একদিন, এক রাতে, এক বৃষ্টির শব্দে ঘুমের মধ্যে বুঝতে পারি আমার রোজকার জীবন ধারণের অভিজ্ঞতার উপচে পড়া ঝুলিটা তেমন কাজের না। তা আমাকে লিখতে উৎসাহ দেয় না। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বোঝা বহনের যোগ্যতা আমার লেখার নেই। বরং, পরোক্ষ অভিজ্ঞতার কাছেই আমার, আমাদের যত ঋণ। গ্যালিলিও, রেমব্রা, আলতামিরা বা ভিমবেটকা। হারিয়ে যাওয়া রূপকথা থেকে ডালপালা মেলে বেড়ে ওঠা গল্প। কিছু বিজ্ঞান ও অবশ্যই কিছু অপবিজ্ঞানে নির্ভর গহীন বনের আদিবাসীদের চিকিৎসা শাস্ত্র। যেদিকে চাই, যাতে নাড়াচাড়া খাই এবং লেখার লোভ জাগে সবটাই অপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। অন্যের উপলব্ধির পালে উচ্চকিত ফু দিয়ে আমার নৌকো স্বপ্ন দেখে। সুখের স্বপ্নের কাজ কম, দুঃস্বপ্নের বাটখারা ওজনদার, রোমহর্ষক যতটুকু মনে রাখা যায়। যতটা ভুলে যাই ততটাই নিজেকে ঠকাই। কিছু চিন্তা নিজেই অনাথ হলো ঘুমের মধ্যে। মনে থাকলে বলা যেত মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর। কিন্ত মনোহর ঘুমের একটু আগে এলো। তুষার চৌধুরী আর প্রজিত জানার সঙ্গে আকন্ঠ ছাঁইপাশ (মা বলতেন। কারণ তাঁর মা-ও বলতেন) গিলে দরজার বাইরে পা দিয়ে দেখলাম সামনেই মনোহর। মনোহর চল্লিশ বছর অলিপাবে মদ পরিবেশন করছে। একমাত্র বেয়ারা যে সবাইকে বোঝাতে পারে সবাই পেগে বেশি পায়। এবং, মালিককে বোঝায় সবাইকে ও কম দিয়ে কোম্পানির আয় বাড়ায়। অভিজ্ঞতার বিনিয়োগ মনোহর শেখাতে চেয়েছিল। কিন্ত যে স্বপ্নে মুক্ত হতে চায়, তাকে বোঝানো অসম্ভব। তার লাভ লোকসান আলাদা। মনোহর বালেশ্বরে নিজের হোটেলের গল্প বলে। আমার স্বপ্নের নোনা ঢেউ মাঝরাতে ওর হোটেল তছনছ করে দেয়। ঘুমের মধ্যে বিছানায় জড়োসড়ো মনে মনে পড়ে অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে লেখা কি বদলায়? কতটা বদলায়? এরকম একটা বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখা চেয়েছে এক সম্পাদক। এবং, প্রথমে মনে হয়েছিল বিষয়টা আমি বুঝি। এবং, বিষয়টা বেশ সহজ, খানিকটা স্কুলপাঠ্য বইয়ের তাৎক্ষণিক বক্তৃতার মতো। এবং, কিছু আলগা ওপরচালাক স্মার্ট কথা বললেই কেল্লা ফতেহ হবে। মানে, সম্পাদক যে চাটনিটা চাইছেন সেটা হবে। কিন্ত বিষয়টা আসলে বেশ গোলমেলে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে কবিতাও কি বদলায়? এখান থেকেই শুরু জটিলতা। অভিজ্ঞতা বলতে কী বলতে চান আপনি? এবং, কবিতার অভিজ্ঞতার ও অভিজ্ঞতার কবিতা কি এক? তারচেয়েও বড় ঝামেলা হল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতার প্রভাব এক নয়। এবং, আমার বিশ্বাস সাহিত্যের রিয়েলিস্টিক সৃষ্টি ছাড়লে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার তেমন দাম নেই। লেখা যত মস্তিষ্কনির্ভর হবে ততই এর দাম কমবে। এবং, বিতর্ক সভার মতো বা আগেকার দুই মহাপণ্ডিতের তর্ক যুদ্ধের পর একটি বিশেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। কবিতার পথ একটাই না, মোটামুটি একই ধরনের অভিজ্ঞতা থেকে এক পরিবেশের প্রতিটি মানুষের কাছে কবিতা দেখার মন ও চোখ একইরকম হবে না। শুধুই অভিজ্ঞতা খুব গুরুত্বপূর্ণ হতো সৃষ্টিশীল কাজের জন্য তাহলে দাউদ ইব্রাহিম বা চেন্নাই-আমেদাবাদ রুটের ট্রাক ড্রাইভার হতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখক। বলবেন ভাষা ও অনুভূতি প্রকাশের কলা তার নেই। সেটাও শেখানো সম্ভব। কিন্ত ভাবুন তো একজন অন্ধ কবি কী করে অসংখ্য নানা চরিত্র নিয়ে অদেখা ভূগোল ও অগম্য ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রের প্রেম ও পরিণয়ের কাহিনী লেখেন কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া? ভাবুন জীবনের বেশিরভাগ সময় ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসা এক লেখক লাইব্রেরি থেকে কী করে পৃথিবীর সব চোখের চেয়েও অভিজ্ঞ দৃষ্টির অধিকারী হয়ে ওঠেন। এসব শুধুই হোমার বা বোর্হেসদের মতো স্বীকৃত অন্তর্দৃষ্টির অধিকারীদের কথা বলছি না। বেশিরভাগ সৃষ্টিশীল মানুষ পৃথিবীর অনেক অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের যথাযথ ব্যবহারের পরও স্বীকৃতি ছাড়াই মহা বিশ্বে নিরুদ্দেশ যাত্রায় সামান্য কণা হয়ে হারিয়ে যায়। ফলে, অভিজ্ঞতার যৎসামান্যই প্রকৃত কাজে কাজ দেয়। আসলে আমরা আপাতভাবে এক হলেও বিবিধ অভিজ্ঞতার গোলোকধাঁধায় ঘুরপাক খাই। অভিজ্ঞতার সঙ্গে কবিতা বদলে যায়? না-জানে এমনটা কেন কবিতার প্রসঙ্গেই বলা হল? আসল কথা হলো বদলে যাওয়া। আপনি প্রতি মুহূর্তেই বদলে যান। সংবেদনশীল হলে টের পান একটু আগে। এবং, আরও মজার ও বিস্ময়কর ব্যাপার হল মানুষ নিজের অভিজ্ঞতার সামান্যই ব্যবহার করে। আপনি আগের মাসের আপনি একেবারেই নেই। চান বা না চান একদম পরিবর্তিত রূপ ধারণ করেছেন। এবং সেটা আপনি জানেন না। কারণ আপনি অন্যের অর্জিত জ্ঞান বা বকলমে অভিজ্ঞতার ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে নিজের দিকে তাকাননি। সূর্যর দূরত্ব থেকে পিরামিডের স্থাপত্য, চৌকো বস্তু থেকে গোলাকার চাকা অথবা স্টিম ইঞ্জিনের ভূমিকার কিছুই আপনার অভিজ্ঞতা নয়, কিন্ত আপনার অভ্যাস তাকে আপনার করে তুলেছে। ফলে, কবিতা নয়, শিল্প সাহিত্য বা মটন কাবাব অথবা একটা বনসাই লালনপালনের জ্ঞান আসলে অভিজ্ঞতার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস। আমি কবিতার লোক নই, নিপাট গদ্যের মানুষ। কিন্ত বেসিক প্রক্রিয়া এক। নির্মাণ কৌশল ও শ্রম আলাদা। এবং, শ্রম শুনতে যতই মুঠো লাগুক না কেন এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অভিজ্ঞতার পুনর্নির্মাণের জরুরি উপাদান। আসলে শেষপর্যন্ত অভিজ্ঞতাকেও সচেতনভাবে কামার-কুমোরের মতো নতুন বস্তুর রূপান্তরে কাজে লাগানো সম্ভব। যে যত তীক্ষ্ণ সে তত কল্পনাপ্রবণ। ফলে, অভিজ্ঞতার চেয়ে জরুরি তাকে সৃজনশীল দিশায় বিনিয়োগ করা। এর বিরুদ্ধে আমি নিজস্ব কিছু প্রক্রিয়া খুঁজি। আমার মনে হয় স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নও আসলে অভিজ্ঞতার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ফলে, আমি ভাবি, আমি ঘুমোই, ঘুমিয়েই আমার বয়স ও অভিজ্ঞতা বাড়ে। কল্পনার ডানা গজায়। আর আমি বদলে যাই। আমার লেখা বদলে যায়। তারা আমাকে বলে অভিজ্ঞতাকে ভরসা কোরো না। ঘুমোও, ঘুমে পড়ো। স্বপ্ন তোমাকে অভিজ্ঞ করবে। ফলে, কবিতা পড়ছি, ঘুমোচ্ছি, পোস্ট করছি, ঘুমোচ্ছি, কবিতা জোটাচ্ছি, মৃত বন্ধুদের স্বপ্নে ঋণ শোধ করছি, কৃচ্ছসাধন করছি, কবিতা জোটাচ্ছি, কেউ কেউ খিস্তি দিয়ে বলছে বালের কাজে হেল্প করতে পারব না, মন খারাপ হলে মদ খেয়ে মনে মনে সেই অবোধকে তার নির্বোধ শব্দহীন অন্ড মালার বাণিজ্যের জন্য মাফ করে জ্ঞানপীঠ দিচ্ছি, ভাবছি চিরকালের নিয়ম মেনে ছোট কাগজ ছোট কাগজের শত্রু, সব চিলি ক্র্যাব, তাদের ভুলতে ভাল বন্ধুদের কথা ভাবি, কবিতা পড়ি, নিজের বড় গল্পের নোট নিই কল্পনার থেকে ধার করে, ঘুমোই, ঘুমে বড় গদ্য লিখি, শেষের দুটো চ্যাপ্টার লেখা হয়ে যায়, তারপর ঘুমের মধ্যে আরও ঘুম পায়, যে- কবিদের লেখা দিলাম তারা আদিখ্যেতা করে আমার মাথা চুলকে বলে এত সম্মান জানিয়ে ভুলে যাবি না তো? যখন কেউ পুরস্কার দেয় তখন আমাদের সন্দেহ হয় এটা বোধহয় পিণ্ডদান। অন্তিম পেরেক। আমি বলি, আমি বাবা- মায়ের পিণ্ড দিইনি গয়ায় ঘুরেও। পাণ্ডাদের বলেছি, আমি তো চাই না আমার প্রিয়জনরা মুক্তি পাক, ওদের আত্মা এই পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াক, আমার ঘাড়ে চেপে নাচুক, ওরা লিখুক, আমায় দিয়ে লেখাক,ওদের জন্য বেঁচে থাকি,ওদের সব লেখাই আমার লেখা, আমি পরে জন্মেছি বলে ওরা আমার হয়ে লিখে গেছে, তাতে আমার ক্লেম নষ্ট হবে কেন, এখানে যা ছাপছি সবই আমার, সবের ওপর সবার হক আছে, যেমন আমি যা লিখি তা সবার, মৃতরা বলে, অত উদার হওয়া যাবে না, ওসব আমাদের; তাহলে আমার লেখা মৃতরাই বোঝে হয়ত, জীবিতরা কিছুই বোঝে না, তাদের শর্ত থাকে তাদের লেখা বা তাদের কাগজের সুনাম করতে হবে, অতটা পারি না, বলা ভাল আমার আসে না, যতবার আমি তেল দেওয়ার চেষ্টা করেছি, ব্যর্থ হয়েছি —তারা বলে, আমার লেখা এত ভাল বললে কেন, নিশ্চয়ই কিছু ধান্ধা আছে, আমি বলি আছে, আমিও তোমাদের একজন হতে চাই, অতটাই করাপ্ট, ক্ষুদ্র গোষ্ঠীপতি। তারা এড়িয়ে চলতে থাকে, ফলে যাব কার কাছে! সেই মৃত কবিরা বা অচেনা জীবিত নিঃসঙ্গ লেখকরা, যারা বাইপোলার, যারা স্কিৎজোফ্রেনিক, যারা অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে ভোগে, তারা আর তো লেখক নেই, আর তো সম্পাদকও নেই, আর বন্ধু নেই। এরা চমৎকার, এদের উপস্থিতি সৃষ্টির পক্ষে ভাল, সহৃদয়। শুধুই সাহিত্যের কাছাকাছি থাকতে শুধুই অচেনা বন্ধুদের নিয়ে একটা কাল্পনিক আদর্শ সঙ্ঘের আশায় আমি কবিতা টাইপ করি। আমি কাহিল হয়ে ঘুমোই, আমি ম্যাগনিফাইং গ্লাস বালিশের তলায় নিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবি সকালে কার ঝাপসা টেরাবেঁকা বইয়ের ছবি থেকে কবিতা উদ্ধার করব। কখনও কখনও না ভাবা, কখনও আমার মতো না ভাবা বিশেষ গদ্যের সম্ভার উপজাতির কুঠার স্পর্শে অলীক দেখায়। আর বিশাল ডানার অ্যালবাট্রসদের সেগুলো দিই ঠিক পাঠকদের ডেলিভারি করতে। প্যাসিফিক পেরনোর সময় ঠিকানা স্ক্যান করে সমুদ্রের ঠিকাদার। সাতটি মেগা সিরিয়ালের স্ক্রিপ্টলেখিকা আর মর্নিং ওয়াকের হালকা লোকটা যেন ভুল করেও এসব মাদক, এইসব বারুদের খবর না পায়। আমার ভাল লাগে, ঘুমের মধ্যে মৃত ও জীবিত মানুষরা এসে আমার মধ্যে নতুন লেখা জাগিয়ে তোলে, যেগুলো তাদের থেকে ১১০০ বছর আগে তৈরি হয়েছে, আমি ফাঁক পেলে সেগুলোই লিখব......... যার কোনোটাই আমার অভিজ্ঞতার ফিক্সড ডিপোজিট নয়। কিন্ত প্রতিটা বদলে যাওয়া লেখা আমার। একই অভিজ্ঞতা কেলাসিত হয়ে অনন্ত বিপদের হাতছানি জানাচ্ছে।
অতীত কথা বলে কবিতায়। নিজেকে যে বুঝেছেন এটাই বড় কথা। এতেই চেতনার মুক্তি, পাঁপড়ি ফোটে আর ঝরে সহস্রদলের।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন