জীবন সত্যের দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তির খোঁজে একদল মার্কিনি শহরবাসী সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে যতোদূর পারা যায় তাকিয়ে ছিলেন রবার্ট ফ্রস্টের 'নাইদার আউট ফার নর ইন ডিপ' কবিতায়। একজন শহরবাসী যে সার্বিক সীমাবদ্ধতায় জন্ম নেয় এবং যে জটিল লোগোসেন্ট্রিক নাগরিকতায় বড়ো হয়, সেটা কোনোভাবেই হয়তো অতিক্রম করা যায় না যতোই সে নিঃসর্গ প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করুক না কেন। আমিও শহরবাসী, আমার চারপাশে ভণ্ডামিপূর্ণ আদর্শের ছড়াছড়ি এবং ভণ্ডামিপূর্ণ গণতন্ত্রের পথ ধরেই চলেছে ধর্ষণ খুন একেবারে রাজধানী কলকাতায়, সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি বলে যাকে দাবি করা হয়। অসহনীয় এই অবস্থা থেকে ধর্মের ধ্বজা মুক্তি দিতে পারে না পৃথিবীর কোথাও, দেয়নি আজও। বরং অসাধু ধর্মওয়ালাদের ধারাবাহিক চিৎকার শহর-গ্রামকে দূষিত করে যাচ্ছে আর সর্বনাশা সাম্প্রদায়িক রগড়ারগড়িতে ভরিয়ে তুলছে পৃথিবী। আমরা মুক্তির খোঁজে যাই নির্জনতায়, নদীর অপার আকর্ষণে, সমুদ্রের অগাধে, পর্বতের ব্যাপ্তিতে। অথচ শহরে ফেরার বাধ্যতা মানসিক সিরিনিটি ধ্বংস করে দেয়। মুক্তি আসে না জীবদ্দশায়। আবারও চলে যাই সমুদ্রের ইটার্নিটির কাছে, পাহাড়ের স্বর্গীতায় গিয়ে বসি দু'ঘন্টা। মুক্তির বোধ নিয়ে চলা জীবনই বাঁচিয়ে রাখে আমাদের। শহরের গভীরতম অসুখের জটিলতায় মুক্তিবোধ মানুষকে এনে দাঁড় করায় অপরিমেয় শক্তি ভান্ডারের সম্মুখে। তথাপি রবার্ট ফ্রস্ট লিখলেন দার্শনিক সত্য--- 'They cannot look out far./They cannot look in deep./But when was that ever a bar/To any watch they keep?'
#
হয়তো অনেকেরই মনে আছে শ্রুতি আন্দোলনের অন্যতম কবি পরেশ মণ্ডলের এক পংক্তির বিখ্যাত হয়ে যাওয়া কবিতাটা, যার নাম 'মুক্তি'। লিখেছিলেন--- 'সমস্ত জীবন ধরে মৃত্যুদণ্ড প্রার্থনা আমার'। এই প্রার্থনা কেন কবির ? তিনি কি কোনো পাপ করেছিলেন, যে পাপবোধ থেকে এই উচ্চারণ? সাধারণ কোনো পাপী কি এভাবে মুক্তি চায়? যদি তাই হয়, এ কোন মুক্তির প্রত্যাশা, এই পদ্ধতিতে? আর সমস্ত জীবন ধরে নিজেরই মৃত্যুদণ্ডের জন্য প্রার্থনা? কবিতাটার নাম 'মুক্তি'। মুক্তি চেতনার অনন্য রূপের কাছেই পৌঁছনোর আকাঙ্ক্ষা সকল কবির। যে-কোনো কবির প্রতিদিনকার সাধিত কর্ম অসমাপ্ত থেকে যায় রোজ। পূর্ণ মেজাজে লেখা কবিতাটি মনে হয় অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। মনে হয় প্রিয় নারীকে যেভাবে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম, সেভাবে ভালোবাসা গেল না। নির্মল আকাশের দিকে সিগারেটের ধোঁয়ার কুন্ডলী ছেড়ে মনে হয়, সৌরনীলের শরীরে কালো ক্ষত বৃদ্ধি করলাম। থালায় মাছ-মাংস খেতে খেতে মনে হয়, আমিও একজন হত্যাকারী। হয়তো, আমি আকাশের দিকে যে ইটটা ছুঁড়েছি, সেটা কোনো পক্ষীশাবকের মাথায় গিয়ে পড়েছে। এভাবে অতি সংবেদনশীল মানুষের পদে-পদে পাপবোধ তৈরি হতে দেখি আমরা। কিন্তু, কার কাছে কবির মৃত্যুদণ্ড প্রার্থনা? প্রাকৃত কোনো শক্তির কাছে তো মৃত্যুদণ্ডের জন্য ব্যক্তি নিজে আবেদন করে না, কারণ প্রাকৃত শক্তি তো বসেই আছে মৃত্যুদণ্ড দেবার জন্য! তাহলে কি অতিপ্রাকৃত শক্তির কাছে পৌঁছনোর প্রয়াসে এই উচ্চারণ? অতিপ্রাকৃতের সাহচর্যই হয়তো দিতে পারে মুক্তির পরমতা।
#
প্রয়াণের মধ্যে দিয়ে যে মুক্তি আসে, তা ব্যক্তির কাছে দুর্জ্ঞেয়, অন-অনুভূত, অজ্ঞাত, বোধের অতীত— কল্পিত সেই মুক্তির কোনো তাৎপর্য আছে বলে মনে করি না। জীবনের অতীত কোনো স্বর্গীয় সুন্দরে ব্যক্তি পৌঁছবেন, এটা যদি তাঁর অজ্ঞাতই থেকে যায়, অন-অনুভূত থেকে যায়, তাহলে সেই মুক্তি অর্থহীন। কিন্তু, এটাই আবার অর্থবহ রূপ পায় জীবিতদের কাছে। বেঁচে থাকাকালীন জীবনাতীত চির শান্তিকেই উপলব্ধি করতে চেয়ে মৃত্যু বিষয়ক যা কিছু কবিতা। হয়তো জীবদ্দশায় সেই কারণে বিভিন্ন অবলম্বন খুঁজে বেড়ান কবি। অন্য কোনো অবস্থার মধ্যে নিজেকে বিলীন করার বোধ, বিশেষ করে প্রাকৃতিক ও দৈব অর্গ্যাজমের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে যে অপার আনন্দানুভূতি, সেটাই হিউম্যান লিমিটেশনস থেকে এক উইথড্রয়াল। পাঁচ দশকের কবি সুধেন্দু মল্লিক লিখলেন 'সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ' কবিতাটি। কৃষ্ণকে অবলম্বন মুক্তির খোঁজের উদ্দেশ্যেই। তিনি লিখছেন— 'ঘুরছি আমি তোমার জন্যে সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ।/থামছি আমি তোমার জন্যে সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ।/তোমার জন্যে হাত করি জোড়/ভালোবাসার বকুল প্রহর/তোমার নামে ভাসাই জলে সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ।' অধ্যাত্মবোধ হতেই পারে জটিল অবস্থা থেকে উইথড্রয়ালের পথ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, দেবালয়ের চার দেওয়ালের ভেতরে মুক্তি নেই। মুক্তি আছে মাঠে ঘাটে কর্মময় জীবনের পটভূমিতে। একসময় ভাবা হয়েছিল প্রায় গোটা দুনিয়ায়, মার্ক্সবাদই মুক্তির পথ। রামকৃষ্ণ বললেন, মাটিই টাকা। যতো মত ততো পথ, এই কথায় হয়তো অমোঘ সত্য আছে। আমারও তাই মনে হয়। 'আমার হাতের রেখায় মঙ্গল, বৃহস্পতি কিম্বা শনি বলে কিছু লেখা নেই, আঁকা আছে দোঁয়াশ মাটি— লিখেছিলাম আমার প্রথম বইয়ের একটি কবিতায়। নিজেকে বারবার মুক্ত করার প্রয়াসেই লেখা হয়েছে পৃথিবীর সমস্ত কবিতা। রূপান্তরে মুক্তি রয়েছে কবিতার মূলে। কেন কথাকারেরা জাদু বাস্তবতাকে ব্যবহার করতে চাইলেন? কেন শুরু হলো হাংরি ও শ্রুতি আন্দোলন? কেন ছাঁচ ভেঙে ফেলার প্রসঙ্গ উঠলো? কেন দুর্গাপুরে কয়েকজন গল্পকার মেতে উঠলেন নিম সাহিত্য আন্দোলনে? কেন বাংলা গল্পে শাস্ত্রবিরোধিতার পরিসর তৈরি হলো? প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুক্তির প্রসঙ্গে এসেছিল অপরত্বের চেতনা। ব্রিটিশ রোমান্টিক কবিদের সম্পর্কে অভিযোগ উঠেছিল যে তাঁরা 'এসকেপিস্ট'। অনতিবিলম্বে দেখা গেল রোমানটিসিস্টরা অভূতপূর্ব মুক্ত কবিতা দিয়ে চলেছেন বিশ্বকে বিস্মিত করে। এবং বারবার আমাদের শ্রুতিতে ধ্বনিত হয় রবীন্দ্রনাথের এই গান, মুক্তির বাগেশ্বরী--- 'গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ/আমার মন ভুলায় রে !... ও সে--- কোন্ বাঁকে কি ধন দেখাবে,/কোন্ খানে কি দায় ঠেকাবে/কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে/ভেবেই না কুলায় রে।।'
কবিতার laws and cause ছাড়িয়ে যে কবি মুক্তি দিয়েছে কবিতাকে আবহমানতা থেকে তাঁর কলমে কবিতার মাধ্যমে মুক্তির সন্ধান চোখে পড়ল।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন