‘মুক্তি’ শব্দটি শুনলেই কৈশোরের এক কবিতা পাঠের (বা আবৃত্তির) একটা অংশ বয়স নিরপেক্ষে মনে পড়ে যায় এই প্রৌঢ়বেলাতেও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ধূলামন্দির’ কবিতার— ‘মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি,/ মুক্তি কোথায় আছে।/ আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন ‘পরে/ বাঁধা সবার কাছে’ (গীতাঞ্জলী/ ২৭ আষাঢ়/ ১৩১৭)। পরে ধীরে-ধীরে মনে আসে— ‘বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়/ অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময়/ লভিব মুক্তির স্বাদ’। (‘মুক্তি’/ নৈবেদ্য/প্রকাশ-১৯০১)। দু-ক্ষেত্রেই কেমন একটা নৈকট্য বোধ করি। ‘মুক্তি’ শব্দটি মননে আলোড়িত হতে থাকে সমানে। কোথায় আছে জানি না, তবু চাই। কীভাবে তার স্বাদ আস্বাদন করতে হয়, জানি না, তবু চাই। চাই তো বটে, কেমন ধরনের মুক্তি চাই, তাই কি জানি ছাই! হয়তো জানি, কখন ভেতরে-ভেতরে তৈরি হয়ে আছে, আগে জানতেই পারিনি, এই ‘মুক্তি’ নিয়ে লেখার আগে। 
একটা গান আরও আলোড়ন সৃষ্টি করে মনের মধ্যে। ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে/ কত প্রাণ হলো বলিদান/ লেখা রবে অশ্রুজলে’। (রচয়িতা- মোহিনী চৌধুরী; সুরকার- কৃষ্ণচন্দ্র দে) প্রাগুক্ত দুই ‘মুক্তি’-র সঙ্গে এই মুক্তির ভিন্নতা আছে। তবু চাই। কারণ, জন্মভূমির ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়?’ (রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়)। সুতরাং এই স্বাধীনতাও বস্তুত মুক্তি। পরাধীনতা থেকে দেশমাতৃকার স্বাধীনতায় উত্তরণ বা মুক্তি। সে-ও চাই। প্রত্যেকটি দেশের জন্য চাই। 
আবার ফিরি রবীন্দ্রনাথে। একটা গানের মাঝে লিখছেন— ‘তৃপ্তি আমার অতৃপ্তি মোর, মুক্তি আমার বন্ধনডোর’ (গানটির প্রথম পঙক্তি ‘প্রভু আমার, প্রিয় আমার পরম ধন হে।/ রচনাকালঃ ৫ আশ্বিন, ১৩১৭)। বন্ধনেই মুক্তি। ভাবা যায়! এখানেও কি নৈকট্য বোধ করি? করি তো। মুক্তি বলে তো কিছু হয় না। গাঢ়ভাবে জীবনে জড়িয়ে যাওয়াই মুক্তি। যা শুধু চাওয়া যায়, পাওয়া যায় কিনা আজও তো হৃদয়ঙ্গম হলো না। চাই, মুক্তি চাই, এই পর্যন্তই। আবার ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থে ‘মুক্তি’ নামে রবি ঠাকুরের একটি কবিতা আছে, যার প্রথম কয়েকটি পঙক্তি “চক্ষু কর্ণ বুদ্ধি মন সব রুদ্ধ করি,/ বিমুখ হইয়া সর্ব্ব জগতের পানে,/ শুদ্ধ আপনার ক্ষুদ্র আত্মাটিরে ধরি/ মুক্তি আশে সন্তরিব কোথায় কে জানে!” (রচনাকাল- ১৮৯৩)। এখানে ব্যক্তিমুক্তির কথা বলা হচ্ছে। আত্মার মুক্তি। জানি না, তা কী, তবু চাই। কেন চাই, না-জেনেই। মুক্তি, মোক্ষ, নির্বাণ। ফলে বলা যায় আপোষে ‘মুক্তি’ শব্দটির গায়ে লেগে আছে, চাওয়ার ব্যাপারটি। দেশ বা দশের মুক্তি চাই, নিরীহ জেলবন্দীদের মুক্তি চাই, স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি চাই, বৈদেশিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি চাই। শোষণ থেকে মুক্তি চাই। বৈষম্য থেকে মুক্তি চাই। নারীর ওপর অন্যায়-অত্যাচার-ধর্ষণ, নারীমুক্তি চাই। যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি চাই। অবদমন থেকে মুক্তি চাই। অপসংস্কৃতি থেকে মুক্তি চাই। আরও কত কী!
এতসব অবস্থান থেকে দুটি বিষয় আশা করি সবার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। এক) সমষ্টির মুক্তি, দুই) ব্যক্তির মুক্তি। দুইয়ের বিরোধ নেই ঠিকই কিন্তু রকমের ফারাক আকাশ-পাতাল।  
মানুষ যেদিন থেকে সমাজব্যবস্থার অনুশীলন শুরু করে, সেদিন থেকে একদিকে সাম্যবাদী সমাজ সৃষ্টি করার চেষ্টা করলেও অন্যদিকে সেখানে কিছু দুর্বলতার সুযোগে শুরু হয় দুর্বল ও সবলের অবস্থান। কালে-কালে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার অপমৃত্যু ঘটে আর বৈষম্য সৃষ্টিকারী এক সমাজব্যবস্থার দিকে তা ক্রমে স্থিত হয়। গোষ্ঠী, জাতিসত্তা ইত্যাদির প্রভাবে গড়ে ওঠে দেশ-রাষ্ট্র ইত্যাদি ব্যবস্থা। শুরু হয় দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, জবরদখল, উপনিবেশবাদ। শুরু হয় স্বাধীনতার আন্দোলন। আবার দেশে দেশে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে শুরু হয় মুক্তি আন্দোলন। মানুষ পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা বা মুক্তি চায়। মানুষ বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনের তাগিদে মুক্তি আন্দোলনে জড়ায় বা মুক্তি চায়। এই মুক্তি চাওয়া সমষ্টির মুক্তি। দেশে-দেশে মানুষ সমষ্টিগতভাবে মুক্তি চায় নানা কারণে। প্রকৃত স্বাধীনতা, উন্নততর জীবনব্যবস্থা, মাতৃভাষার মান্যতা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ইত্যাদির জন্য এবং বিরুদ্ধে মুক্তি চায়। লড়াই চলে। যাকে বলা যায় মুক্তির লড়াই। জয় হয়, পর্যুদস্তও হয় সমষ্টি। কিন্তু আগ্রহটা থাকেই। সমষ্টির মুক্তি মূলত বাহ্যিক নানাদিকের। উদাহরণ দিয়ে এই সমষ্টির মুক্তির বিষয়টি শেষ করা যাবে না। 
আর এক মুক্তি-প্রয়াস কমবেশি সচেতনে অচেতনে মানুষের মধ্যে থাকেই। সে হচ্ছে ব্যক্তিমুক্তি বা স্ব-মুক্তি। এই মুক্তির বাহ্যিক কোনো শোভা নেই, রূপ নেই, বহিঃপ্রকাশ নেই। সবটাই অভ্যন্তরীন। সেও ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন-ভিন্ন প্রণোদনায় বিশেষ পরিসরে মুক্তি চায়। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই সজ্ঞানে আত্মার মুক্তি চায়। অর্থাৎ আধ্যাত্মিক মুক্তি। যেন, এই ক্ষুদ্র আত্মা পরমাত্মা্র সঙ্গে মিলিত হতে পারে, জীবিত অবস্থায় সেই মহানন্দ লাভ হলে তো কথাই নেই, অন্ততঃ তা যেন জীবাত্মার মরণে সম্পন্ন হয়ই। অর্থাৎ মুক্তি হচ্ছে স্ব-আত্মার পরত্মাতার সঙ্গে মহামিলন। আবার ব্যক্তিমুক্তির অনুসন্ধান করেন কিছু মানুষ, তাঁর স্বক্ষেত্রে, যথা শিল্প-সাহিত্যে, আর্ট-পেইনটিংসে, বা যে কর্মটি তিনি করেন তার উৎকর্ষতায়, চরমাবস্থানে।  
অনেকানেক ‘মুক্তি’-র মধ্যে আমরা দু-রকমের মুক্তির কথা তুলে আনলাম, এক, সমষ্টির মুক্তি, দুই, ব্যক্তিমুক্তি, যে-দুটির মধ্যে আবার অনেক ধরনের মুক্তি প্রসঙ্গ উঠে আসতে পারে। মুক্তি এবং নিজেকে নিয়ে কথা বলতে গেলে দুটির কথাই আসবে। হয়তো তার প্রকৃতি হবে ভিন্ন ধরনের, কেননা প্রায়োরিটি বেসিস মুক্তির আকাঙ্খা সবার এক নাও হতে পারে। যেমন, আমার ওপর স্বল্পবয়স থেকেই এক ধরনের ভয়ের প্রভাব কাজ করে। এর কারণ নিজেও ঠিক জানি না। কিন্তু ভয়। সুখে-দুঃখে-আনন্দে-বিষাদে-স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক-সফলতা-ব্যর্থতা-নিজের জন্য-সম্পর্কিতদের জন্য ভয়, যা ক্রমে বাড়তে-বাড়তে আজকে এক অবধারিত ও ভারবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয় থেকে মুক্তি চেয়ে এসেছি, সেই প্রথম থেকে। আজও চেয়ে চলেছি। চাইলেই সবসময় পাওয়া যায় না। এবং বলতে দ্বিধা নেই ভয় থেকে মুক্তি আমি পাইনি আজও, অজস্রবার নানাভাবে চাওয়া স্তত্বেও; আজও আমার ভয় মুক্তিপ্রয়াসী ও তিয়াসী। আর এক সংশয় আমার সঙ্গী। সেই কবে থেকে যে সে আমার ওপর সওয়ারি, তা আজ আর মনে করতে পারি না। কিন্তু বয়ে চলেছি তার ভার আর ধার। সংশয় থেকে মুক্তি চাই আমি, কিন্তু পাই কোথায়? পাই না যে। তখন তো মনে হয়ই, ‘মুক্তি কোথায় আছে?’। এ-দুটিকে আমার ব্যক্তিমুক্তির আকাঙ্খা হিসেবেই চিহ্নিত করি।
সমষ্টির মুক্তির জন্য আমার হৃদয় সদাই চঞ্চল। আমি নিজের দেশের স্বাধীনতার আগে জন্মাইনি, তা নিয়ে স্বাভাবিক কিছু বলার থাকে না। যদিও স্বাধীনতা পাওয়ার পর দেশবাসির অধিকাংশই নানাদিক থেকে মুক্তি পায়নি। গরিবি তথা প্রাথমিক চাহিদা (বাঁচার জন্য)থেকে বঞ্চিত বহু মানুষ, সামাজিক দিক থেকে সম্প্রদায়-জাত-পাত ইত্যাদিতে বৈষম্যের শিকার বহু মানুষ, লিঙ্গভেদে আজও নানা বৈষম্য এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, নারীদের প্রকৃত মুক্তি চাই। সমষ্টির ক্ষেত্রে এই মুক্তি চাওয়াগুলি আমার ব্যক্তিচাওয়ার সঙ্গে মিশে আছে, একে আলাদা করা যায় না। আমার মনেপ্রাণে চাওয়া ও না-পাওয়া নিয়েই এই জীবনের এতটা পথ চলা, এবং ক্রমে এতে অভ্যস্ত হয়ে এক ধরনের কষ্ট বয়ে যাওয়া। 
আর ব্যক্তিমুক্তির ক্ষেত্রে প্রধান দুটো জিনিস কাজ করে। আত্মা পরমাত্মার ওপর তেমন বিশ্বাস নেই বলে, পরকাল বলে কিছু আছে তার কোনো ধারণা না-থাকায় মুক্তির যে চাহিদা তা এ জনমেই। ভয় ও সংশয়ের কথা আগেই বলেছি। আরও দুটি বিষয়ের জন্য মুক্তি চাই; বস্তুত এই মুক্তি একটা বোধের স্ফুরণ, একটা অনুভবে জারিত হয়ে যাওয়া, একটা অতীন্দ্রিয় পরিসরে মৌহূর্তিক অভিজ্ঞান। আগের ক্ষেত্রে, দুটো ‘থেকে মুক্তি’ আর এই ক্ষেত্রে দুটো-র ‘জন্য মুক্তি’। বিষয় দুটি, ন্যায্যতই আমার মধ্যে কাজ করে। এক, যেহেতু আমি মানুষ, তাই আমি মনে করি, আমার মুক্তি মনুষ্যত্বের চরম বিকাশে। যেন তা জীবনের নানা ক্ষেত্রে ঘটে, এবং এমন চরম অবস্থানে যেন মুক্তি আমাকে ছুঁয়ে থাকে। এ-ও চাওয়া, মুক্তি চাওয়া, একদম ব্যক্তি পর্যায়ে। দুই, আমি কলমকারী, বিশেষত কবিতাকারী, আমি যেন এই ক্ষেত্রেও মুক্তি লাভ করতে পারি পাঁচটা পঙ্‌ক্তি লিখে। কবিতা আমার মুক্তি, কবিতাই আমার বন্ধন। এখানে বন্ধন আর মুক্তি জড়াজড়ি করে থাকে, খুব কম মুহূর্তে হলেও কখনো-কখনো তা অনুভবে আসে। তখন তো মনে হয়ই— ‘মুক্তি আমার বন্ধনডোর’।    



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন