"চোখের ভাষা, সে, চোখে, হ্যাঁ, পারে না, রাখতে, চোখ। তাই চোখের ভাষা আ আ আ আ জানে না। জানালা, ও, ওটা... পাখি...দ্যাখাটা, তাকে, সোজা, দেখাতে পারেনা!অনেক ঘুড়ি (যেন চেনা, পাখির মতো, নাকি মাছি!) রং নিয়ে ওড়ে... চেয়ে থাকতে থাকতে লালায় বুক ভরে যায়।গন্তব্যের চেয়ে পথ-সর্বস্বতা মুখ্য হলো; যুযুধান পক্ষগুলো অস্ত্রের নির্দেশে বারংবার পন্থার অকাট্য দেখিয়ে দিচ্ছে।
মনের ভাষা, মনের মধ্যে দিয়ে মনের মধ্যে চলে যায়। টাকার ভাষাও মনের মধ্যে দিয়ে চলে যায়। মনের ভাষা, বাহ্যিক সম্পদের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায়।"
এই কথা কে বলেছিল, বড় নাকি ছোট গোঁসাই, উপলা ঘুমের ঘোরে মনে করতে পারে না।
**********
গ্রাম জুড়ে রসের ভিয়েন। গ্রাম জুড়ে মেলা, তিন দিন। আজ চতুর্থ দিন ভাঙা মেলার ডাক। বড় গোঁসাই এর দীর্ঘ দিনের মাজা ঘষায় এই মেলার নামডাক সাত গ্রাম জুড়ে। কত কত দূর থেকে কেত্তনের দল বায়না করে আনেন বড় গোঁসাই। কিভাবে জগত ঘোষের নাম গোঁসাই হলো, উপলা আজও জানে না। সেভাবেই ছোট গোঁসাই কেন যে ওই নাম পেল। ভাবে উপলা আর নিজমনে কুটোপাটি হাসে।
বড় গোঁসাই রীতি মেনে বড় বড় কথা বলে। উপলা আপন খেয়ালে শরীরের নানাখানে হাত বুলোতে সেই বাণী শোনে।...
শরীরে হাত বুলোতে বুলোতে সরেস কল্লে বয়স; কথার কথা অনেক বলতে চাইলে, হরি-নাম কর ওই সুধামুখে, বাবু! ওই সাইজের কথাবার্তা না পেলে ইঙ্গিত করতে পারো না, বাবু, সহজ-গোঁসাই! কথায় কথায় হাওয়া ভরি হয়, তারই তো দাম। এক টাকায় পাঁচ খানা কিনে হাওয়া ভরে ভরে ভরে পাঁচ টাকায় এক খানা বেচি। ফানুসে পিন ঠেকাতে চাও কেন উপলা। এসো, নিজেদের ফুটোয় ফুঁ দিয়ে দিয়ে জীবনটা মহিমাময় করে তুলি। বড় করে তুলি। বাজারে বড়র দাম বেড়ে যায়। ছোট এক কোনে অবিক্রীত পড়ে থাকে। উপলা রে, বড় হয়ে ছোটর দুঃখ বুঝি। কিন্তু ছোট তো বড় হবার প্রয়াস করতে পারে। কিন্তু যেন বড় কে ডিঙিয়ে যাবার ছোটলোকি না করে, এই হলো সার কথা। কী বলিস, উপলা?
উপলা বলে,
চল্লিশ থেকে চার বাদ গেল গোঁসাই, থাকল ছত্রিশ। মাত্র এই ছত্রিশ বছর বয়সে কত ফুঁ দিলাম কত সাধের ফুলে ওঠা জন্তরে হে হরি। সব্বাই মিছিমিছি ফুলতে ভালোবাসে।
সোজা ছত্রিশ না বলে অত ঘুরিয়ে, চল্লিশ থেকে চার বাদ দিয়ে, কায়দা করতে গেলে কেন, শুনি!
চল্লিশ বছর বয়স থেকে, বড় গোঁসাই এই চার বচ্ছর তোমার সনে থাকা হলো। চার বচ্ছর আমি লতা, তুমি তরু হে! রাখ্নি হয়ে আছি। আহা কী সুখে আছি হরি হে! রাধে, রাধে! তাই ভাবলাম চারটি বচ্ছর জীবনের পরমায়ু বিদ্ধি পেলো বুঝি! কেবল তো ক্ষতি লেগে আছে গোসাঁই, এই ভবজ্বালায়। বিদ্ধি আর কই? তোমার মতো সাধু-সংগে আয়ু বেড়ে যায়। আহা, কত সুন্দর, সুলভ, আনন্দ ইথইথই, দেহপাখি!
তোকে দেখে আমি জীবনের দাম টের পেলাম উপলা, বুঝলি রে সখি?
আমার আবার মূল্য আছে গোসাঁই। তুমি ছুঁয়ে দেখেছ তাই দাম উঠল। আমি কী দেয়ে মিটাব এই ঋণ? কী আছে আমার বলো দিকি।
খানিকটা হাওয়া, তাতেই কেনাবেচার বাজার ধরে ফেললি রে? কতকিছু ধরে ফেললি তুই, তুই যে আমার গুরু রে উপলা...
সে-কী! পাপ হবে গোঁসাই এমন কুলুক্ষুনে কথা ভাবলেও, এ কী কথা বলো গো, হ্যাঁ!
তোর সুগন্ধে দেহমন উতলা হলো উপলা...
শিহরণ হয় গো বড় গোঁসাই, তোমার মুখে এত উঁচু উঁচু কথা নিজের নামে শুনলি পর...
তোর শরীরের সুবাস সুঁঙ্গিয়ে সুঁঙ্গিয়ে ভবজ্বালা পার করে দে উপলা... পাপ্ড়ি মেলি ধর... কুসুম গন্ধ উপচে পড়ুক যতেক তত্বের কলসী!
তোমার তো সংসার আছে গো বড় গোঁসাই! সেই ঠিনে মন দাওনা ভালো মতো। আমি পথের ধুলো, নিচ্ছুপ পথেই থাকি না কেন, জীবন যে জটিল হয় বাবাজি!
কিন্তু ছোট যেন বড় কে ডিঙিয়ে যাবার ছোটলোকি না করে, এই হলো সার কথা। কী বলিস, উপলা?
সে তো বুঝি আমিও বড় গোঁসাই। কিন্তু একটা উপায় বলো দিকি, চিরতরে কাহিনিতে ইতি টানি কী ভাবে? তখন শুধু তুমি আর আমি, মাঝে কোনও আবর্জনা থাকবেনি...
বলব, বলব রে উপলা... সময় আসুক ... সে যে বড্ড কঠিন উপায়...
সব পারব আমি বড় গোঁসাই, আমাতে ভরসা রাখতে পারনি?
***********
কেত্তন আর মেলা শেষ হতে, বড় গোঁসাই খানিক বাড়ির পানে যেতে না যেতেই এক দিন উপলা এসে অনুযোগ করে, ও ছোটোগোঁসাই, বল তো, ওই বেটা ষাঁড়টার কি অমন নিদ্দয় হওয়া সাজে। আমার এই সাবেক কালের সবেধন বাসা। তাই চিরকেলে নোনা ধরা। আজন্ম স্যাঁতা। বেটা ঘাপটি মেরে এসে যখন তখন আমার দেওয়াল চাটে। বাপরে কী সাংঘাতিক জিভ। চাটতে চাটতে এমন কাবু করে ফেলেছে গোড়া থেকে, যে হুড়মুরিয়ে পড়লো বলে!
কী আর করবে সোনা রে আমার? ওই ষণ্ডামার্কা ব্যাটা কেজিবি না সিয়াইএ কে জানে। তুমি গুটিসুটি মেরে থকো বাপু। ধনতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র, মাঝখানে কিছু না পেলে স্যান্ডউইচটা টেস্টি হয়না।
তোমার আর কী ছোটোগোঁসাই। ঘরখান গেলে থাকব কোথায় বল দিকি?
আচ্ছা থামো উপলা, তোমার জন্য একখান কিছু করতে হয়। দেখি দেখি বিডিওকে বলে যদি কোনো আবাস-যোজনা থেকে কিছু পারা যায়।
কর দিকি গোঁসাই। আমার তো কিছুই নাই।
সে কী গো রাধে রাধে! কিছু নাই কী গো! অ্যাঁ!
দুত্তেরি...বড় গোঁসাই দেকলি পর রাগ করবে নি! ...ব্যাথা হয়! ছাড়ো!
ব্যাথা হয় তোমার?
আমিকি মানুষ না, নাকি ছোটোগোঁসাই? টাকা নিই তাই অমানুষ? পরিষেবা নিবা মাগনা-মাগনি, না? আবার ডগায় ঘা হলি পরে কনজিউমার ফোরামে যাবা? চালাকি? এখন আমিও আওতায় এসে গেছি, জানো তো? কত গোঁসাই এলো গেলো/ শেষে খ্যাপা ঘাটে ভিড়লো! হাঃ হাঃ হাঃ !
এতে আবার হাসির কী হলো বলো দিকি! আমাকে বোকাচোদা বানিওনা বলি দিচ্চি কিন্তু!
এই কিসের আওয়াজ গো, বড় গোঁসাই এসে পোল্লো বুঝি, জানতি পাল্লি রাগ করবে!
ওই শুকরনন্দন তোকে কত সোনা দানা মোহর আসরফি দ্যায় রে বল দিখি?
টাকায় স-অ-ব কিনবা ছোটোগোঁসাই?
জীবের প্রাণ ব্যতীত সকলই-। কিনেছিও বহু কিছু! তোকেই তো! এই তো! এই তো তোর এই যে এই যে এই যে এইটা! এই এইটা! এই এইটা! কিনেছি কিনেছি কিনেছি! আমি বিশাল ক্রয়ক্ষমতা দিয়ে একদিন আমেরিকা কে কিনে নিব উপলা! দেখবেন আপনি!
আমেরিকাকে কেন? নোংরা একটা দেশ! যেখানে সেখানে বোম মারে! রোজ রোজ মেয়েদের রেপ করে কত কত! থুঃ! কিনলে একটা বরং সুন্দর ছিমছাম জায়গা কেন।
কোন দেশ উপলা?
সে বলবোখন! কিন্তু দেখো বাবাজি! আমার শেয়ার রেখো ভাই, যা করবে তাতে। আধা-আধি হবে না?
কী?
শেয়ার? দেশের? যে দেশটা কিনবে?
গোটাটাই নাওনা নাওনা নাওনা! এই নাও না!
ছাড় হারামি! বড় গোঁসাই এসে পল্লে লাথিয়ে বেন্দাবন দেকিয়ে দেবেখন বলি দিচ্চি!
বড় গোঁসাই আসবেন নি হঠাৎ রে ভাই উপলা, বুঝিস না বুঝি? তিন দিনের কেত্তন সবে খতম হলো, কত্ত চাল ডাল আলু কলা জমেছে, বচ্ছর ভরের রসদ, সমস্ত ঘরে রাখতে গেছে যে এই কুটির ফেলে আমার জিম্মায়, বুঝিস না?
টাকা? আর টাকা কত উঠল গোঁসাই কেত্তন থেকে? টাকা উঠেনি?
উঠেছে না তবে? এমনই নাকি! একটা ছোট হাতি ভাড়া করে সব নে গেল না ঘরে?
গাড়ি করে টাকা?
আরে শুধু কি টাকা রে? নে, হাত বোলাতে থাক, থামছিস কেন, হ্যাঁ ধর না, বেশ তো ধরছিলি, ধরে থাক থাক থাক থাক...
বলি টাকার কথাটা চেপে যাও কেন গো ছোট গোঁসাই, কত উঠল বলো?
তোর জানা নাই উপলা? তুই ভাগ পাসনি? বল?
সে আর কী এমন ছোট গোঁসাই, যা চাট্টি বাটিতে ছুঁড়ে দিল, পেলাম। আমি হলাম গে চির ভিখারী!
কেন? সমস্ত মেলা তো তুইও সামলালি? কেবল গতর খাটার দাম? বখেরা দেয়নি?
ছোট গোঁসাই গো, ও গোঁসাই, বলি তুমি পাওনি? কাল রাতে নিজের সংসারে চুপিচুপি তবে কী রাখতে গেছিলে? ইস, থামো, আমার হাত নোংরা হবে যে! ঘরের গত্ত কি পুরোই বুজিয়ে গেছে গোঁসাই, এমন আদিখ্যেতা করো যে!
উপলা রে, দেখিস, বড় গোঁসাই দেহ রাখলে আমি তোকে এই রাজ্যপাটের রাণী বানিয়ে রাখব... হ্যাঁ... মুঠোয় নে... উপলা... সব উপার্জন তোর হবে তখন, আমি চারক হয়ে ... ওহ আলগা করিস নে মুঠো আলগা করিস নে ... শোন না, তখন চাকর করে রাখবি নি? আমায়? রাখবি নি? অ্যাঁ?
কিন্তু বড় গোঁসাই কি হুট করে ভব পারে যাবে গো ছোট গোঁসাই? গাছের ফল পেকে কবে মাটিতে পড়ে, সেই পথে চেয়ে চেয়ে যে দুই চোখে ছানি পড়ে যাবে! কিছু উপায় বলো দিকি!
বলব, বলব রে উপলা... সময় আসুক ... সে যে বড্ড কঠিন উপায়...
সব পারব আমি বড় গোঁসাই, আমাতে ভরসা রাখতে পারনি?
**********
বড় গোঁসাই একদিন আবার আচমকা ফিরে আসে কুটিরে। একটু বেশি দিন থেকে গেছিল ঘর পানে। ঘরের সব দৈনন্দিন গুছিয়ে দিয়ে এলো বুঝি রোজগারের জগতে। জগৎ মায়া দিয়ে ঘিরে রাখে কথায় কথায়। জগতের জনগণ বছরে তিন চার দফা কুটিরের নিকট মাঠে ভির করে কেত্তনে, মেলায়, উৎসবে। এই সমস্ত বড় গোঁসাই নিজ হাতে ক্রমে গড়ে তুলেছেন। সেখানে উপলা আলো করে থাকে।
নিভৃত হলে উপলা তখন কাছে আসে। বলে, আমি তোমায় মন দিয়েছি বড় গোঁসাই। শরীর যে লিবে লিক।
উপগত হতে হতে বড় গোঁসাই, অধার ভোটার রেশন জমির দলিলে নাম যার কার্তিক রায়চৌধুরী, উপলার কানের লতিতে ঠোঁট ঠেকিয়ে বাণী-সম্ভব উচ্চারণে বলে, দেহ মন আলাদা কিছু নয় রে উপলা, মন দিলে দেহে বাধা কোথায় আর দেহ কি মন বাদ দিয়ে হয় গো সোনা? বোকা মেয়েটা এতদিন সাধুসঙ্গ করে, শেষে কি কিছুই জানলো না দেখছি!
উপলা তখন উপগত দেহটিকে প্রবেশ-সহজ ভঙ্গিমায় সহজ করতে করতে আরও বলে, গোঁসাই গো, তুমি বিনে আমার কী হবে কও, কে দেখবে আমায়! ছোট গোঁসাই তো শুধু দেহ দেহ করে , ভয় হয় বুঝি কখন অশুদ্ধ করে ফেলে! শুদ্ধাচার শেষ হলে ভেসে যাব যে, কী দিয়ে সেবা করব তোমার, কোন মুখ দেখাব তোমাকে!
মনে কালি না লাগলেই সব শুদ্ধ রে পাগলি...
কিন্তু জনম জনম যে তোমাকে দেখতে চাই, তোমার নাম জপে উদ্ধার হতে চাই গোঁসাই!
তাতে বাধা কী উপলা? গুরু নামে কী বাধা বলো?
আমারে বাঁচার উপায় দিয়ে যেও গো সখা, যেন তুমি না থাকলে পর ওই ছোট গোঁসাই শকুনটা ছিঁড়ে খেতে না পারে... অর্থের নির্ভর থাকে যেন এমন গুরুর দয়ায়, নিজে হাতে ভক্তদের মঙ্গল করতে পারি বাকি জীবনটা, কারও কাছে আর হাত না পাততে হয়!
আমি কোথাও যাব না রে খেপি, এই এই এই তোর দেহে লীন হয়ে চিরকাল ভেসে থাকতে চাই...
তুমি সেই কবে তিন কুড়ি বয়স পার করেছ গোঁসাই, আর আমি দুই কুড়ি। এখন কি আর বীজ বপন হবে না? দেরি হয়ে গেছে খুব? তোমার ফল পেটে ধরতে বড্ড সাধ হয় যে গোঁসাই!
এত শুনে বড় গোঁসাই কর্মক্লান্ত শরীরে উঠে বসে ও গামছা দিয়ে নিজের শরীরের ঘাম মোছে। তারপর উপলার শরীরের ঘামও যথোচিত যত্নে মুছতে মুছতে নরম সুরে বলে, এই যে মেলা গো উপলা, আহা কত মানুষ মাখি। মানুষের পায়ের ধুলো বুকে মেখে থাকি, ধন্য হয়ে যায় এই তুচ্ছ ভবজনম। এই সবই তোমার আলোয় ভরে থাকে...এই সমস্ত ভক্তকূল তোমার উপলা, এরাই তোমায় দেখবে...
সে তো দেখবে বুঝলাম গোঁসাই, যদি তোমার তিন বেটা আর এক বেটি ভাগ নিতে হাজির হয়? যদি তোমার সংসারের মাগীটা কোমরে কাপড় জড়িয়ে ঝগড়া করতে আসে আর আমারে কুটির থেকে দূর করে দেয়? একটা স্থায়ী বন্দবস্ত কি হয়না গোঁসাই?
কার্তিক রায়চৌধুরী গভীর হাসি হাসে, এই ভবে স্থায়ী কি কিছু আছে রে! সবই অনিত্য, সবই মায়া! এতো বলে গোঁসাই তাকে হঠাৎ কাছে টেনে কী না জানি কায়দা করলো, উপলা বলল, উঃ!
***********
"মানুষ একটা এমন উজবুক প্রাণী উপলা, যে নিজের শাসক নিজে "নির্বাচন" করা কে নিজের কৃতিত্ব ও সফলতা বলে ভাবে। তাকে ওইভাবে ভাবতে শেখানো হয়েছে। সে এই প্রমোদ-মত্ত দুনিয়ায় এমনই মশগুল, এই প্রশ্ন করতে পারে না, যে, মুক্তির স্বাদ ঠিক কী রকম!"
এই কথা কে বলেছিল, বড় নাকি ছোট গোঁসাই, উপলা ঘুমের ঘোরে মনে করতে পারে না।
"প্রজা গাছ থেকে পড়ে না উপলা, প্রজা তৈরি করতে হয়। আর নিজেকে ধীরে ধীরে রাজা হিসেবে গড়ে তুলতে হয়। সাম্রাজ্য, ছোট হোক বড় হোক, রাজার পায়ে গড়াগড়ি খায়। প্রজার বিবেক নিয়ে খেলা করে জীবন সহজ করতে হয়।
এই কথা কে বলেছিল, বড় নাকি ছোট গোঁসাই, উপলা ঘুমের ঘোরে মনে করতে পারে না।
********
টাকায় স-অ-ব কিনবা ছোটোগোঁসাই?
জীব-দেহের কাম ব্যতীত সকলই-। কিনেছিও বহু কিছু!
তবে এই যে আমারে টাকা দিলে, এই যে আমি শরীর খানা নিয়ে এগিয়ে গেলুম তোমাপানে গোঁসাই? তুমি বলো কী! কিনতি পাল্লা না আমারে?
না রে পাগলি, কিনতে পারি নাই। তোর কাম, কামনা, কিনতে পারি নাই।
তোমারে যে শুতে দিলাম গোঁসাই চিৎ হয়ে, যেমন বল্লে তেমন উপুড় চিৎ ঊর্ধ নিম্ন! বেলাউজের ফাঁকে নিজে হাতে টাটকা কখান নোট গুঁজে দিলে যে! বলো কী! কিনতি পারনি আমারে?
না উপলা। তুমি আমায় কামনা করনি দেহ দেবার সময়। লোকে ভাবে বুঝি শুধু প্রেম খরিদ করা যায় না, হাঃ হাঃ! উপলা গো, শরীর মানুষ কিনে কেন বলো? কাম হেতু, তাই না, রাধে রাধে? খরিদ করে কামও মেলে না উপলা।
গোঁসাই গো, আমার গতরের গুমোর এভাবে ভেঙে দিও না গোঁসাই, হরি হে, মাধব!
শরীর দেওয়া সহজ নয় রে উপলা, শরীর নেওয়াও ভারি কঠিন...
এমন কেন গো গোঁসাই? আমি কি তবে নিজেকে বেচতেও পারিনি ঠিকমতো? তোমার সাথে তঞ্চকতা করেছি?
কাম হীন শরীরের কী দাম উপলা? টাকা দিয়ে তোকে কিনে নিজের বিষ নিজে ঝেড়েছি। বল, ঠিক কি না? একবার আবেগে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিলি? বল? দেহ দিলেই কাম দেওয়া যায় না রে... রাধেশ্যাম! হরি হরি!
আহা, কী যে আলো করে দিলে মাথাটা গোঁসাই... আচ্ছা, তোমার জাঙে বড্ড লোম গো, গায়ে ঠেকলে কেমন ভয়ে শিউরে উঠি...
কী প্রসঙ্গ থেকে কোন প্রসঙ্গে চলে যাও উপলা...
মনে বড্ড হীন ভাব হচ্ছে গো গোঁসাই, টাকা নিয়ে তোমায় ঠকিয়ে দিয়েছি বলে মনে হচ্ছে। এসো, একটু গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে যাই... তোমার জাঙের লোম আলতো করে হাত বুলিয়ে দিই, আরাম পাবেখন, এসো!
উপলা, আমাদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের হৃদয়ে প্রেম না জন্মালে, বলো, কাম আসবে কোথা থেকে? ওসব তো অনেক হলো রে পাগলি, আর নিরর্থক শরীরে শরীর ঘষে কী হবে? বলি কী, রধে রাধে, শরীর নিয়ে এমন প্রেমহীন খেলায় পাপ হয়, এসব এবার বন্ধ করার পালা উপলা।
তোমার মতো রতিবাজ মানুষ অমন নিরিমিসি থাকতে পারবে গোঁসাই? বড্ড ভয় করে, আগুন চেপে রাখতে রাখতে নিজে পুড়ে না মর! বা, কোথায় মাথা গরম করে রাস্তাঘাটে খানিক খুনখারাবি না করে বসো!
না গো উপলা ... তেমন হবে না। আমি নিজেকে অনেক বুঝিয়ে আজ এসব কথা বলছি।
তাই বললে হয় গোঁসাই, আমার ভয় করে না? আমার দায়িত্ব নেই কিছু? এসো, শোও দেখি, হাত বুলিয়ে দিই... দেখো, আরাম পাবে ... মন শক্ত হবে.. উঠে দাঁড়াতে হবে গোঁসাই, ভেঙে পড়লে চলে? এসো দিকি, নখরা কোরো না...
শোবো না উপলা। শোবো না আর...
ও গোঁসাই, না শুলে তবে টাকাও দেবে না? কী গো? বলো না?
সে কি হয় উপলা। দুম করে টাকা বন্ধ করলে তোমার কত অসুবিধে হবে বলো? আমি কি অতই নিদ্দয় উপলা?
সে কী গো গোঁসাই, না শুয়েই টাকা দিবা? হরি হে!
এতদিন যেটা করেছি, সেটাকেও শোওয়া বলা যায় না উপলা... হিদয়ে হিদয় না মিললে শুয়ে কি পরমের প্রাপ্তি হয় উপলা? তাহলে? তখনও, তেমন হেলাফেলার শোওয়াতেও যদি টাকা দিতে পারি, এখনও পারব সোনা, ও নিয়ে চিন্তা কোরো না।
তোমার তো গোঁসাইগিরি বাদেও সরকারি টাকা আসে ঘরে, মাস্টারি করো তুমি ইস্কুলে। আমার কী আছে বলো তো! এই চাট্টি মাটির শরীর, আজ আছে তো কাল নেই, শুকিয়ে অফলা হয়ে যাবে। তখন ভিটেয় ঘুঘুও চরবে না!
আমি যে আছি রে পাগলি...
ও ছোট গোঁসাই, আমি তোমাকে ভালবাসব ছোট গোঁসাই...
তাতে তো বাধা নেই, চেষ্টা করে দেখ। তুমি যদি সফল হও, আমি ঠিক টের পাব উপলা...
গোঁসাই, আচ্ছা বলো তো, তুমি কি আমারে ভালোবাসো?
সে কথা তো আমার চেয়ে বেশি তোমার জানার কথা উপলা।
********
উপলার মৃতদেহ কুটিরের উঠোনে তুলসী তলায় শোয়ানো, সাদা কাপড়ে ঢাকা।
সাত গাঁয়ের লোক খবর পেয়ে আসতে শুরু করে।
ছোট গোঁসাই আর বড় গোঁসাই বিমর্ষ ভঙ্গিতে বাঁশের খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে বারান্দায় বসে।
হরি হে! বড় গোঁসাই বলে।
মা ধ ব! ছোট গোঁসাই বলে।
সাত গাঁয়ের লোক উপলার আচমকা বিষ্ণুধাম যাত্রা বিষয়ে আলোচনা করে। কত পুন্যি করলে গু মুত না ঘেঁটে মানুষ সগগে যায় সেই কথা লোকমুখে ফলাও হয়। সবই নাম ভজনের গুণ।
উপলার দেহ ত্যাগের তিথিতে প্রতি বচ্ছর বড় একখান উৎসব হবে এই নিয়ে সাত গাঁয়ের মোড়ল নিজ নিজ মত দেয়।
দুই গোঁসাই তাদের কথা চুপ হয়ে শোনে।
মাদ্রাজে কাজ করতে গিয়ে সেখানেই নতুন সংসার পেতে ফেলা জগবন্ধু মণ্ডলের বউ শ্যামলী আজ সকাল থেকে ভেঙে পড়া দুই গোঁসাই আর কুটিরের ভার সামলাচ্ছে।
জমা হওয়া লোকে কুটির বিষয়ক যাবতীয় আদান প্রদান এইসময় শ্যামলীর সাথেই করছে।
শ্যামলীর দায়িত্ব ও পদমর্যাদা বেড়ে যাচ্ছে।
যেমন একদিন কুশলের বিধবা মেয়ে ইতি মণ্ডল কুটিরের পাশের বাগানে আম গাছে গলায় ফাঁস দিয়ে মারা গেলে উপলার দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছিল।।
XXXXXXXXXXXX
মনের ভাষা, মনের মধ্যে দিয়ে মনের মধ্যে চলে যায়। টাকার ভাষাও মনের মধ্যে দিয়ে চলে যায়। মনের ভাষা, বাহ্যিক সম্পদের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায়।"
এই কথা কে বলেছিল, বড় নাকি ছোট গোঁসাই, উপলা ঘুমের ঘোরে মনে করতে পারে না।
**********
গ্রাম জুড়ে রসের ভিয়েন। গ্রাম জুড়ে মেলা, তিন দিন। আজ চতুর্থ দিন ভাঙা মেলার ডাক। বড় গোঁসাই এর দীর্ঘ দিনের মাজা ঘষায় এই মেলার নামডাক সাত গ্রাম জুড়ে। কত কত দূর থেকে কেত্তনের দল বায়না করে আনেন বড় গোঁসাই। কিভাবে জগত ঘোষের নাম গোঁসাই হলো, উপলা আজও জানে না। সেভাবেই ছোট গোঁসাই কেন যে ওই নাম পেল। ভাবে উপলা আর নিজমনে কুটোপাটি হাসে।
বড় গোঁসাই রীতি মেনে বড় বড় কথা বলে। উপলা আপন খেয়ালে শরীরের নানাখানে হাত বুলোতে সেই বাণী শোনে।...
শরীরে হাত বুলোতে বুলোতে সরেস কল্লে বয়স; কথার কথা অনেক বলতে চাইলে, হরি-নাম কর ওই সুধামুখে, বাবু! ওই সাইজের কথাবার্তা না পেলে ইঙ্গিত করতে পারো না, বাবু, সহজ-গোঁসাই! কথায় কথায় হাওয়া ভরি হয়, তারই তো দাম। এক টাকায় পাঁচ খানা কিনে হাওয়া ভরে ভরে ভরে পাঁচ টাকায় এক খানা বেচি। ফানুসে পিন ঠেকাতে চাও কেন উপলা। এসো, নিজেদের ফুটোয় ফুঁ দিয়ে দিয়ে জীবনটা মহিমাময় করে তুলি। বড় করে তুলি। বাজারে বড়র দাম বেড়ে যায়। ছোট এক কোনে অবিক্রীত পড়ে থাকে। উপলা রে, বড় হয়ে ছোটর দুঃখ বুঝি। কিন্তু ছোট তো বড় হবার প্রয়াস করতে পারে। কিন্তু যেন বড় কে ডিঙিয়ে যাবার ছোটলোকি না করে, এই হলো সার কথা। কী বলিস, উপলা?
উপলা বলে,
চল্লিশ থেকে চার বাদ গেল গোঁসাই, থাকল ছত্রিশ। মাত্র এই ছত্রিশ বছর বয়সে কত ফুঁ দিলাম কত সাধের ফুলে ওঠা জন্তরে হে হরি। সব্বাই মিছিমিছি ফুলতে ভালোবাসে।
সোজা ছত্রিশ না বলে অত ঘুরিয়ে, চল্লিশ থেকে চার বাদ দিয়ে, কায়দা করতে গেলে কেন, শুনি!
চল্লিশ বছর বয়স থেকে, বড় গোঁসাই এই চার বচ্ছর তোমার সনে থাকা হলো। চার বচ্ছর আমি লতা, তুমি তরু হে! রাখ্নি হয়ে আছি। আহা কী সুখে আছি হরি হে! রাধে, রাধে! তাই ভাবলাম চারটি বচ্ছর জীবনের পরমায়ু বিদ্ধি পেলো বুঝি! কেবল তো ক্ষতি লেগে আছে গোসাঁই, এই ভবজ্বালায়। বিদ্ধি আর কই? তোমার মতো সাধু-সংগে আয়ু বেড়ে যায়। আহা, কত সুন্দর, সুলভ, আনন্দ ইথইথই, দেহপাখি!
তোকে দেখে আমি জীবনের দাম টের পেলাম উপলা, বুঝলি রে সখি?
আমার আবার মূল্য আছে গোসাঁই। তুমি ছুঁয়ে দেখেছ তাই দাম উঠল। আমি কী দেয়ে মিটাব এই ঋণ? কী আছে আমার বলো দিকি।
খানিকটা হাওয়া, তাতেই কেনাবেচার বাজার ধরে ফেললি রে? কতকিছু ধরে ফেললি তুই, তুই যে আমার গুরু রে উপলা...
সে-কী! পাপ হবে গোঁসাই এমন কুলুক্ষুনে কথা ভাবলেও, এ কী কথা বলো গো, হ্যাঁ!
তোর সুগন্ধে দেহমন উতলা হলো উপলা...
শিহরণ হয় গো বড় গোঁসাই, তোমার মুখে এত উঁচু উঁচু কথা নিজের নামে শুনলি পর...
তোর শরীরের সুবাস সুঁঙ্গিয়ে সুঁঙ্গিয়ে ভবজ্বালা পার করে দে উপলা... পাপ্ড়ি মেলি ধর... কুসুম গন্ধ উপচে পড়ুক যতেক তত্বের কলসী!
তোমার তো সংসার আছে গো বড় গোঁসাই! সেই ঠিনে মন দাওনা ভালো মতো। আমি পথের ধুলো, নিচ্ছুপ পথেই থাকি না কেন, জীবন যে জটিল হয় বাবাজি!
কিন্তু ছোট যেন বড় কে ডিঙিয়ে যাবার ছোটলোকি না করে, এই হলো সার কথা। কী বলিস, উপলা?
সে তো বুঝি আমিও বড় গোঁসাই। কিন্তু একটা উপায় বলো দিকি, চিরতরে কাহিনিতে ইতি টানি কী ভাবে? তখন শুধু তুমি আর আমি, মাঝে কোনও আবর্জনা থাকবেনি...
বলব, বলব রে উপলা... সময় আসুক ... সে যে বড্ড কঠিন উপায়...
সব পারব আমি বড় গোঁসাই, আমাতে ভরসা রাখতে পারনি?
***********
কেত্তন আর মেলা শেষ হতে, বড় গোঁসাই খানিক বাড়ির পানে যেতে না যেতেই এক দিন উপলা এসে অনুযোগ করে, ও ছোটোগোঁসাই, বল তো, ওই বেটা ষাঁড়টার কি অমন নিদ্দয় হওয়া সাজে। আমার এই সাবেক কালের সবেধন বাসা। তাই চিরকেলে নোনা ধরা। আজন্ম স্যাঁতা। বেটা ঘাপটি মেরে এসে যখন তখন আমার দেওয়াল চাটে। বাপরে কী সাংঘাতিক জিভ। চাটতে চাটতে এমন কাবু করে ফেলেছে গোড়া থেকে, যে হুড়মুরিয়ে পড়লো বলে!
কী আর করবে সোনা রে আমার? ওই ষণ্ডামার্কা ব্যাটা কেজিবি না সিয়াইএ কে জানে। তুমি গুটিসুটি মেরে থকো বাপু। ধনতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র, মাঝখানে কিছু না পেলে স্যান্ডউইচটা টেস্টি হয়না।
তোমার আর কী ছোটোগোঁসাই। ঘরখান গেলে থাকব কোথায় বল দিকি?
আচ্ছা থামো উপলা, তোমার জন্য একখান কিছু করতে হয়। দেখি দেখি বিডিওকে বলে যদি কোনো আবাস-যোজনা থেকে কিছু পারা যায়।
কর দিকি গোঁসাই। আমার তো কিছুই নাই।
সে কী গো রাধে রাধে! কিছু নাই কী গো! অ্যাঁ!
দুত্তেরি...বড় গোঁসাই দেকলি পর রাগ করবে নি! ...ব্যাথা হয়! ছাড়ো!
ব্যাথা হয় তোমার?
আমিকি মানুষ না, নাকি ছোটোগোঁসাই? টাকা নিই তাই অমানুষ? পরিষেবা নিবা মাগনা-মাগনি, না? আবার ডগায় ঘা হলি পরে কনজিউমার ফোরামে যাবা? চালাকি? এখন আমিও আওতায় এসে গেছি, জানো তো? কত গোঁসাই এলো গেলো/ শেষে খ্যাপা ঘাটে ভিড়লো! হাঃ হাঃ হাঃ !
এতে আবার হাসির কী হলো বলো দিকি! আমাকে বোকাচোদা বানিওনা বলি দিচ্চি কিন্তু!
এই কিসের আওয়াজ গো, বড় গোঁসাই এসে পোল্লো বুঝি, জানতি পাল্লি রাগ করবে!
ওই শুকরনন্দন তোকে কত সোনা দানা মোহর আসরফি দ্যায় রে বল দিখি?
টাকায় স-অ-ব কিনবা ছোটোগোঁসাই?
জীবের প্রাণ ব্যতীত সকলই-। কিনেছিও বহু কিছু! তোকেই তো! এই তো! এই তো তোর এই যে এই যে এই যে এইটা! এই এইটা! এই এইটা! কিনেছি কিনেছি কিনেছি! আমি বিশাল ক্রয়ক্ষমতা দিয়ে একদিন আমেরিকা কে কিনে নিব উপলা! দেখবেন আপনি!
আমেরিকাকে কেন? নোংরা একটা দেশ! যেখানে সেখানে বোম মারে! রোজ রোজ মেয়েদের রেপ করে কত কত! থুঃ! কিনলে একটা বরং সুন্দর ছিমছাম জায়গা কেন।
কোন দেশ উপলা?
সে বলবোখন! কিন্তু দেখো বাবাজি! আমার শেয়ার রেখো ভাই, যা করবে তাতে। আধা-আধি হবে না?
কী?
শেয়ার? দেশের? যে দেশটা কিনবে?
গোটাটাই নাওনা নাওনা নাওনা! এই নাও না!
ছাড় হারামি! বড় গোঁসাই এসে পল্লে লাথিয়ে বেন্দাবন দেকিয়ে দেবেখন বলি দিচ্চি!
বড় গোঁসাই আসবেন নি হঠাৎ রে ভাই উপলা, বুঝিস না বুঝি? তিন দিনের কেত্তন সবে খতম হলো, কত্ত চাল ডাল আলু কলা জমেছে, বচ্ছর ভরের রসদ, সমস্ত ঘরে রাখতে গেছে যে এই কুটির ফেলে আমার জিম্মায়, বুঝিস না?
টাকা? আর টাকা কত উঠল গোঁসাই কেত্তন থেকে? টাকা উঠেনি?
উঠেছে না তবে? এমনই নাকি! একটা ছোট হাতি ভাড়া করে সব নে গেল না ঘরে?
গাড়ি করে টাকা?
আরে শুধু কি টাকা রে? নে, হাত বোলাতে থাক, থামছিস কেন, হ্যাঁ ধর না, বেশ তো ধরছিলি, ধরে থাক থাক থাক থাক...
বলি টাকার কথাটা চেপে যাও কেন গো ছোট গোঁসাই, কত উঠল বলো?
তোর জানা নাই উপলা? তুই ভাগ পাসনি? বল?
সে আর কী এমন ছোট গোঁসাই, যা চাট্টি বাটিতে ছুঁড়ে দিল, পেলাম। আমি হলাম গে চির ভিখারী!
কেন? সমস্ত মেলা তো তুইও সামলালি? কেবল গতর খাটার দাম? বখেরা দেয়নি?
ছোট গোঁসাই গো, ও গোঁসাই, বলি তুমি পাওনি? কাল রাতে নিজের সংসারে চুপিচুপি তবে কী রাখতে গেছিলে? ইস, থামো, আমার হাত নোংরা হবে যে! ঘরের গত্ত কি পুরোই বুজিয়ে গেছে গোঁসাই, এমন আদিখ্যেতা করো যে!
উপলা রে, দেখিস, বড় গোঁসাই দেহ রাখলে আমি তোকে এই রাজ্যপাটের রাণী বানিয়ে রাখব... হ্যাঁ... মুঠোয় নে... উপলা... সব উপার্জন তোর হবে তখন, আমি চারক হয়ে ... ওহ আলগা করিস নে মুঠো আলগা করিস নে ... শোন না, তখন চাকর করে রাখবি নি? আমায়? রাখবি নি? অ্যাঁ?
কিন্তু বড় গোঁসাই কি হুট করে ভব পারে যাবে গো ছোট গোঁসাই? গাছের ফল পেকে কবে মাটিতে পড়ে, সেই পথে চেয়ে চেয়ে যে দুই চোখে ছানি পড়ে যাবে! কিছু উপায় বলো দিকি!
বলব, বলব রে উপলা... সময় আসুক ... সে যে বড্ড কঠিন উপায়...
সব পারব আমি বড় গোঁসাই, আমাতে ভরসা রাখতে পারনি?
**********
বড় গোঁসাই একদিন আবার আচমকা ফিরে আসে কুটিরে। একটু বেশি দিন থেকে গেছিল ঘর পানে। ঘরের সব দৈনন্দিন গুছিয়ে দিয়ে এলো বুঝি রোজগারের জগতে। জগৎ মায়া দিয়ে ঘিরে রাখে কথায় কথায়। জগতের জনগণ বছরে তিন চার দফা কুটিরের নিকট মাঠে ভির করে কেত্তনে, মেলায়, উৎসবে। এই সমস্ত বড় গোঁসাই নিজ হাতে ক্রমে গড়ে তুলেছেন। সেখানে উপলা আলো করে থাকে।
নিভৃত হলে উপলা তখন কাছে আসে। বলে, আমি তোমায় মন দিয়েছি বড় গোঁসাই। শরীর যে লিবে লিক।
উপগত হতে হতে বড় গোঁসাই, অধার ভোটার রেশন জমির দলিলে নাম যার কার্তিক রায়চৌধুরী, উপলার কানের লতিতে ঠোঁট ঠেকিয়ে বাণী-সম্ভব উচ্চারণে বলে, দেহ মন আলাদা কিছু নয় রে উপলা, মন দিলে দেহে বাধা কোথায় আর দেহ কি মন বাদ দিয়ে হয় গো সোনা? বোকা মেয়েটা এতদিন সাধুসঙ্গ করে, শেষে কি কিছুই জানলো না দেখছি!
উপলা তখন উপগত দেহটিকে প্রবেশ-সহজ ভঙ্গিমায় সহজ করতে করতে আরও বলে, গোঁসাই গো, তুমি বিনে আমার কী হবে কও, কে দেখবে আমায়! ছোট গোঁসাই তো শুধু দেহ দেহ করে , ভয় হয় বুঝি কখন অশুদ্ধ করে ফেলে! শুদ্ধাচার শেষ হলে ভেসে যাব যে, কী দিয়ে সেবা করব তোমার, কোন মুখ দেখাব তোমাকে!
মনে কালি না লাগলেই সব শুদ্ধ রে পাগলি...
কিন্তু জনম জনম যে তোমাকে দেখতে চাই, তোমার নাম জপে উদ্ধার হতে চাই গোঁসাই!
তাতে বাধা কী উপলা? গুরু নামে কী বাধা বলো?
আমারে বাঁচার উপায় দিয়ে যেও গো সখা, যেন তুমি না থাকলে পর ওই ছোট গোঁসাই শকুনটা ছিঁড়ে খেতে না পারে... অর্থের নির্ভর থাকে যেন এমন গুরুর দয়ায়, নিজে হাতে ভক্তদের মঙ্গল করতে পারি বাকি জীবনটা, কারও কাছে আর হাত না পাততে হয়!
আমি কোথাও যাব না রে খেপি, এই এই এই তোর দেহে লীন হয়ে চিরকাল ভেসে থাকতে চাই...
তুমি সেই কবে তিন কুড়ি বয়স পার করেছ গোঁসাই, আর আমি দুই কুড়ি। এখন কি আর বীজ বপন হবে না? দেরি হয়ে গেছে খুব? তোমার ফল পেটে ধরতে বড্ড সাধ হয় যে গোঁসাই!
এত শুনে বড় গোঁসাই কর্মক্লান্ত শরীরে উঠে বসে ও গামছা দিয়ে নিজের শরীরের ঘাম মোছে। তারপর উপলার শরীরের ঘামও যথোচিত যত্নে মুছতে মুছতে নরম সুরে বলে, এই যে মেলা গো উপলা, আহা কত মানুষ মাখি। মানুষের পায়ের ধুলো বুকে মেখে থাকি, ধন্য হয়ে যায় এই তুচ্ছ ভবজনম। এই সবই তোমার আলোয় ভরে থাকে...এই সমস্ত ভক্তকূল তোমার উপলা, এরাই তোমায় দেখবে...
সে তো দেখবে বুঝলাম গোঁসাই, যদি তোমার তিন বেটা আর এক বেটি ভাগ নিতে হাজির হয়? যদি তোমার সংসারের মাগীটা কোমরে কাপড় জড়িয়ে ঝগড়া করতে আসে আর আমারে কুটির থেকে দূর করে দেয়? একটা স্থায়ী বন্দবস্ত কি হয়না গোঁসাই?
কার্তিক রায়চৌধুরী গভীর হাসি হাসে, এই ভবে স্থায়ী কি কিছু আছে রে! সবই অনিত্য, সবই মায়া! এতো বলে গোঁসাই তাকে হঠাৎ কাছে টেনে কী না জানি কায়দা করলো, উপলা বলল, উঃ!
***********
"মানুষ একটা এমন উজবুক প্রাণী উপলা, যে নিজের শাসক নিজে "নির্বাচন" করা কে নিজের কৃতিত্ব ও সফলতা বলে ভাবে। তাকে ওইভাবে ভাবতে শেখানো হয়েছে। সে এই প্রমোদ-মত্ত দুনিয়ায় এমনই মশগুল, এই প্রশ্ন করতে পারে না, যে, মুক্তির স্বাদ ঠিক কী রকম!"
এই কথা কে বলেছিল, বড় নাকি ছোট গোঁসাই, উপলা ঘুমের ঘোরে মনে করতে পারে না।
"প্রজা গাছ থেকে পড়ে না উপলা, প্রজা তৈরি করতে হয়। আর নিজেকে ধীরে ধীরে রাজা হিসেবে গড়ে তুলতে হয়। সাম্রাজ্য, ছোট হোক বড় হোক, রাজার পায়ে গড়াগড়ি খায়। প্রজার বিবেক নিয়ে খেলা করে জীবন সহজ করতে হয়।
এই কথা কে বলেছিল, বড় নাকি ছোট গোঁসাই, উপলা ঘুমের ঘোরে মনে করতে পারে না।
********
টাকায় স-অ-ব কিনবা ছোটোগোঁসাই?
জীব-দেহের কাম ব্যতীত সকলই-। কিনেছিও বহু কিছু!
তবে এই যে আমারে টাকা দিলে, এই যে আমি শরীর খানা নিয়ে এগিয়ে গেলুম তোমাপানে গোঁসাই? তুমি বলো কী! কিনতি পাল্লা না আমারে?
না রে পাগলি, কিনতে পারি নাই। তোর কাম, কামনা, কিনতে পারি নাই।
তোমারে যে শুতে দিলাম গোঁসাই চিৎ হয়ে, যেমন বল্লে তেমন উপুড় চিৎ ঊর্ধ নিম্ন! বেলাউজের ফাঁকে নিজে হাতে টাটকা কখান নোট গুঁজে দিলে যে! বলো কী! কিনতি পারনি আমারে?
না উপলা। তুমি আমায় কামনা করনি দেহ দেবার সময়। লোকে ভাবে বুঝি শুধু প্রেম খরিদ করা যায় না, হাঃ হাঃ! উপলা গো, শরীর মানুষ কিনে কেন বলো? কাম হেতু, তাই না, রাধে রাধে? খরিদ করে কামও মেলে না উপলা।
গোঁসাই গো, আমার গতরের গুমোর এভাবে ভেঙে দিও না গোঁসাই, হরি হে, মাধব!
শরীর দেওয়া সহজ নয় রে উপলা, শরীর নেওয়াও ভারি কঠিন...
এমন কেন গো গোঁসাই? আমি কি তবে নিজেকে বেচতেও পারিনি ঠিকমতো? তোমার সাথে তঞ্চকতা করেছি?
কাম হীন শরীরের কী দাম উপলা? টাকা দিয়ে তোকে কিনে নিজের বিষ নিজে ঝেড়েছি। বল, ঠিক কি না? একবার আবেগে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিলি? বল? দেহ দিলেই কাম দেওয়া যায় না রে... রাধেশ্যাম! হরি হরি!
আহা, কী যে আলো করে দিলে মাথাটা গোঁসাই... আচ্ছা, তোমার জাঙে বড্ড লোম গো, গায়ে ঠেকলে কেমন ভয়ে শিউরে উঠি...
কী প্রসঙ্গ থেকে কোন প্রসঙ্গে চলে যাও উপলা...
মনে বড্ড হীন ভাব হচ্ছে গো গোঁসাই, টাকা নিয়ে তোমায় ঠকিয়ে দিয়েছি বলে মনে হচ্ছে। এসো, একটু গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে যাই... তোমার জাঙের লোম আলতো করে হাত বুলিয়ে দিই, আরাম পাবেখন, এসো!
উপলা, আমাদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের হৃদয়ে প্রেম না জন্মালে, বলো, কাম আসবে কোথা থেকে? ওসব তো অনেক হলো রে পাগলি, আর নিরর্থক শরীরে শরীর ঘষে কী হবে? বলি কী, রধে রাধে, শরীর নিয়ে এমন প্রেমহীন খেলায় পাপ হয়, এসব এবার বন্ধ করার পালা উপলা।
তোমার মতো রতিবাজ মানুষ অমন নিরিমিসি থাকতে পারবে গোঁসাই? বড্ড ভয় করে, আগুন চেপে রাখতে রাখতে নিজে পুড়ে না মর! বা, কোথায় মাথা গরম করে রাস্তাঘাটে খানিক খুনখারাবি না করে বসো!
না গো উপলা ... তেমন হবে না। আমি নিজেকে অনেক বুঝিয়ে আজ এসব কথা বলছি।
তাই বললে হয় গোঁসাই, আমার ভয় করে না? আমার দায়িত্ব নেই কিছু? এসো, শোও দেখি, হাত বুলিয়ে দিই... দেখো, আরাম পাবে ... মন শক্ত হবে.. উঠে দাঁড়াতে হবে গোঁসাই, ভেঙে পড়লে চলে? এসো দিকি, নখরা কোরো না...
শোবো না উপলা। শোবো না আর...
ও গোঁসাই, না শুলে তবে টাকাও দেবে না? কী গো? বলো না?
সে কি হয় উপলা। দুম করে টাকা বন্ধ করলে তোমার কত অসুবিধে হবে বলো? আমি কি অতই নিদ্দয় উপলা?
সে কী গো গোঁসাই, না শুয়েই টাকা দিবা? হরি হে!
এতদিন যেটা করেছি, সেটাকেও শোওয়া বলা যায় না উপলা... হিদয়ে হিদয় না মিললে শুয়ে কি পরমের প্রাপ্তি হয় উপলা? তাহলে? তখনও, তেমন হেলাফেলার শোওয়াতেও যদি টাকা দিতে পারি, এখনও পারব সোনা, ও নিয়ে চিন্তা কোরো না।
তোমার তো গোঁসাইগিরি বাদেও সরকারি টাকা আসে ঘরে, মাস্টারি করো তুমি ইস্কুলে। আমার কী আছে বলো তো! এই চাট্টি মাটির শরীর, আজ আছে তো কাল নেই, শুকিয়ে অফলা হয়ে যাবে। তখন ভিটেয় ঘুঘুও চরবে না!
আমি যে আছি রে পাগলি...
ও ছোট গোঁসাই, আমি তোমাকে ভালবাসব ছোট গোঁসাই...
তাতে তো বাধা নেই, চেষ্টা করে দেখ। তুমি যদি সফল হও, আমি ঠিক টের পাব উপলা...
গোঁসাই, আচ্ছা বলো তো, তুমি কি আমারে ভালোবাসো?
সে কথা তো আমার চেয়ে বেশি তোমার জানার কথা উপলা।
********
উপলার মৃতদেহ কুটিরের উঠোনে তুলসী তলায় শোয়ানো, সাদা কাপড়ে ঢাকা।
সাত গাঁয়ের লোক খবর পেয়ে আসতে শুরু করে।
ছোট গোঁসাই আর বড় গোঁসাই বিমর্ষ ভঙ্গিতে বাঁশের খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে বারান্দায় বসে।
হরি হে! বড় গোঁসাই বলে।
মা ধ ব! ছোট গোঁসাই বলে।
সাত গাঁয়ের লোক উপলার আচমকা বিষ্ণুধাম যাত্রা বিষয়ে আলোচনা করে। কত পুন্যি করলে গু মুত না ঘেঁটে মানুষ সগগে যায় সেই কথা লোকমুখে ফলাও হয়। সবই নাম ভজনের গুণ।
উপলার দেহ ত্যাগের তিথিতে প্রতি বচ্ছর বড় একখান উৎসব হবে এই নিয়ে সাত গাঁয়ের মোড়ল নিজ নিজ মত দেয়।
দুই গোঁসাই তাদের কথা চুপ হয়ে শোনে।
মাদ্রাজে কাজ করতে গিয়ে সেখানেই নতুন সংসার পেতে ফেলা জগবন্ধু মণ্ডলের বউ শ্যামলী আজ সকাল থেকে ভেঙে পড়া দুই গোঁসাই আর কুটিরের ভার সামলাচ্ছে।
জমা হওয়া লোকে কুটির বিষয়ক যাবতীয় আদান প্রদান এইসময় শ্যামলীর সাথেই করছে।
শ্যামলীর দায়িত্ব ও পদমর্যাদা বেড়ে যাচ্ছে।
যেমন একদিন কুশলের বিধবা মেয়ে ইতি মণ্ডল কুটিরের পাশের বাগানে আম গাছে গলায় ফাঁস দিয়ে মারা গেলে উপলার দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছিল।।
XXXXXXXXXXXX
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন