ক্যালেন্ডার
দেয়ালে ক্যালেন্ডার: একটি মা চড়ুই কয়েকটি সদ্যোজাত ছানা। সরিয়ে নেওয়ার পর, স্তব্ধতার সাদা দাগ।
এই বাড়ি আমার ছিল না।
অনেক পোড়ানো শেষে রাস্তায় দাঁড়ানো এক আধপোড়া মাটির দেয়ালে কাঠকয়লায় লেখা গোটা গোটা কয়েকটি অক্ষর, আমরা কোথায় যাব, বাবা...
চাঁদ
চাঁদকে অর্ধেক কেটে ঝুলিয়ে রেখেছে, আর তা থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। এই রক্তের দিকে চেয়ে চেয়ে গর্তের শিয়াল আর শিয়ালের গর্তেরা সারারাত ফুটিয়ে তুলেছে কিছু আর্তি ও চিৎকারের ফুল। হয়তো-বা এখানেই কবিতার শুরু; ভয়াবহ ধ্বনির ভেতর, একটি ছিন্নমুণ্ড ঝুলে আছে অন্ধকারে, আর তার জিভ থেকে গড়িয়ে পড়ছে সহস্র বর্ণ ও বর্ণনা।
একটি চাঁদ থেকে অন্য চাঁদের দিকে পালাতে পালাতে থমকে দাঁড়ায় কেউ। দেখে, প্রতিটি বর্ণ থেকে তীব্র বল্লমগুলো ছুটে যাচ্ছে অন্ধকার বিঁধে। ক্ষত থেকে ফোঁটা ফোঁটা আলো পড়ছে রক্ত ছায়ার। একটি চাঁদ থেকে অন্য চাঁদের মাঝে পড়ে থাকা, স্তব্ধ, মুণ্ডহীন সমস্ত শরীর জুড়ে লেগে আছে রক্তমায়ার এক আলোর বন্ধন। হয়তো এখানে কবিতা শেষ, চাঁদের আরম্ভ।
রবিবার
জন্ম দিতে হয়, তাই যাঁরা ওপরে ছিলেন, তাঁরা নামছেন।
এবার আত্মীয় সম্বোধনে কাছে ডাকার এক ভয়ংকর ব্রিজ পেরিয়ে যেতে হবে: তীব্র হাহাকার আর গোঙানি মেশানো ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াহীন ঝুলে আছে। দু-পাড়ে প্রচুর কাশবন। তবে কি শরৎ এল!
আকাশের বোনেরা ভেজা কাপড় ছড়িয়ে দিয়েছে রোদে। ওদের পাখি বলে ভুল করে যেসব মৃতরা বসবাস শুরু করেছিল, দলা পাকানো কাগজের সরু ও ঘিঞ্জি সেই ধর্মপল্লি জুড়ে, খসে যাওয়া পাতায় পাতায় কেঁপে উঠছে ১৩টি সাদা ছায়া। আজ রবিবার। তাঁরা নামছেন।
নিশিধস
অভ্যস্ত খচ্চর অব্দি ফিরিয়ে নিচ্ছে মুখ। এইসব অন্ধ বাঁক, ব্যবস্থার; খুলিচিহ্ন আঁকা সরু ও পিচ্ছিল।
নিশিধস। গত্যন্তরহীন ইচ্ছার অভিমুখ ঈশ্বরের থুথু গুল্মে ঘেরা; পথহীন প্রথম পাহাড়। দ্বিতীয় পাহাড়ে সেই কটুগন্ধ র্যাফ্লেশিয়ারা।
তবে কি তৃতীয় কোনো পথ অই পুলিশফাঁড়ির দিকে?
রাত বেড়ে গেলে একটি লণ্ঠন নিয়ে বেরিয়েছি, দূরে অন্ধদের স্কুল পুড়ে যাচ্ছে সংস্কারবশত ভ্রমণ বিরতি নাকি? আগুন ও অন্ধকার পাহাড়ের ভিড়ে পুড়ে যাওয়া স্ফুলিঙ্গ কুড়িয়ে কুড়িয়ে, চল যাই
স্বর ও ব্যঞ্জন
গত-পাহাড়ের খুব কঠিন উপরে এসে, এতদিন পর দেখা হল সমুদ্রবন্ধুর মুখ, অংশত জটিল। ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ডানা ঝাপটানো দুটি পাখি ও আগুন নিয়ে একটু কি পাশ ফেরা, পুরোনো দিনের...
যেভাবে পিছিয়ে, ঝাউসারি ভ্রূ কুঁচকে তাকায়; ততটা দূরত্ব থেকে, পড়তে চাইছি এই আধপোড়া ইতিহাস সম্পর্কের, সম্পর্কহীনতারও কিছু ঝিনুক কুড়ানো...
তবে! এসেছ সে গ্রামার পড়তে পাইন বনে! স্বরের অস্ফুট হাওয়া ছাড়া, কীভাবে পড়বে ঝরাপাতা ব্যঞ্জনবর্গের এই শীতে!
গন্ধের ঈশ্বরী
১
নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে ভুবনের পাকস্থলে মাংস রান্নার গন্ধ ঘিরে, জিহ্বায় জ্বলছে আগুন। গন্ধের ঈশ্বরী নিজ হাতে এ আগুন উসকে দেন, আর আগুনের হাত থেকে লকলকে দশটি আঙুল বেরিয়ে, জড়িয়ে ধরতে চায় তাঁকে। ধরা বা ছোঁয়ার বাইরে, ঠোঁটে হাসি চেপে তিনি আঙুলের আস্ফালন দেখে যান। সারাদিন সমস্ত কাজের মধ্যে, এই খেলা তাঁর বড়ো প্রিয়। যত বিরুদ্ধতা থাক সংসারের, আগুন খেলতে খেলতে তিনি ঠিক লক্ষ রাখেন, নিজের আগুনে পুড়তে পুড়তে কীভাবে রান্না হচ্ছে মাংস।
নরম ও সুসিদ্ধ মাংসের দিকে চেয়ে, আমাদের জিহ্বা থেকে জল ঝরে পদ্মপাতায়। সেই জলে স্নান সেরে, গন্ধের ঈশ্বরী উড়ে যায়।
২
হাতের যে আঙুল অন্যের দিকে উঁচু হয়ে ওঠে, তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে, একজন গ্রামীণ মহিলা দুই পা ঢুকিয়ে দিলেন অসহ্য উনোনে। পোড়ালেন, আর পুড়িয়ে পুড়িয়ে আমাদের ফোটাতে চাইলেন নরম ভাতের মতো, মাটির হাঁড়িতে। হাঁড়ি ফেটে, দু-একটি গজগ্যাড়ে চাল আধপোড়া আধসেদ্ধ হয়ে, এই যে ছড়িয়ে আছে ছাই ও জঞ্জালে, তাদের কুড়িয়ে, ধুয়ে, শুকোতে দিয়েছে মেঘ, শরতের রোদে।
সিদ্ধ না হওয়া অব্দি মেঘে রোদে, রোদে মেঘে, বারবার পুড়িয়ে ভিজিয়ে, কিছু ঘুম কিছু জাগরণে, দুই পা ছড়িয়ে বসে সৎ আর অসতের মা, শালিখ তাড়িয়ে যাচ্ছে- হুশ যা-হুশ যা
লিপস্টিক
টুকিটাকি জিনিসপত্র নাড়ছিলাম, হঠাৎ একটা লিপস্টিক পেয়ে গেলাম। পাঁচ বছর পুরোনো। নেহাত ছেলেমানুষি, ওটা নিয়ে খেলতে খেলতে মনে হল, দুটো পা থাকা উচিত।
বাতিল চুলের কাঁটায় দুটো পা বানতেই, আশ্চর্য
লিপস্টিকটি মেট্রোপলিস থেকে মফস্সলের দিকে হাঁটতে লাগল। জানি, সেখানে কুসুম নামে একটি মেয়ে থাকবে, হাতে ভাঙা আয়না। সে নারী- স্বাধীনতার কিছুই জানে না।
হাতের বদলে লিপস্টিকের কাঁধে দুটো চকপেন্সিল জুড়ে দিলাম। অমনি আমার হাত ধরল। আমরা কুসুমকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের নারী-স্বাধীনতা বিষয়ক মতবাদগুলো।
এজন্য সিগারেটের প্যাকেটে কালো কালিতে দুটো ঠোঁট আঁকা হল। ঠোঁট দুটোও কাঁপতে কাঁপতে কিছু বলল।
স্পষ্ট শোনা গেল না। দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
আমার আর কীই-বা করার আছে। বড়োজোর কুসুমকে জানাতে পারি এই মহাবিশ্বের সুন্দরী প্রতিযোগিতায় আমাদেরও কিছু হওয়ার আছে।
এ-কথা যারা বিশ্বাস করেন, তাদের একদিকে রেখে, অবিশ্বাসীদের নিয়ে একটা বাস সটান চলে যাচ্ছে লেনিনের কবর দেখাতে।
বাণিজ্য সংগঠনতত্ত্ব
বাণিজ্য-সদর না হয়ে ওঠার দুঃখে, মফস্সল শহরে, আমরা কতিপয় মানুষ সাইনবোর্ড-সর্বস্ব এক দোকান খুলেছি।
নিজস্ব পুঁজি বলতে এই শরীর, বাকিটা চোখে না পড়ার মতো ব্যাঙ্কঋণ।
সুদসহ ফেরাতে না পারলেও নিয়ম এই, চালু দোকানের ক্ষেত্রে সুদ মকুবের ব্যবস্থা আছে।
দোকান চালু রাখতে বিভিন্ন বিষয়ই মাথায় রাখতে হয়। যেমন, বয়স অনুযায়ী গ্রাহকদের চাহিদা ও জোগান, নগদ বিক্রির পাশাপাশি কতটা বাকিতে ছাড়া হবে, প্রতিবেশী কোন দোকানের সঙ্গে আমাদের গোপন বা প্রকাশ্য সমঝোতা হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
ক্ষতিকর জেনেও, উঠতি ছেলেদের জন্য রাখি স্বাধীনতার আস্বাদ মাখা সিগারেট। বয়স্কদের জন্য সুখ-স্মৃতির রাজা জর্দা। এসবের বিক্রি বেশ ভালো এবং নিয়মিত। এছাড়া বিশেষ মরশুমে, শিশুদের জন্য অন্তত একশো রকমের বন্দুক রাখতে হয়।
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, হাতে বন্দুক পেলেই শিশুরা নিজেদের সাবালক ভাবতে শুরু করে। ভবিষ্যৎ সিগারেটের গ্রাহক হিসাবে এই খুদে ক্রেতারা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত আজকের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে।
আর এদিকে লক্ষ রেখেই আমাদের নতুন স্কিম, যেকোনো বন্দুক কিনলেই ফুল ফ্রি...
গণিতসূত্র
ধরো, ফেলে যাওয়া একটা সাপের খোলসে তুমি ঢুকে গেলে, আর তখনই দেখতে পেলে, দিগ্বিদিক ঝলমল করে ছুটে আসছে এক প্রায়ান্ধ ময়ূর।
তখন সাপ হিসাবে তোমার যে ভয়, আর মানুষ হিসাবে যে মুগ্ধতা, তুমি কি তাকেই বলবে তোমার ভবিষ্যৎ?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন