যেমন চাবুকে থাকে সমুদ্রের ধার। সপাং!!!!!!!!!!!!! আর সংক্রামক থুতুর গুঁড়োগুলো উড়তে থাকে। স্পষ্ট হতে শুরু করে রক্তের লম্বাটে ফালি। ওই স্পষ্টতাকে বিশ্বাস করা যায় না। ও তো ঝরবে না। ঝরে পড়বে না। পাখির ঠোঁটের চেয়েও শক্ত হয়ে আটকে আছে ও। কেউ যে একবার সিঁড়ির তলায় ব্লেড ঘসে দিয়েছে, ও আর মুছবে না। মুছে দেওয়া যাবেই না ওকে। পাখনা কেটে দেওয়া আঘাতগুলো আসলে আর জীবনে অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে থাকতে চায় না। ওরা বীজ হতে চায়। বালিশ সরে যাওয়া টাকার মতো নয়। জল, ঘুম, আর জানালার সম্পর্কের মতোই কিছু আঘাতের স্মৃতি। কিছু ক্ষতচিহ্নের স্থায়ী হওয়ার শক্তি। ১টা ক্ষতচিহ্ন সচরাচর আর ১টা ক্ষতচিহ্নের বন্ধু হতে পারে। শত্রু হতে পারে। ক্ষতচিহ্নদের চরাচরে কে যে কাকে স্বাগত জানায়।

“তোমাকে আমি ৬ মাত্রার ক্ষতচিহ্ন দিলাম। এই চিহ্নকে তুমি যেমন তেমন ভেবো না। একে যে তুমি নিয়ে যাচ্ছ, কিছুদিন টক খেও না। পেঁয়াজ খেয়ো না। শুদ্ধ হয়ে গ্রহণ কোরো একে। এর কাছে কোনো তীব্রতাকে ঘেঁসতে দিও না। কোনো রিপুর সঙ্গে ঘসা লেগে এ যেন মিলিয়ে না যায়। অর্ধেক খালি পেয়ালায় একে ঢেলে গ্রহণ কোরো। অন্য কোনো ক্ষতচিহ্নের প্রয়োজন হবে না। এই ক্ষতচিহ্ন নিজেই নিজেকে পুনরুৎপাদন করতে পারে।”

“৬ কেন? ৩০ বা ২০০ বা ১০০০ নয় কেন?”

“১ ধাক্কায় অতটা তোমার সহ্য হবে না। বরং দিনের মধ্যে কয়েকবার নিও।”

“র নয় কেন? ০ মাত্রার ক্ষত তো দ্রুত কাজ করে! সে চিহ্ন নয়। দগদগে। পুঁজরক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সে ধাক্কা দ্যায় না। স্পষ্ট কাজ করে।”

“সুখ সারাতে চাও? না, অসুখ?”

কিছু কিছু মেঘ ঠিক সূর্যের মতোই জ্বলে। ১ চামচ ২ চামচের চেয়ে গাঢ় হয়ে থাকে। ৩ চামচ ২ চামচের চেয়ে পাৎলা। হাওয়া আমাকে যে সম্পর্ক দিয়েছিল, সেখানে পুকুরের নয়, হিন্দু হোটেলের বাটামাছ ছিল। হ্যাঁ, পুকুরকে আমি ছায়া বলে ডাকি। সূর্য দেখা যাচ্ছে না। তবু যেমন দুপুর হয়ে থাকে। তবু যেমন ভেতরটা সূর্য হয়ে থাকে। সাদা মেঘের রোদ চলে যায় কৃষ্ণচূড়ার দিকে। মানুষ নিজেকে প্রকৃতির চেয়েও অনেক স্তব্ধ ভাবতে পারে, অন্তত কয়েক মুহূর্তের জন্য। ১টা দীনদরিদ্র আংটির মধ্যে ঢুকে পড়তে চায় দুপুর। দুধের মতো সাদা দুপুর হয় ১টা। গরীব আর রোগা মানুষগুলো সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপির বাইরে শুধু ভাত হয়ে যায়। ক্যালেন্ডার ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা তারিখ হয়ে যায়। ঠিক যেমন ১৫০ কিলোমিটার দূরের বাতাসে ছুটে আছে সমুদ্রের জল। বাতাসে লোনা সুনীল রক্তের গন্ধ। বাতাস আমাকে যে সম্পর্ক দিয়েছিল, সেখানে হিন্দু হোটেলের নয়, প্রকৃতির মতোই অনিশ্চিত বাটামাছ ছিল। মানুষের তৈরি ঘাট যেমন বৃষ্টির জলে তৈরি পুকুরে ডুবে যায়। প্রথমে জলে ডোবে। পরে মাটিতে। মাটির অংশ হয়ে যায় ইটগুলো। প্রাকৃতিক হয়ে থাকে। বাসনমাজার দাগ তখনও বুকে নিয়ে। কেউ আর কখনও তাতে আলতাপরা নীলিমা ঘসবে না।

“দাদা আমি ডিম খেতে চেয়েছিলাম। ডিম যেমন আমাকে খেয়েছে। দাদা... আমিও ১টা ডিম খেতে চাই।”

“পয়সা নেই।”

‘মিথ্যে কথা!”

“ডিম কেনার পয়সা নেই, এটা মিথ্যে কথা নয়।”

“কেন? ছোটবোনকে ১টা ডিম খাওয়াতে তোমার চামড়ায় বাঁধে?”

“আমি পয়সার ডিম খাওয়াই না।”

“তবে। খাওয়াও।”

“খাওয়াচ্ছি তোকে। যে বোন ডিম খায়, তার নাম আমি দিলাম সায়রাবানু।” 

“ঈশ!”

“১টা নরম আর গরম গোল পিচ্ছিল সাদা। সেই সাদা পৃথিবীর অন্য কোনো সাদার সঙ্গে মেলে না। নখ বসালে নখের ময়লায় সাদা বেরিয়ে যায়। ভেঙে বেরোনো সেই সাদার মধ্যে আছে ১ আশ্চর্য রং। তাকে ফোটালে চোখের জলের মতো শক্ত হয়। ভাজলে হাসির মতো ছড়িয়ে যায়। পোচ করলে ব্যথার মতো জমে থাকে। তার রং, আহা তার রং রে বোন!!!!! তাকে ঈর্ষা করেই ইরানে গোলাপের চাষ হয়। মনে আছে, বাবরশাহ একদিন ভারতে এসেছিল? ওই রংকে লোকে ভুল করে কুসুম বলে। বোঁটা নেই কিন্তু। কোনোরকম বোঁটা নেই কোথাও। দুধের সঙ্গে ডিমকে যেন ঘুলিয়ে ফেলিস না।”

“ইল্লুস! দাদা...”

“তুই। তোর মুক্তোর মতো দাঁত বসালি সেই সাদায়।”

“ইল্লুস!!!!”

“এখন। তোর দাঁতের ফাঁকে সেই আশ্চর্য নোংরা লেগে গেছে, যাকে লোকে ভুল করে ডিম্বকণা বলে। এখন তোর। গলা ভর্তি নরম। গলা ভর্তি গরম। তুই একটু আস্তে ঢোঁক গিলবি। একটু... আস্তে...”

‘ইইইইইইইল্লুস!!!!!!!!”

“লে। খা।”

১টা জানালা আমাদের বাড়ির দেওয়ালে ক্ষতচিহ্ন হয়ে আছে। আমাদের প্লাস্টারহীন নতুন ইটের দেওয়াল। পাৎলা স্বচ্ছ কাচের জানালা। জানালা অবিশ্যি কাচের হয় না। শার্সিগুলো কাচের। লোহার কর্কশ ফ্রেম। এলোমেলো সবুজ রং করা। ওই সবুজ রং যেন ১টা সবুজ লতার অনুপস্থিতি ধরে রেখেছে যাতে গোলাপি ফুল হয়। সে নেই-লতার সুবাদেই ১টা ফ্যাকাসে টব যেন নেই-টব হয়ে আছে। ওই জানালাটার জন্য আমাদের বাড়িটাকে বাঙালি বাড়ি মনে হয় না। মনে হয় ইরানের কোনো পয়সাওলা লোকের বাড়ি, বা ইতালির কোনো গরীব পরিবারের। দেশছাড়া স্বভাবের এই বাড়িটা আমাদের চরিত্রও বদলে দিয়েছে। সারাদিনের মধ্যে কোনো কোনো অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে ১-১টা কবিতা লাফিয়ে ওঠে। জীবনের চামড়ায় কিছুটা অংশ খসে যায়। ক্ষত তৈরি হয়। র। পুঁজরক্তসমেত। তাকে চিহ্নায়িত করার প্রক্রিয়াটা শুরু করতে হয়। মাত্রা ঠিক করতে হয়- ৩, ৬, ১২, ৩০, ২০০, ১০০০, বা ১০০০০। কেউ কেউ তাকে দৃশ্য বলে। যেন বর্ণনা করেই খালাস। কেউ কেউ তাকে অন্তরে নিয়ে যায়। দেখার অন্তরে নিয়ে যায়। অপটিকাল সংবেদনের বাইরে। কিংবা, রেটিনার অনেক বেশি গভীরে। সেখানে একটা কাচের জানালা আর অভিজ্ঞতা থাকে না। কারণ যে জানালা দৃশ্য দেখার জন্য, সেই জানালা স্বয়ং ১ দৃশ্য। যে দেওয়ালে সে আটক আছে, সেটা নতুন ইটের।

“তুমি হাওয়ার মধ্যে গিয়ে ওই অচেনা লোকটাকে নিজের নাম বললে কেন?”

“দ্যাখো, আমি কাকে নিজের নাম বলব সেটা আমার ব্যাপার। তুমি নাক গলিও না।”

“বাইরে গেলে ওড়না সামলাও। ঠিক করে কথা বলো। আজ দিনটা খুব পরিষ্কার। স্পষ্ট রোদ উঠেছে। আজ তোমার কাউকে নিজের নাম বলা ঠিক নয়। অচেনা কাউকে।”

“চেনা লোককে বললে দোষ নেই তো? তোমাকে বলি?”

শাদা রৌদ্রের মধ্যে খুব হাওয়া দিচ্ছিল। বাইরে গাছপালাগুলো ওলটপালট হচ্ছিল। ইটের দেওয়ালে বাতাসের ধাক্কা টের পাওয়া যাচ্ছিল। সোঁ সোঁ শব্দের মধ্যে কিছু ১টা পড়ে গেল। সম্ভবত কোনো ঘরে ১টা দুধের গেলাস। শব্দটা ধাতব নয়।।

যে ক্যামেরায় পায়ের ছাপ গভীর হয়ে পড়ে, তার নামও তো দূরবীণ। খড়হাঁসে ছেয়ে থাকা ১টা জলাভূমির পাশে অমলকান্তি ১টা চা দোকান খুঁজে পেয়েছে। বৃদ্ধ দোকানি। একদা তিনি বাজি কারখানার মালিক ছিলেন। সরকার শব্দদূষণ বন্ধ করে দিল। সেই কাজ ছেড়ে তিনি ভাতের হোটেল খুললেন। চলছিল মন্দ নয়। ২টো হাঁটু হঠাৎ একদিন জবাব দিয়ে দিল। তখন ছোট্ট চা দোকানটা খুললেন। পাশেই গড়ে উঠছিল বিরাট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। মোরাম রাস্তা বানানো হয়েছিল। লোকজনের যাতায়াত বেড়েছিল জলাভূমিটিতে। সময় কাটানোর পাশাপাশি রোজগার মন্ধ হচ্ছিল না। অমলকান্তি প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে রোজ চা খেত। গরম চা। অগণিত বালিহাঁসের হইচইয়ের মধ্যে। দিনের সবচেয়ে নরম রোদের মধ্যে। সেই রোদের ছবি তোলা যায় না। সেই রোদের ছবি নামানোও যায় না। 

“বাজি বানানো, আর চা বানানোর মধ্যে তফাৎ কী?”

“বয়সের তফাৎ স্যার। হাঁটুর তফাৎ।”

“বুঝলাম না।”

“আমিও কি ছাই বুঝি নাকি! আপনার প্রশ্নটা শুনেই উত্তরটা মুখে এল। হয়ত কিছুই তফাৎ নেই। সেটা মন দিয়ে করতাম, এটাও করছি। সেটায় চাপ বেশি ছিল। ল্যাঠা বেশি। পুলিশ-টুলিশের ঝামেলা ছিল। এখন বেশ নিরিবিলি আছি।”

“তখন মানুষের কানের জন্য মাল বানাতেন, এখন জিভের জন্য।”

“শুধু কান কেন? আলোর বাজিও বানাতাম স্যার। তুবড়ি। রংমশাল। হাউই। চরকি। সেসব মাল তো চোখের জন্য। আর, জিভের সোয়াদের জন্য কেউ চা খায় নাকি? মানুষ তো চা খায় মন দিয়ে।”

“কীরকম?”

“এই যে আপনি সকালে হাঁটতে বেরোন, সেই হাঁটা, আর মানুষের অফিস-আদালত-ইস্টিশন-বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা তো ১ নয় স্যার! অথচ আপনি কিছু কম জোরে হাঁটেন না। এই তো, কেমন ঘেমে গেছেন। চা খেচ্ছেন। রেস্ট নিচ্ছেন। শখের হাঁটার পরেও রেস্ট নিতে হয় স্যার।”

“তা হয়।”

“হাতে ক্যামেরা নিয়ে বেরোন। অথচ আজও হাঁসগুলোর দিকে ক্যামেরা তাক করতে দেখলাম না।”

“দেখলে আমার সেই ছবি তোলার ছবি নিজের মনে তুলে নিতে, নাকি নামিয়ে রাখতে?”

“অনেক দূরের কথা বলছেন। ঠিকঠাক ঠাহর হয় না। আমি বরং চা-টা নামাই।”

গরম গেলাসটা হাতে আসার আগে অমলকান্তি লম্বা লম্বা হোগলায় ছেয়ে থাকা, কচুরিপানায় ঢেকে থাকা জলাভূমিটা দেখছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হয়ে যাওয়ার পরে এমন আর থাকবে না। চিরে রাস্তা বেরোবে। সব খড়হাঁস এলাকাছাড়া হবে। পালিয়ে বাঁচবে। এই চা-দোকানটা কি টিকবে? কলেজের নির্মাণ শেষ হয়ে এসেছে। এই কলেজ তৈরি হতে থাকার সুবাদে দোকানটা হয়েছে। কলেজে আসার রাস্তা এরপর মোরাম থেকে পিচঢালাই হয়ে তাকে মুছে দেবে। আজ থেকে ১ বছর পরেই হয়ত এখানে আর সকালে বেড়াতে আসতে ভালো লাগবে না। 

কষ্ট হবে অমলকান্তির। ১টাও খড়হাঁসের ছবি তো সে তোলেনি।।

কথা বলার মেশিনটা আজ ছবি তোলার যন্ত্র হয়ে গেছে। ঘোড়াকে দলাইমলাই করতে করতেই কেউ একলাফে পিঠে চড়ে বসল, আর জকি হয়ে গেল। আস্তাবলের ইঁদুরগুলো সংসারে এসে ঢুকছে। ইঁদুরকে বিষ দিলে যে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়, এই ধারণাও আজ অনেক দূরের হয়ে গেছে। ইঁদুরের যে ক্ষুদ্র জীবন, তার যে শস্য আহরণ, সে যে চুরি নয়, সে যে তার অধিকার, এই বিশ্বাস আমরা কবে হারিয়ে ফেললাম? বরং বিড়াল পোষা ভালো। ইঁদুর আর বিড়াল দুজনেই আশ্রয় পাক। দুধ। আর ধান। নিজেরাই তাদের অধিকারের সীমা বুঝে নিক গৃহের সীমানার মধ্যে। কালো দেওয়াল জুড়ে নিরপরাধ শাদা রৌদ্রের আলপনা আঁকা হোক। যদি রক্তের ছিটেফোঁটাও পড়ে, সে যেন বিষের স্পর্শ থেকে মুক্ত থাকে। প্রয়োজনীয় হিংসায় মালিন্য থাকে না। শুধু, জাল ফেলে মাছ ধরতে নেই। পাপ। এটুকুই। ‘মাছ’ আর ‘জাল’ এই দুটো শব্দ যদি কাছাকাছি আসে, মাঝখানে ‘ক্ষুধা’ নয়, ‘বিলাস’ এসে বসে। ‘শ্রম’ নয়, ‘সুবিধা’ এসে বসে। সুবিধা আর প্রগতিকে এই বাংলায় আজ আর আলাদা করা যাচ্ছে না। কিংবদন্তিগুলো নেই হয়ে বেঁচে থাকছে। সব মূর্তির মাথায় আজ মানুষ আর মানুষীর গু লেগে আছে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন