বাংলাভাষা নিয়ে কিছু লৌকিক কথাবার্তা

বাংলাভাষা প্রসঙ্গে কিছু বলার আগে জানাতে চাইছি আচার্য সুনীতিকুমার জানিয়েছিলেন— বাংলাদেশে, জাতি এবং ধর্ম-নির্বিশেষে বাঙালি জন-সমাজে ব্যবহৃত শব্দ লইয়া বঙ্গভাষা বা বাংলাভাষা গঠিত (বানান পরিবর্তিত)। আবার বঙ্গ  শব্দটির উৎসনির্ণয়ে দেখতে পাচ্ছি— ১. কার্পাস। ২. বেগুন (ফল), দেশি, ৩. বঙ্গদেশ। মতান্তরে বিতর্কীয় 'bans' (অর্থাৎ জলমগ্ন, স্যাঁতসেঁতে) শব্দ থেকেই বঙ্গ শব্দের উৎপত্তি। (বঙ্গীয় শব্দকোষ)। ঠিক কোনটিকে ধরব। আর কোনটিকেই ছাড়ব, তা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। কবি-প্রাবন্ধিক মুরারি সিংহ জানালো- ধীরেন বাস্কে মহোদয় লিখেছিলেন অস্ত্রিক শব্দ 'বঙা' থেকেই 'বাঙালি' বা 'বঙ্গ'।

ধীরেন বাস্কে উল্লেখিত 'বঙা'-র দিকেই আমার সমর্থন ধার্য করলাম।

আর বাঙালিরা যে ভাষায় কথা বলেন— তা-ই বাংলাভাষা, এতে কোনো দ্বিমত থাকার কথা নেই। নেই-ও।

এখন প্রশ্ন হল কোন বাঙালিরা?

আমি গুটিকয় উদাহরণ দিলেই আপনি আমার মতোই প্রশ্নকর্তা হয়ে যাবেন। উদাহরণগুলি পড়তে থাকুন- ১. কুণ্ডের উপরে, উত্তিষ্টিতে নারে, শিরে মারে বজ্র বারি ০ ম, প, অর্থাৎ বঙ্গালচন্ডী, পাঞ্চলিকা। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ। ২. নিজ সাথে বজর পাড়িনু-০ ন. প.। নবদ্বীপ পরিক্রমা। এই উদাহরণদুটি নিঃসন্দেহে বাংলাভাষায় অমূল্যরতন। কিন্তু এখন বা আজকের বাঙালিদের কাছে এর কত শতাংশ গ্রহণযোগ্য কিংবা ব্যবহার যোগ্য। তাহলে আমি যদি বলি কোন বাঙালির জন্য এটির গ্রহণযোগ্যতা ছিল, কোন সময়ের বা কালের বাঙালিরা এই ভাষা ব্যবহার করতেন- এর সহজতম উত্তরটি হল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষাও বদলে বদলে যায়। এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে কোনো ধন্দ থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। ভাষা প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় হল- Standard colloquial বা সর্বসাধারণের গ্রহণযোগ্য কথা ভাষা। সত্যি সত্যি এমনটা হয় নাকি। হয় না। কথ্যভাষা অনেকটাই স্থানভিত্তিক এবং শ্রেণিভিত্তিক। আলোচনায় শ্রেণি নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করাটা ঠিক না হলেও আমি নিরুপায়। উচ্চবিত্তের ভাষার সঙ্গে নিম্নবিত্তের ভাষার পার্থক্য বিশাল। আবার বাঁকুড়ার ভাষার সঙ্গে বালুরঘাটের ভাষার পার্থক্য খুব সহজেই নির্ধারণ করা যায়, এর জন্য ODBL-এর পাতা ওল্টাতে হয় না কিংবা 'বাঙালির ইতিহাস'-এর ঘুম ভাঙতে হয় না। এসব-ই কথ্যভাষা প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে।

প্রতি ৭০/৮০ মাইল অন্তর কথ্যভাষা বদলে যায়। কাঁথির মানুষজন যে ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করেন খড়গপুর কিংবা কোলাঘাটের ক্ষেত্রে সেটা সরে যায়, সরে গিয়ে অন্য একটি কথ্যভাষা-কে জায়গা করে দেয়। তাহলে কি Standard Colloquial বলে কিছু নেই। তা হবে কেন। এর মধ্যে আমরা একটাকে Standard ধরে নিই। অন্যান্যদের কপালে আঞ্চলিক-এর স্টিকার লাগিয়ে দিই। লাগিয়ে ব্যক্তিগত মুনাফা লাভে সচেষ্ট হই। যেমন বাঁকুড়া পুরুলিয়ার ভাষায় লেখা কবিতার আবৃত্তি করে কতজন করে খাচ্ছেন। আবার এমন লেখক লেখিকা আছেন যাঁরা দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাজের মাসিদের কথ্যভাষা গল্প উপন্যাসে ব্যবহার করে কালজয়ী হয়েছেন। এসব নিয়ে খাপ না খোলা-ই শ্রেয়।

আমরা Standard Colloquial বলতে নবদ্বীপ থেকে কলকাতা-র কথ্য-ভাষাকেই মান্যতা দিয়ে থাকি। এটা এক ধরনের সীমাবদ্ধতা বলেই আমার বিশ্বাস। এর মধ্যে বহু ভাগ আছে। আমাদের কথ্যভাষা বহুধাবিভক্ত। ছোটো একটা
উদাহরণ দিই।

লা-মার্ট, অশোক হল, মডার্ন কিংবা সাউথ পয়েন্টের ছাত্রীরা যে ভাষায় মতের আদান-প্রদান করে তার সঙ্গে মহাকালী পাঠশালা, দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যালয় কিংবা মিত্র স্কুলের ছাত্রীদের বিস্তর ফারাক। তাহলে কোনটি Standard ধরবো, ধরে নিয়ে এগিয়ে যাবো। এগিয়ে যাবো কেন। এখানেই থামিয়ে দিলাম Standard Colloquial-এর প্রসঙ্গটি। এখন সরাসরি কবিতায় এন্ট্রি নিতে চাইছি। কবিতার ভাষা কি কথ্যভাষা থেকে আলাদা কিছু। একটা চালু কথা আছে বা কথা চালু আছে— কাব্যি করে বললে বলতে হয় —অর্থাৎ কাব্যের নিজস্ব একটি ভাষা আছে। যাকে কাব্যভাষা নামে চিহ্নিত করলাম। এখন প্রশ্ন হল যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁদের সকলেরই কি নিজস্ব কাব্যভাষা গড়ে ওঠে। আমি খুবই সেনসিটিভ একটা প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই স্পর্শে কাতর না হয়ে নিস্তার নেই। বিশ্বাস করুন আমি জেনেবুঝে এখানে আসতে চাইনি। কলম আমাকে এখানে এনে হাজির করেছে। এখান থেকে কি আমি পালাতে চাইছি? তা কেন হবে। তাহলে কলমের প্রতি এহেন দোষারোপ কেন। আমি নিজেই তো এখানে অর্থাৎ প্রশ্নটিতে আসতে চাইছিলাম। আলটিমেট শব্দটি এখানে মুখ্য বর্ডার লাইন। এখন আর ধানাই-পানাই করতে চাই না। সিধা বাত, সিধা বলতে চাই। মাইকেল মধুসূদন দত্ত-কে যদি আধুনিক কালপর্বের কবিতার প্রথম কারিগর রূপে স্বীকৃতি দিই তাহলে মাইকেল-এর কাব্যভাষা বা বাংলাভাষা প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে একজন ইংরেজি সাহিত্যের গুণমুগ্ধ পাঠক সচেতনভাবে বাংলাভাষায় কবিতা রচনা করে গেলেন দ্বিধাহীনভাবে। ইরেজিকবিতা দিয়ে শুরু করে বাংলা কবিতায় থিতু হলেন। মনে রাখা কর্তব্য তরু দত্ত কিন্তু বাংলা কবিতা রচনায় ব্রতী হয়নি। যা লিখেছেন সবটাই ইংরেজিতে। মাইকেল তাঁর আগ্রহ এবং লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। যদিও খ্রিস্টিয় পরিবার পরিজন তাঁর ক্ষেত্রে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন অধ্যয়ন-কে। তিনি নিজেকে পুনর্গঠন করে নিয়েছিলেন। তাঁর বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ, কিংবা অন্য প্রসহনগুলি বাংলাভাষায় অপর পিঠ, যা ছিল Standard Colloquial। মাইকেল মধুসূদন দত্তর ডাইরেক্ট প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। গতদশকের ৪০/৫০, ৬০/৭০/৮০-তেও খুঁজে পাওয়া যায়। পরিষ্কার করে বললে বলতে দ্বিধা নেই যে যাঁরাই বাংলাভাষায় সনেট লিখতে চেষ্টা করেছেন, মাইকেল থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেননি। তাঁরা বুঝতে পারেননি উনবিংশ শতকের বাংলাভাষা তাঁদের গ্রাস করে রেখেছিল। তাঁরা বিংশশতকের বাংলাভাষাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। এমনটাই হয়, হয়ে থাকে। তাঁরা মনে করেন তাঁরা ঠিক রাস্তা ধরেই হাঁটছেন, কিন্তু রাস্তাটায় যে পালকি কিংবা জুড়িগাড়ি চলছে তাঁরা তা দেখেও দেখেননি।
এ ব্যাপারে আমার মনে হয় এঁরা রবীন্দ্রচর্চায় মনোযোগী ছিলেন না। এঁরা যদি রবীন্দ্রনাথ-কে কায়মনোবাক্যে মেনে নিতেন তাহলে এঁরা খুব সহজেই মাইকেল থেকে মুক্ত হতে পারতেন। এঁরা মূলত উনবিংশ শতকের ভাষা নিয়ে বিংশশতক-কে শাসন করতে চেয়েছিলেন। ঠিক এখন যেমন, এখনকার কথায় পরে আসছি।

রবীন্দ্রনাথ-ই প্রথম যিনি Standard Colloquial-কে কবিতায় ব্যবহার করলেন কবিতার জন্য আলাদা করে কোনো সূচিপত্র বানাতে হয়নি, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাঁর কাব্যভাষা নির্মিত হয়ে গেল, যার শরীরে মাইকেলের কোনো গন্ধ ছিল না, বর্ণও ছিল না। ভিন্ন এক বাংলাভাষায়। যে ভাষায় আমরা এইতো সেদিন পর্যন্ত কথা বলেছি, ভাব ভালোবাসা করেছি, শোকপ্রকাশ করেছি এমনকি স্বপ্নও দেখেছি। এখানেই উনবিংশ থেকে বিংশ শতক আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ-ই আমাদের আরাধ্য দেবতা। বিশেষ করে বাংলাকবিতা কিংবা বাংলাভাষা নিয়ে কথা বলার জন্য রবীন্দ্রনাথই প্রধান বিবেচ্য। আরো একটা কথা যেটা স্পষ্ট করে বলা উচিত তা হল, রবীন্দ্রনাথ রচিত চরিত্ররা, তা নাটকেই হোক কিংবা গল্পউপন্যাসে, সকলেই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কথা বলেছেন। আঞ্চলিক কিংবা শ্রেণিভিত্তিক বিভাজন করেননি। এই না-করার কারণ খোঁজা বৃথা। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল সব কটি চরিত্রই তিনি নিজে। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে সবকটি চরিত্রের মধ্যে বিলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কোনো চরিত্রের প্রতি তাঁর পক্ষপাত ছিল না। 'রক্তকরবী'র কয়েকটি সংলাপ শুনে নিই।

নেপথ্যে (রাজা) আচ্ছা, হাত সরিয়ে নিচ্ছি। পালাও তুমি, পায়রা যেমন পালায় বাজপাখির ছায়া দেখে।

নন্দিনী: দেখতে দেখতে সিঁদুরে মেঘে আজকের গোধূলি রাঙা হয়ে উঠল। অধ্যাপক: যে অপরাধের শাস্তি দেবার কেউ নেই সেটা হতে পারে, কিন্তু অপরাধ নয়।

বিশু: সেই আকাশটা আছে বলেই তোমাকে গান শোনাতে পারি।

সর্দার: হৃদয়ের দান, যত অপেক্ষা করবে তত দাম বাড়বে।

গোঁসাই: আহা, শুভ্র প্রাণের দান, ভগবানের শুভ্র কুন্দফুল। বিষয়ী লোকের হাতে

পড়েও তার শুভ্রতা ম্লান হয় না।

কিশোর: শাস্তিতে তো আমাকে বাজাবে না, আমার বয়স অল্প, আমি খুশি হয়ে সইতে পারবো।

৭ জন কুশীলবের ৭টি সংলাপ। বাঁ-দিকের নামগুলি মুছে দিলে বলা যাবে না কোনটি কার। এতটাই আত্মমগ্ন ছিলেন নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ। এরই নাম বাংলাভাষা।
১৩৩১-এ আশ্বিনে প্রবাসী পত্রে প্রকাশিত হয়। ১৩৩০-এ শিলং-এ যক্ষপুরী নামে প্রথম রচনা করেন। পরে নামকরণ করেছিলেন নন্দিনী। প্রবাসী-তে ছাপা হয় রক্তকরবী নামেই। রচনা ১৩৩০ আর আজ ১৪২০ অর্থাৎ প্রায় ১০০ বছর। বাংলাভাষা তো তেমনভাবে পরিবর্তিত হল না। এই কথা বলে থেমে গেলে চলবে না। ভাষা তো নদীর মতো। নদী মোহনায় এসে সমুদ্রে মিশে যায়। ভাষার কোনো মোহনা নেই। সে কারণে সমুদ্রও নেই। সে কারণে ভাষা কোথাও মিশে যেতে পারে না। কথাটা ঠিক বললাম না। ভাষা মিশে যায়। মূলত দুটি কারণে ভাষা মিশে যায়।

এক-শাসক সম্প্রদায়ের ভাষা মিশতে থাকে আইন ব্যবস্থায় এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে। যা পরবর্তীতে Standard Colloquial-এ এসে পড়ে। যেমন মুঘল শাসনকালে বহু ফার্সি শব্দের অনুপ্রবেশ হয়েছিল বাংলাভাষায়। আবার ব্রিটিশ শাসনকালেও অনুরূপভাবে ইংরেজি শব্দের সংযুক্তি ঘটেছিল। এর উদাহরণ দিলে পাঠকের অধ্যয়নশীলতাকেই চ্যালেঞ্জ করার সমতুল বলে মনে হয়।

দুই- বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে বহু শব্দ আমাদের কথা এবং লেখা ভাষায় ব্যবহার্য হয়ে যায়। যেমন ট্রেন সিগন্যাল ট্রাম ট্রাক্টর পেট্রোল ডিজেল থেকে শুরু করে হাল আমলের কম্পিউটার-কেন্দ্রিক শব্দগুলিকে বাংলাশব্দে গ্রহণযোগ্য করে নিয়েছি। এগুলি আমাদের কথ্য ভাষা যেমন চালু হয়ে গেছে, তেমনই গদ্য এবং কবিতায় এর নিত্যব্যবহার লক্ষ করা যায়। এই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে।

রবীন্দ্রনাথে থেমে গিয়েছিল সাহিত্য প্রসঙ্গ। এখন রবীন্দ্রপরবর্তী কবি এবং লেখকদের দিকে নজর দিতে চাইছি। এই অনুষঙ্গে আমি সরাসরি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ে এসে নোঙর করতে চাইছি। আমার বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের পর একমাত্র সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা কিংবা গদ্যভাষার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। এ নিয়ে তর্ক হতেই পারে। যাঁরা তর্ক করতে চান করতে পারেন,
বাধা কোথায়। আমি আমার বিশ্বাসে অটল থাকতে বাধ্য। এর যাবতীয় পাপপুণ্য আমার নিজের। মাত্র কয়েকটি পঙ্ক্তি-

১. মাটিতে ড্যাং ড্যাং করে হেঁটে যাবে।

২. আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে।

৩. গল্পটার কোনো মাথামুণ্ডু নেই বলে/বুড়ো ধাড়িদের একেবারেই/ভালো লাগলো না। 

৪. আলো জ্বালতেই/জানলা দিয়ে বাইরে/লাফিয়ে পড়ল অন্ধকার।

৫. ঘোড়াগুলো বাঘের মতো খেলছে।

এরকম দশহাজার পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃত করা যায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে। যা রবীন্দ্রভাষায় আপ্লুত নয়, বরং নিজস্ব বাকশৈলী।

এই ভাষাতেই ভর করে তাঁর সমসাময়িক কেউ কেউ খ্যাতির শীর্ষে উঠে গেছেন। একজন আলোচকও মুখ ফুটে বলার সাহস দেখাতে সক্ষম হয়নি। কারণ তিনি ছিলেন দুই সরকার বাড়ির অভিভাবক। তাঁর চোখের বালি হব কেন। গেলে তাঁর কুনজরে ভস্ম হয়ে যেতে হবে। এ তো গেল কাব্যভাষা। আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর ভূতের বেগার  যাঁরা পড়ার সুযোগ করে নিতে পারেননি, তাঁরা জানতে পারেননি, কী কৌশলে কিংবা দক্ষতায় থিয়োরি অফ সারগ্লাস ভ্যালু-র মতো দুরূহ একটি বিষয়কে জলবৎ তরলং করে, উপস্থাপিত করেছেন। আমার মতো মুখ্যসুখ্য জনেরাও অর্থনীতির ওই জটিল বিষয়টি বুঝে ফেলেছিলেন।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর কবিতায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব এখনো দেখতে পাওয়া যায়। আজকের কবিতায়।

এটি কোনো গবেষণাপত্র নয়, এটি বাংলাভাষা বিষয়ে গুটিকয় অবজারভেশন মাত্র।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর জীবিতকালেই উপস্থিত হল তথ্যপ্রযুক্তি-বিপ্লব, যা শিল্পবিপ্লবের পরে একমাত্র মহান ঘটনা। শিল্পবিপ্লব জন্ম দিয়েছিল আধুনিকতার বা আধুনিক কবিতার/সাহিত্যের/শিল্পের। আর তথ্য-প্রযুক্তি বিপ্লবের পর কি কিছুই হবে না। একরৈখিতা থেকে কি বহুরৈখিকতায় সরে আসবো না। আমাদের পোশাক পাল্টে যাবে, ফুডহ্যাবিট বদলে যাবে, সম্পূর্ণ যাপনপ্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটে যাবে। আর কবিতা পড়ে থাকবে আধুনিকতায়, তা হতে পারে না। যাঁরা নিজেদের আপডেট করতে ভয় পান, তাঁদের ভয়ের কারণ আছে। তাঁরা মনে করেন, তিনি কবিতাকে আপডেট করতে সক্ষম কিন্তু তাঁর সমস্ত লালিত পাঠককুল যদি এই আপডেট গ্রহণ না করে, তাহলে তিনি পাঠক-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। যেমন কোনো কোনো রবীন্দ্রসংগীত গায়িকা চেনা-রবীন্দ্রগান গেয়ে থাকেন মঞ্চে, শ্রোতারা দর্শক আসন থেকে মনে মনে গুনগুন করেন। তিনি শ্রোতাদের মন জয় করে নেন সহজেই।

তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক চিহ্নগুলি যে কেবলমাত্র আমরা-ই দেখেছিলাম, এমনটা নয়, দেখেছিলেন সকলেই। কিন্তু ছিলেন ব্যাকফুটে, অগ্রগতিকে আটকে রাখায় সচেষ্ট ছিলেন, বিরোধিতায় অন্ধ ছিলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন না কীভাবে বাংলাকবিতা বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তনের চিহ্নগুলিকে একত্রিত করার বাসনা নিয়ে ২০০২ সালে আমরা প্রকাশ করলাম পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা, যা ভূমিকম্প ঘটালো প্রচলিত বাংলা কবিতায়। কেউ কেউ ভেবে বসলেন পাঠক যদি একবার এই কবিতার স্বাদ পায় তাহলে তাঁদের কবিতা অদ্ভুত হয়ে যাবে। এমনটা ভাবার কোনো কারণ ছিল না। কেননা রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করা মানে মাইকেল-কে অস্বীকার করা নয়। এই সহজ সত্যটা আমি বারবার বলেছি, লিখেছি। তবু ভবি ভোলবার নয়। এখন পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা গ্রন্থটি থেকে কয়েকটি পঙ্‌ক্তি যা বাংলাভাষাতে নতুন রূপরেখা নির্মাণ করেছিল—

১. গোলাপগন্ধের জ্যামিতি নিয়ে একটু এদিক ওদিক করলেই আলোকে পুলকে ভেসে ওঠে এক স্বপ্নময় রাত্রি, (গদাধর দাস)

২. একটা হলুদ গাছ মারা যাবার আগে আমাকে উপহার দিয়েছিল একটা নীল বোতাম। (কামাল হোসেন)

৩. ক্যানিং রোডের পাশে এই যে ছাতাটি তার থেকে একুশ পা দূরে আমাদের এই স্কুলটি অর্থাৎ জাগলিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। (জয়দীপ চক্রবর্তী)

৪. আমার পা দুটি স্টেশন থেকে ট্রেনকে তুলে নেয়/প্লাটফর্ম লাস্ট বাসে তুলে দিয়ে বিদায় জানাতেই/বাড়ি আমার দিকে ছুটে আসতে থাকে (শ্যামল শীল) 

৫. ঘর ও পৃথিবীর সন্ধি-রেখাটিকে দরজা বলে চিত্রিত করা হলে ঘর ও আকাশের ভেদ-রেখাটিকে জানলা নামে চিহ্নিত করা যায় ফলে গণিতভাষায় দরজা-জানলা) যা দাঁড়ায় তা হল: (ঘর-পৃথিবী) (ঘর-আকাশ) অর্থাৎ এককথায়, (পৃথিবী-আকাশ)

(সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়) এইসব কবিতার যে ভাষা তা বাংলাকবিতার পরিচিত ভাষা নয়। কিন্তু যুগের ভাষা, বাংলাভাষা।

যুগে যুগে ভাষার পরিবর্তন হয়েছে কবিদের কলম থেকেই। এটা জানা কথা, তবু আর একবার জানিয়ে দিলাম।

এখন নিবন্ধটির শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। Standard Colloquial বদলে গেছে। আমরা এখন সোমবার-কে Monday বলি, শুক্রবারকে ফ্রাই ডে। এটাই বাংলাভাষায় রূপান্তর। আমরা প্রমাণ করি না, প্রুফ করি। আমরা অনুগত নই, ওবিডিয়েন্ট।

আমার এইসব হল্লাগুল্লা প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮-এ। আমার সময়ের একজন কবি বলেছিলেন— এগুলি বাংলাকবিতা নয়। অর্থাৎ বাংলাভাষায় লেখা কবিতা নয়। কোন বাংলাভাষা! ১৯৬০—এর বাংলাভাষা নয়, কিন্তু ২০০৮-এর বাংলাভাষা। প্রায় ৫০ বছরে ভাষা যে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, এই সাধারণ বোধটুকু যাঁদের নেই, তাঁদের সঙ্গে তর্কে যাওয়া অর্থহীন। বাস, মিনিবাস, ট্রেনে আজকের কিশোর-কিশোরীরা যে ভাষায় নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময় করে তা মনোযোগ দিয়ে শুনলেই বোঝা যাবে ভাষাটা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। কূপমণ্ডুক-রা চিরকাল কুয়োটিকে পৃথিবী ভেবে বসে থাকেন। কুয়োর বাইরেটা কোনোদিন দেখতে আগ্রহী নন। আমার অনুরোধ কুয়োর বাইরে বেরিয়ে আসুন, দেখুন আপনার চারপাশটা কতটা সুন্দর, কত বিস্ময় বেছানো আছে এই ম্যাজিক-দুনিয়ার।

এই অবস্থায় বা অবস্থান থেকে যদি আমি লিখি-
ঠিক কতদিন ধরে এই আইসোলেশন ওয়ার্ডে আছি তা বলতে পারছি কই, বুঝতে পারছি, বোঝানোর মতো কোনো ইমোশন তুলে আনতে পারছি না বলে একে গফটেড আখ্যা দিতে পারি, এর ফলশ্রুতিতে আমাকে যে কিচেন ক্যাবিনেট তৈরি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এমনটাও নয় আমার উপদেষ্টা আমি নিজেই, কৃষ্ণপক্ষের আমিকে অ্যাডভাইস দেয় শুক্লপক্ষের আমি, আর শুক্লপক্ষের আমি-র হাত ধরে থাকে কৃষ্ণপক্ষের আমি, এটা কোনো লাভস্টোরি নয়, ফেয়ারিটেলও নয়, এটা পুরোপুরি অরিজিনাল, মাত্র এককপিই ছাপা হয়েছে, যিনি তালগাছকে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন, তিনিই বলে দেবেন আমি অপ্রাসঙ্গিক কিছু লিখছি কিনা, লিখলে আমার কবিতালেখার হাতটি যেন খসে যায়।

একে কি বাংলাকবিতা রূপে মেনে নেওয়াতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে, তাহলে একে বাংলাকবিতা বলবেন না। তাতে আমার কিছু যাবে আসবে না, আমি তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত নই। আমি আমার কার্যক্রম চালিয়ে যাবো, অর্থাৎ যা লেখার কথা তা লিখে যাবো। কারণ আমি জানি ৭০/৮০ মাইল অন্তর মানুষের কথ্যভাষা বদলে যায় আর ৫০ বছর অন্তরও ভাষার বদল হয়। এইসূত্রটি যাঁরা মেনে নিতে অনিচ্ছুক তাঁরা একসময় বুঝতে পারবেন যে ট্রেনটিতে ওঠার জন্য তাঁরা এসেছিলেন, সেই ট্রেনটি এসেছিল, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল, মনে দ্বিধা থাকায় তাঁরা উঠলেন না। আর ট্রেনটি প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে গেল গন্তব্যের দিকে, পরে তাঁরাই অনুশোচনা করবেন। গতস্য শোচনা নাস্তি— এটা এখনো মিথ্যা হয়ে যায়নি।

(নানারকম  থেকে) 
















প্রভাত চৌধুরী

জন্ম :17/06/1945
মৃত্যু : 19/01/2022

প্রকাশিত গ্রন্থতালিকা

কবিতা :
শুধু প্রেমিকার জন্য (১৯৬৬)
বিস্ফোরণে জ্বলন্ত নগরে (১৯৬৮)
দিনবদলের পূর্বাভাস (১৯৭১)
ব্যক্তিগত কবিতা (১৯৭৩)
প্রভাত চৌধুরী (১৯৭৯, ২০০০)
সাদাকথা (১৯৯৪)
কাঠের পা, ঘোড়ার পা (১৯৯৫, ২০১৭)
সন্তরণ প্রতিযোগিতার ধারাবিবরণী (১৯৯৬)
আমি মেফিস্টোফেলিস (১৯৯৭, ২০০৩)
সাক্ষাৎকার (১৯৯৭, ১৯৯৮, ২০১১, ২০১৯)
আবার সাক্ষাৎকার (১৯৯৮, ২০১১, ২০১৯)
নোটবই (২০০০, ২০১৪)
প্রেরিত বার্তা (২০০১)
বর্ণপরিচয় (২০০২)
পূর্বাপর (২০০৩)
উত্তরপর্বের কবিতা (২০০৪)
তরজাপদ (২০০৬)
এইসব হল্লাগুল্লা (২০০৮)
ঘরগেরস্থালি (২০১৩)
সুন্দরবন ও অন্যান্য কবিতা (২০১৫)
1/8 ক্রাউন, 4F (২০১৯)
কুশলসংবাদ (২০২৩)
পিসুটপের পর (২০২৩)


প্রবন্ধ :
কবিতার প্রেরণা, উৎস (১৯৯৭)
পোস্টমডার্ন মানচিত্র (২০০০, ২০০৩, ২০১৭)
কবিতার ম্যানিফেস্টো (২০০১)
লাবণ্য, একী লাবণ্য (২০০৩)
নানারকম (২০১৯)


উপন্যাস :
সতীসাবিত্রী কথা (১৯৮১, ২০০২)
দুঃখের পায়রা (১৯৮২)
অনুপম কাহিনি (২০০৯)
দুঃখের পায়রা (১৯৮২, ২০২৪


ভ্রমণ :
কুমায়ুন গাড়োয়াল (২০০৭)
চারধাম (২০১০)
হিমাচলে ২৭ দিন (২০০৮, ২০১৬)


আত্মজীবনী
শৈশব / আত্মজীবনীর প্রথম পর্ব (২০১৪)
সুন্দরের দিকে / আত্মজীবনীর দ্বিতীয় পর্ব (২০২০)


কাব্যনাটক :
TRAM

সম্পাদিত গ্রন্থ :
আজকের কবিতা (১৯৬৮)
পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা (২০০২)
নয়ের দশকের কবিদের নির্বাচিত কবিতা (নাসের হোসেন-এর সঙ্গে যৌথ) (২
আমাদের নাসের হোসেন (২০১৮)
আমাদের গৌরাঙ্গ মিত্র (নাসের হোসেন-এর সঙ্গে যৌথ) (২০২০)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন