কবিতাভাবনা ও একগুচ্ছ কবিতা 

হিমযুগের সেই রাখালরাজ জেনেছিল, সময় জানায় ছায়া, দিশা জানায় নক্ষত্র, ধ্বনি জানার ক্রিয়া। যা সে স্বয়ং নয়, এক হয়ে আর এককে জানায়। সমগ্র বিশ্বসংসারকে এভাবে পরখ করে রাখালরাজ টের পায় যে ভাবনা চিন্তা সোজা পথে ব্যবহার্য হয়ে ওঠে না।

এক-এর আড়ালে আর এক, আরও অনেক রয়েছে। ভাবনা আর ভাষার উদগ্রীব সহযোগী হয়ে উঠছে, এও টের পাচ্ছে যে এমন কান্ডকারখানা আবিষ্কার করে সেও আশ্চর্য আমাদেরই একজন। এও জানল তারও ছায়া, তারও কাজকর্মের আওয়াজ দিয়ে তাকে ও তার বাইরে অনেক কিছুকে চেনা যায়। আজকের মানুষও এক হয়ে আর এক বা আরও অনেক সাজলে তাকে বলা হয় স্টার, প্রসেনজিৎ, সৌমিত্র, সুচিত্রা এঁরা আজও তারকা বা স্টার। শব্দের রাজ্য বিস্তার ভাবনাচিন্তার আর আবিষ্কারক মনোভাব সেই সেকাল থেকে আজও কোথাও না কোথাও তার কীর্তি রেখে গেছে সংজ্ঞা ও পরিভাষাকে বিবর্তন বিবর্ধনের সঙ্গী করে নিয়ে চলেছে। তারপর, ঢের চাঁদ পেরিয়ে-

এই সেদিন এক সভাগৃহে দেখা গেল প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ কবি অলোকরঞ্জন, হঠাৎ একটি ছেলে যে মঞ্চে আসতে ঈষৎ সংকোচ বোধ করছিল তাকে দেখে বলে উঠলেন, 'ছেলেটি বড় 'মঞ্চলাজুক'। অলোকরঞ্জন শব্দদাম্পত্যে অভ্যস্ত। অনায়াস তাঁর উচ্চারণ। ছেলেটি তরুণতম কবি, মঞ্চমেজাজী হয়ে ওঠেন নি। অথচ শব্দ চেনেন। রাখালরাজার মতো চিনতে এবং উদ্ভাবন করতে শিখছেন। শব্দ চেনে বলেই-

মুহূর্তেই সে ট্রান্সজেন্ডার..........

সে জানে, লজ্জার গর্ভে বিনয়ের জন্ম মঞ্চের গর্ভে দর্পের জন্ম ঠিক যেমন বলা যায়,

ছায়ার গর্ভে সময়ের জন্ম

ক্রিয়ার গর্ভে ধ্বনির জন্ম

দিশার গর্ভে নক্ষত্রের জন্ম

ফিরে আসা যাক 'মঞ্চলাজুক' শব্দে যা 'মঞ্চ' ও 'লাজুক' দুটি বিপরীত যোনি থেকে জনিত শব্দের আলগাজোড়। শব্দদাম্পত্যে রচিত। কবির অতীন্দ্রিয় বোধে রচিত 'মঞ্চলাজুক' শব্দ পাঠক বা শ্রোতার মননে চমকপ্রদ মনে হয়। কেননা একটি ঘটমান দৃশ্য উপলব্ধি করে তাঁর এই উচ্চারণ অনায়াসে রণন সৃষ্টি করে।

পুরাকথায় রয়েছে কলাবতীর গর্ভে বায়ু প্রবেশ করলে রাধিকার জন্ম। রাধা কলাবতীর ক্ষেত্রজ সন্তান। আরও জানা যায় রাধা তাঁর ছায়া রেখে অদৃশ্য হন। এই রাধাই আজও কবিতার নায়িকা। 
কবি তার নিজের মতো নাম রাখেন বনলতা বা নীরা। রাধার বিহনে শ্রীকৃষ্ণ উতলা। গীতার দশম অধ্যায়ে অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্বয়ং জানিয়েছেন যে তিনিই কবি। কবির কাজ সম্প্রসারণ। ভাষা ও ভাবনার বিস্তার। চেতনায় সম্প্রসারণ।

সারা ভারত জুড়ে গ্রামে গঞ্জে কলাবতী, রাধা, কৃষ্ণ নাম ইত্যাদি আজও প্রচলিত। কলাভবনও আছে একাধিক। অবশ্য আজ গ্রাম থেকে আসা শ্রমিকের ঘরে কলাভবনের পেছনের বস্তিতে আছে সেই কলাবতী।

আজকের কবি যতই 'নতুন' হতে চান না কেন বাংলা ভাষা ও ভারতীয় কাব্যদর্শনের খুঁটি বাঁধা আছে শব্দের গভীরে। তবে তাকেই সম্প্রসারিত করা কবির কাজ। অতএব, কবি অরুণেশ ঘোষ তাঁর কীর্তি রেখে অদৃশ্য......



২.
পাটনায় যে পাড়ায় থাকতাম তার নাম 'ইমলিতল' বাংলা করলে তেঁতুলতলা। দলিত শ্রেণীর পাড়া, কাহার, দুসাধ, কুম্হার প্রধানত এরাই থাকতেন, আর আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত কিছু পরিবার যারা সেইসময় তথাকথিত উচ্চবর্গের মানুষ। অথচ আমার পাড়ার বন্ধুবান্ধব ওই কাহার দুসাধরাই আর স্কুলের বন্ধুবান্ধব 'উচ্চবর্গে'র রাজপুত, কায়স্থ, ভূমিহার ইত্যাদি। ইমলিতলের দলিত পরিবারের মানুষেরা মা বোন নিয়ে গালাগালি দিতে ভালোবাসে, মজা পায়। বললাম এমন গালাগালি ভাবতে হবে যার মধ্যে শুনতে খারাপ, অপভাষা, নোংরা কথা নেই অথচ একই উদ্দেশ্য পূরণ করবে। একদিন দিনু হাজাম এসে বলল,

'তেরে ভুত কো মচ্ছর কাটো'

নতুন শব্দাস্ত্র, সম্প্রসারিত প্রয়োগ, কবিতায় বললে এভাবে বলা যায়,- 'তেরে ভুত কো মচ্ছর কাটো' ইমলিতলের মগজি ব্রহ্মাস্ত্র বেপাড়ার জজসাহেব বলতেন, স্ল্যাং সাবর্ণ সেনার বিরুদ্ধে দলিতের গর্ভ খিস্তি যতদূর জানি তুডুকমেজাজী বিশ্বামিত্রের বুকসেল্ফে শব্দাস্ত্রের অভিধান ছিল, তবে বাবুরাম তার ছেলের নাম রেখেছিল, বাংগালিরাম অনরোনীয়ান উপস্থিতির কথাসরিৎ........ ওটা স্ল্যাং নয়, ও তো অরূপ তোর অনুপস্থিতির আছিকে তোরই অনুপস্থিতির অরূপ

কলকাতিয়া দেখলে ইমলিতলিরা বলত, ড্যামচি লোগ বাং গালিবাবু......

কায়স্থ লালাজি বাংগালিদের বোঝাতেন-

হুল ফোটাক্ 


হরিমতী স্মৃতি বিদ্যালয়


১. 
চেতনপাখি

কামমোহিত হই প্রত্যহ রেতঃপাত ঘটলে শ্যেনপক্ষী আসে পাখিরালয় থেকে ইচ্ছেমতো নিয়ে যায় অগ্নি ও অপ্সরার কাছে

সাবধানে চোখ রাখি

সে না চলে যায় চেতন ভগতের কাছে চেতন না বলে বসে শ্যেনপক্ষী পাখি নয়



২. 
কলাবতী কথা

কলাবতী যাকে রূপনারায়ণপুরে কলাবতী আছেন যথাতথায় আর কলাবতী আছেন এক সত্যনারায়ণে বিদর্ভেও আছে কত শতকলাবতী

কলাবতী বায়ু প্রসব করলে অযোনিসম্ভূতা রাধিকার জন্ম ছায়া রেখে রাধিকাও অদৃশ্য- শুঁয়োপোকা আরোহে প্রজাপতি শুঁয়ো তারও অদৃশ্য

আজ কলাবতী আছেন কলাভবনের পেছনের বস্তিতে- উচ্চগ্রামে স্বরলিপি স্বর পালটায় উচ্চারিত হলে প্রত্যেক শব্দের গর্ভে কিছু বায়ু থেকে যায়.....

ঋণ - কবিতা ক্যাম্পাস




সমীর রায়চৌধুরী 

জন্ম : নভেম্বর ১, ১৯৩৩ 
মৃত্যু : জুন ২২, ২০১৬ 
বাংলা সাহিত্যের একজন বিতর্কিত কবি, ছোট-গল্পকার ও ভাবুক।

সমীর রায়চৌধুরীর জন্ম মামারবাড়ি পাণিহাটিতে (২৪ পরগণা)। তিনি কলকাতার আদি নিবাসী সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উত্তরপাড়া শাখার সন্তান। বিদ্যাধর রায়চৌধুরী, যিনি জোব চার্ণককে কলকাতা-সুতানুটি-গোবিন্দপুর গ্রামের ইজারা দিয়েছিলেন, তার ৩৯তম বংশধর তিনি। তার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম ভ্রাম্যমাণ ফোটোগ্রাফার-আর্টিস্ট, যিনি নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রুডিয়ার্ড কিপিং-এর বাবা, তৎকালীন লাহোর মিউজিয়াম-এর অধক্ষ জন লকউড কিপলিং-এর কাছে ব্রোমাইড-কাগজ আলোকচিত্র তৈরির কৌশল শিখেছিলেন। তার বাবা রঞ্জিত (১৯০৯-১৯৯১)-ও পাটনা শহরের প্রচীনতম ফোটোগ্রাফি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি জ্যাঠামশায় পাটনা শহরের জাদুঘরের চিত্র এবং ভাস্কর্য রক্ষক ছিলেন। সে-কারণে শৈশব থেকে সমীর শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন। স্কুল জীবন পাটনায় কাটিয়ে তিনি কলকাতার সিটি কলেজে গিয়ে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন, এবং সেই সূত্রে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা কবি দীপক মজুমদারের সঙ্গে পরিচিত হন। তার মা অমিতা (১৯১৬-১৯৮২) ছিলেন ১৯ শতকের বাঙালির রেনেসঁস-প্রভাবিত পরিবারের মেয়ে।


  • ছোটগল্পের বই:সিগারেটের তিরোভাব ও অন্যান্য, ছাতা হারানোর বর্ষাকালীন দুঃখ, পোস্টমডার্ন গল্পগুচ্ছ, খুল যা সিমসিম।
  • কাব্যগ্রন্থ:ঝর্নার পাশে শুয়ে আছি, আমার ভিয়েতনাম, জানোয়ার, মাংসের কস্তুরীকল্প, পোস্টমডার্ন কবিতাগুচ্ছ, বিদুরের খড়ম, নির্বাচিত কবিতা।
  • প্রবন্ধের বই:— কবিতার আলো অন্ধকার, পোস্টমডার্ন কবিতা বিচার, পোস্টমডার্ন বিড়ালের সন্ধানে, উত্তরাধুনিক প্রবন্ধ সংগ্রহ।
  • সম্পাদিত বই:পোস্টমডার্ন: অধুনান্তিক, পোস্টকলোনিয়ালিজম: উত্তরঔপনিবেশিকতা, পোস্টমডার্ন কি ও কেন, পরমাপ্রকৃতি: ইকোফেমিনিজম, সীমা, কমপলেক্সিটি:জটিলতা, ডায়াসপোরা, অনিল করঞ্জাই আলোচনাসমগ্র, ফালগুনী রায় আলোচনাসমগ্র, ভুখী পীঢ়ি (নেপালি), জীবনানন্দ (কন্নড়), Postmodern Bangla Poetry Volume I & II, Postmodern Bangla Short Stories Volume I & II, অধুনান্তিক বাংলা কবিতায়েঁ (হিন্দি)।
  • সম্পাদিত পত্রিকা:— কৃত্তিবাস (ফণীশ্বরনাথ রেণু সংখ্যা), হাংরি বুলেটিন, শাশ্বত (বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় সংখ্যা), সংক্রামক (হিন্দি), হাওয়া ৪৯।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন