্ত করছেন। কিন্তু সময় বসে থাকে না। তলে তলে ফল্গুধারার মত বদলের হাওয়া বইছে, তাকে প্রাণে নিলেই প্রাণে প্রাণ মিলবে।

প্রচলিতের গা ঘেষে আরেকটি বিরুদ্ধস্রোত উল্টোমুখে বইবে, এটাই তো চলছে। তবেই না সৃষ্টির মনের কথা খোলসা হয়ে ওঠা। এর মধ্যে নিজেকে আবার সবার থেকে আলাদা করে দেখানো কারও কারও ভেতরবাড়ির স্বভাব। তাতেই একজন মাইকেল হয়, রবীন্দ্রনাথ হয়, বা জীবনানন্দ। এভাবে সময়ের সঙ্গে থেকে স্বকীয় হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা বা একজন কবির নিজস্ব সাধনা নিয়ত চলতে থাকে। সময়ের বিবর্তনে সমাজের প্রবণতাগুলো যেমন পাল্টাতে থাকে, সামাজিক ভাষাও পাল্টায়। একজন যথার্থ কবি তার ইঙ্গিত পান অনেক আগে থেকে। এই কারণে সামাজিক ভাষা বিবর্তনের পূর্বেই কবির ভাষার আগে-পিছে আলোড়ন ওঠে। নতুন ভাষায় কবি নিজেকে প্রকাশ করতে চান, যা শুরুতে আমাদের কাছে বুঝে ওঠা দুরূহ, আমরা বলি দুর্বোধ্য। কিন্তু কবি দেখেন-

'তোমার আধ-বোজা নাভিচোখ

জানলার মতো শুয়ে আছে কবির শরীরে

সারারাত শৃঙ্খলা জেনেছে

নাঘুম কমলালেবু

গ্লাস ভর্তি রাত -'

(পীযূষ ধর)

সামাজিক প্রবণতাগুলি এভাবে কবিতার শরীরে ভিন্নমুখ হয়ে ওঠে। সাহিত্য যাকে ধারণ করছে তার তিনধারা। ক্রমবিবর্তনের মধ্যে এই তিনটি ধারা একটি চাকার মত ঘুরছে, প্রথমত, ঐতিহ্য- যা সহজে গ্রাহ্য তাই-ই ঐতিহ্য। কবিতার ক্ষেত্রে বলা হয় মূলধারা। দ্বিতীয়ত, ঐতিহ্যের বিস্তার- সহজের মধ্যে কিছুটা অসহজকে সহ্য করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। প্রচলিত ধারার মধ্যে বহুব্যবহারে যা ক্লিশে বা গতানুগতিক হয়ে ওঠে তাকে পরিশীলিত করা, প্রয়োজনে বর্জন করা, পাশাপাশি নতুন ব্যঞ্জনার উদ্ভাবন বা অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সাহিত্যের ভাষায় একটা নতুন গতি সঞ্চার করা। এখানে কবি যেমন ব্যবহার করলেন 'আধ-বোজা নাভিচোখ', 'নাঘুম কমলালেবু' বা 'গ্লাস ভর্তি রাত'-এর মত শব্দবন্ধ। এতে চেতনারও সম্প্রসার ঘটল।

এই দুটি ধারাকে জনপ্রিয় এবং ক্লাসিকও বলা হয়। এর গা বেয়ে তৃতীয় একটি ধারা বইতে থাকে, যাকে ঐতিহ্যছুট বা ঐতিহ্যবিরোধী মনে করা হয়। যেকোনও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ এই তৃতীয় ধারার উপর নির্ভর করে। পণ্ডিতরা অন্তত তাই-ই মনে করেন।

তো ঐতিহ্যের বিস্তার নানাভাবে হয়। কেউ কেউ কাজটি সচেতনেই করেন, আবার অনেকে সমযে দাঁড়িয়ে প্রচলিত ধারণার বিরোধিতাকে মেনে নিতে পারছেন না অথচ অবচেতনে নতুন উপাদানের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন, এসব ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় তৃতীয় ধারার কবিরা মূলধারার অস্তিত্ব স্বীকার করেও গ্রাহ্য করছেন না, আর মূলধারার কবিরাও অন্যধারার অস্তিত্ব স্বীকারই করছেন না। এতে রূপান্তর কিছুটা ব্যাহত হলেও চাকাটি তলে তলে ঘুরেই চলেছে। মূলধারা ক্রমাগত নিজের চলাচলের মধ্যে সেতু ছুঁয়ে ফেলে। সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে একে অন্যের মধ্যে। এভাবে লক্ষ্য করা যায় বিরুদ্ধস্রোত যখন অধিকাংশের গ্রাহ্য হতে থাকে তখন সেটাই প্রচলিত বা মূলধারা হয়ে যায়। এরকম অবস্থায় আবার একটি তৃতীয় ধারা বা স্বর জন্ম নিতে চায়। শিল্প-সাহিত্যের রূপান্তরের ইতিহাস এমনই। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন