অতিচেতনার কথা
একটি শিশু জন্মেছে। তার চোখ আছে দেখতে পায় না, কান আছে শুনতে পায় না, নাক আছে গন্ধ পায় না, জিভ আছে স্বাদ পায় না, কোমলতম ত্বকেও সে পায় না স্পর্শ। ধীরে ধীরে সে পারিপার্শ্বিক বল ও শর্তগুলোর অধীন ইন্দ্রিয় জাগাবে তার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের সম্যক জ্ঞান ও অবস্থান ধারণার জন্য। বস্তু প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে তার নিজের সম্পর্ক নিয়ে চেতনা গড়ে উঠবে এইসব ইন্দ্রিয় প্রবিষ্ট জ্ঞানের সমীকরণে। সে শুধুই ইন্দ্রিয় সচেতন থাকতে পারে, অথবা জ্ঞান সচেতন। দুটোই হতে পারে না। দারোয়ানি আর মালিকানা দুই- ই যার কাজ সে তার নিজের সঙ্গেই সম্পর্কচ্ছেদ করে।
প্রথমে একটি শূন্য তৈরি হল, তারপর তা ভরে উঠল নানাপ্রকার চেতনায়। এর সম্ভাব্য সবরকম মিশ্র ও যৌগ সমীকরণ থেকে এক সবল বা দুর্বল বিকিরণই আমরা টের পাই, বুঝতে পারি একজন ও এভাবে বহু মানুষের সমর্থিত ও অসমর্থিত, গ্রাহ্য ও অগ্রাহ্য অস্তিত্ব, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, বিবমিষা ইত্যাদি সংজ্ঞাহীন, জীবনে অপ্রয়োজনীয় এবং ওনলি অর্থপূর্ণ ব্যাপারগুলি। অতএব বলা হল যে, চেতনা আহরণ ও বিকিরণে সমস্ত মানুষই অনন্য। এর ভালোমন্দ বিচার হয় না, কমবেশি বিচারও গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ কারো সমান তো নয়ই।
যেহেতু পরাধীন অবস্থায় মানুষের বৃদ্ধি শুরু হয়, যেহেতু তার প্রারম্ভিক জ্ঞানগুলো সীমিত হয়ে পড়ে পরিচালন ব্যবস্থায়, কেউ বা অনেকে সঠিক আবার বিভ্রান্ত যুক্তিহীন অথবা যুক্তিগ্রহণ ক্ষমতার অধিক প্রকারে চিনিয়ে দেয় পরিপার্শ্ব, সচেতন করে তুলতে চায় বস্তুপ্রকৃতি, বিষয়, জীবনের লক্ষ্য ও মানে বুঝিয়ে দেয় অসময়ে। মানুষ বিভ্রান্তই হয়ে পড়ে সম্পূর্ণভাবে, এবং একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে দেয় সমস্ত জীবন। যাকে সে স্বাভাবিক বলে জানে তা আসলে পাগলামি, কৌশলী ও কুশলতম হয়ে উঠতে চেয়ে সে মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যায়, নিজের বৃদ্ধি নিজেই বন্ধ করে দেয়। তার সময় এগোয় না।
এর মধ্যে যে-মানুষ এই বিভ্রম আবিষ্কার করে, আবিষ্কার করে যুক্তির অসারতা, চেতনার কোনো উদ্দেশ্য নেই, কোনো মূল্য নেই, এটা বুঝতে পেরে বিপন্ন বোধ করে, প্রশ্ন করে, ভেতর আর বাহিরের সমন্বয় খুঁজতে থাকে, টের পায় যে, বৈজ্ঞানিক সত্যগুলো শাশ্বত নয়, প্রতিনিয়ত বদলে যায় প্রেক্ষিত, সম্পর্কের আপেক্ষিকতা, আর এই টানাপোড়েন থেকে উত্তরণের জন্য, অন্য জীবনের পাথেয়র জন্য সে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে বিস্ফোরণের আগে নিজের
খোলসটা ছেড়ে সে দেখতে পায় বিশ্ববস্তুপ্রাণজাত বাস্তব ও বাস্তবিকতা, এক নতুন গতি ও বিচ্ছুরণ, বৃদ্ধি ও পারম্পর্য, সম্পর্কে আনন্দে নবীন গুণচারণ। সে দেখতে পায় শূন্য ও অশূন্য, আলো অনালোর নতুন আধার। পৃথিবীর দিকে মানুষের দিকে নিজের দিকে চেয়ে দুঃখিত হয় সে। একজন কবি জন্ম নেয়। এই অতিচেতনাই বোধহয় কবিকে টেনে বার করে নিয়ে আসে তার শরীর সংসার থেকে উন্মুক্তে, সুস্থিব থেকে অস্থিরে, সুখ থেকে অসুখে, ইনস্যানিটি থেকে স্যানিটিতে এবং একঘরে করে ফ্যালে তাকে যা আসলে ঘরহীনতা, কেননা কবি ভাবে সীমানার ভিতরটাই বাহির আর বাহিরটা ভিতর আমি মুক্ত। তুমি বন্দি। আর হাতটা বাড়িয়েই রাখে উদ্ধারের জন্য। সমস্ত কবিতাই মানুষের উদ্ধারের জন্য মানুষকে উৎসর্গ করা। যারা বুঝল না, বোঝার চেষ্টা করল না, যারা ঐ পাগলামি থেকে বেরোতে চাইল না নষ্ট হয়ে যাওয়া যাদের অবশ্যম্ভাবী, তার জন্য কবির রোদন। কবির চেয়ে কে বড় আছে মানুষের বন্ধু: অতিচেতনার কবিতায় এই চিহ্ন থাকে।
আপাতভাবে বোঝা যাক যে. জটিলতম ও সূক্ষ্মতম ও কুশলতম ব্যবস্থা হল মানুষেরই শরীর, যে, আমি নিজেই। একটি শুক্রকীটে বা একটি জিনে এই সম্ভাবনা এত বৃহৎ ব্যবস্থাপনায় ধরা ছিল, ভাবলেই রোমহর্ষ হয়। আমার চিন্তা ভাবনাও এই ব্যবহারিক সমষ্টিজাত। অথচ এই আবিষ্কার, হর্ষ, নিপুণতার গন্তব্য মৃত্যু, শেষ লক্ষ্য বিলোপ, পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাওয়া। এই বিলীন হয়ে যাওয়া ক্রমশ ছোট হয়ে আসা পৃথিবীর ও প্রতিনিয়ত বেড়ে বেড়ে দুর্বল হয়ে পড়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের। তবু বিলীন হওয়াটাই শেষ কথা নয়। প্রকৃতির চক্র আমরা জেনেছি, শুধু, ততদূর মনে থাকে না। জীবনে বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকাটা স্বাভাবিক সত্য, আমরা জেনেছি। শুধু জানিনি সারা জীবন কাটিয়ে যাওয়া ও প্রতিমুহূর্ত বেঁচে থাকার তফাৎ। প্রতিমুহূর্ত বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করে তোলে কবির আহ্বান অতিচেতনার কবি মানুষের চেতনাকে সংক্রামিত করতে চায় বস্তুগুণে বস্তুপ্রাণে, জানাতে চায় মানুষ ও বস্তুর প্রভেদহীনতা, ইগোর অসারতা, প্রতি মুহূর্তে বাঁচার জন্য আনন্দের সন্ধান, বাস্তবিক দুঃখ কষ্টের জামা কাপড় ছিঁড়ে ফেলার অস্ত্র দিতে চায় মানুষকে প্রেরণা ও লক্ষ্যের নিয়ত পরিবর্তন সার্বিক ভাবে তুলে ধরে ধীরকে দেয় অধীরতা, সুস্থিরকে করে তোলে অস্থির, আমাদের মনোরমার জন্ম দেয়, মৃত্যু দেয়, জন্ম দেয় পরিবর্তিত প্রসঙ্গে, আবার সৎকার করে। সমস্ত কবিতাই এই।
পাথরকে যে পাথর জ্ঞান করে, লিঙ্গকে লিঙ্গই, নারীকে নারী, আর ট্রাফিককে ট্রাফিক, যে আলাভোলা দিন আনে দিন খায় অথবা সম্পত্তি আহরণ করে মরীয়া হয়ে, যে চালাক ও দুঃখী, শহুরে ও গ্রামীণ সেও কবি। যার খোলস ফাটেনি, যার সম্যক জ্ঞান হয়নি। সেই কবি পাথরকল দেখেনি, পাহাড় দেখেনি, তার সুন্নত হয়নি, তার যোনিশাপ মোচন হয়নি, সে বশ্যতা কাকে বলে জানে না, সে যানজট ও জটমুক্তির উপায়গুলো, মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত যন্ত্রপাতির উত্তম বিরোধ ও প্রতিযোগিতা নিয়ে একই মুহূর্তে অবহিত নয়। এই বাস্তব নিয়ে পাতাঝরা ও তুষারপাতের, শাসন ও তোষণের, ফুলগন্ধ ও যৌন উপকারিতার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দারোয়ানি নিয়ে চেতনার বাস্তবিক কবিতা বা বিশৃঙ্খলাজাত অবচেতনের কবিতার দিন শেষ ছে/সম হয়ে গেছে সময় চলে গেছে, যাবেই, এই একমাত্র জ্ঞানেই এখন অতিচেতনার কবিতা লেখার সময়, যা সারা বিশ্বেই শুরু হয়ে গেছে। আমাদের শাসনে আছে এখন বিনিসর্গ যৌনভেদী জীবনসঙ্গী ও পারমাণবিক উত্থান, গত মুহূর্তকে বিদায় ও এই মুহূর্তকে শ্রেষ্ঠ করে তোলার আয়োজন। কে বলেছে মুহূর্ত শুধুমাত্র আনন্দ উল্লাসেই শ্রেষ্ঠ হয়? কখনো মনে হয় দুঃখই মহান করে মুহূর্তকে। মনে হয়, প্রেরণা পুড়িয়ে ফেলি, ধ্বংস করি মুহূর্তকে আর একটা নতুন প্রেরণার জন্ম সম্ভাবনাকে উদ্দীপিত করতে।
ডিসেম্বর ১৯৮৮
বারীন ঘোষাল
জন্ম : ১৯৪৪
মৃত্যু : ২০১৭
বইপত্তর :
কবিতা
সুখের কালক্রম ও সমুজ্জ্বল দুঃখ (কৌরব), মায়াবী সীমুম (কৌরব), সৎকার (কৌরব), হাশিস তরণী (কৌরব), আয়নশব্দ (কবিতা ক্যাম্পাস), গিনিপিগ-একটি তথ্যচিত্র (কৌরব), মুখস্থ ডালিম (কৌরব), লু (কৌরব), এঃ লুলু (কৌরব), কবিতা চালিসা (কৌরব), আলখাল্লার জেব (নতুন কবিতা), মায়াবী হাশিস (কৌরব), বোরখাল্যান্ড থেকে (নতুন কবিতা), মাউসনামা এবং প্রণয়ধ্বনির সফটওয়্যার
উপন্যাস
মাটাম (কৌরব), এক ভারতীয় শীত (কৌরব), উদোমডাঙা (কৌরব)
গল্প
জিন্দাবাদ খালকো (কৌরব), ব্যক্তিগত গদ্য (ভাষাবিন্যাস)
প্রবন্ধ
আমার সময়ের কবিতা (কৌরব), অতিচেতনার কথা (২য় সংস্করণ, কৌরব), কবিতার ভবিষ্যৎ (কবিতা ক্যাম্পাস), ব্যক্তিগত গদ্য (ভাষাবিন্যাস), কবিতার অধিকার (নতুন কবিতা)
অনুবাদ
Guineapig (Self, Kaurab), গণ্ডগ্রাম (ডাঃ রাহী মাসুম রজা - N.B.T.), রঙ্গভূমি (মুনসি প্রেমচন্দ - N.B.T.)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন