মুক্তি কোথায় আছে ।
আপনি প্রভু সৃষ্টি বাঁধন পরে
বাঁধা সবার কাছে" —( রবীন্দ্রনাথ )
সত্যিই কি মুক্তি বলে কিছু আছে? নাকি বন্ধনই মুক্তির আরেক রূপ। আসলে মুক্তি শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আবেগ যাকে জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। জীবন এক বহতা নদীর মতো এঁকেবেঁকে চলে। মুক্তি মানে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ফেরা। একটা মুক্ত আকাশ যেখানে প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। অনেকের কাছে মুক্তি মানে সমস্ত বন্ধন থেকে নিজেকে বিছিন্ন করে নেওয়া। আবার কারো কাছে এ-পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেওয়া। আসলে মুক্তি শব্দটি ভীষণ শক্তিশালী। এর আক্ষরিক অর্থ স্বাধীনতা হলেও তা কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা নয়। এর মানে হল স্বাধীনভাবে মনের ভাব যা মানব জীবনের উত্তরণ ঘটায়। মুক্ত ও উদার মন নিয়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচা যায়। মাথার উপর খোলা আকাশ থাকবে ঠিক কিন্তু পা থাকবে মাটিতে । সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে সবাই একসঙ্গে আনন্দে বাঁচা। আগে জীবনকে ভালোবাসতে হবে তা না-হলে মুক্তির আনন্দ উপলব্ধি করা যাবে না । রবিঠাকুরের কথায়: আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে/আমার মুক্তি ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে ...
মুক্তি শব্দের অর্থ ব্যাপক। এটা হতে পারে জীবন মুক্তি, আধ্যাত্মিক মুক্তি অর্থাৎ মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ, রোগমুক্তি, সামাজিক মুক্তি, বন্দীদশা থেকে মুক্তি অর্থাৎ স্বাধীনতা। যেমন বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বিপ্লব এবং সশস্ত্র সংগ্রাম যা পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান। এখানে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৬ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম প্রধান জাতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতিলাভ। ভারতবর্ষের ১৯৪৭ সালের ইংরেজদের অত্যাচার এবং দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার কথাও বলতে হবে। এছাড়া রয়েছে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেখানে সকল নাগরিকের চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। এটি একটি মৌলিক অধিকার। এই অধিকার প্রিন্ট মিডিয়া, ইন্টারনেট দুনিয়া, সোশ্যাল প্লাটফর্ম এবং জনসমাবেশ সহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রসারিত। অবশ্য এটা ভারতের সংবিধানের ১৯(২) অনুচ্ছেদের অধীনে আরোপিত কিছু বিধিনিষেধ সাপেক্ষ। বিভিন্ন দেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিপ্লব বললেই যে নামটি মনে আসে তা হল কিউবার বিপ্লবী চে গেভারা। তার মতে বিপ্লবী হতে চাওয়ার প্রথম শর্ত শিক্ষা। শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব। এ-বিষয়ে কবি মোহিনী চৌধুরীর একটা গান আছে --
মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হল বলিদান
লেখাআছে অশ্রুজলে
এখানে মুক্তিকে মন্দির বলা হয়েছে। তাই মুক্তি একটি মহতী প্রচেষ্টা।
আবার জীবনমুক্তি কথার বৃহৎ অর্থ মোক্ষলাভ অর্থাৎ আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধি। তাকে ব্রহ্মজ্ঞানী বলা হয়। যেমন গৌতম বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব প্রমুখ। এঁরা আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে ঈশ্বরকে তাদের জীবদ্দশায় উপলব্ধি করেন। জীবন্মুক্তি হল অসীম জ্ঞান, অসীম শক্তি এবং অসীম আনন্দের অভিজ্ঞতা লাভ জীবিত অবস্থায় এবং মৃত্যুর পরেও।
প্রথম কথায় ফিরে আসি, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে মুক্তি মানেই বিছিন্ন হওয়া নয়। বন্ধনের মধ্যেই মুক্তির আস্বাদ নেওয়া। তাই তো কবিগুরু বলেছেন ---
তৃপ্তি আমার অতৃপ্তি মোর, মুক্তি আমার বন্ধন ডোর....
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন