আমাদের বারান্দার পেছনে ছোট্ট সংসার তাদের লতানো পাতানো উল্লাস আমি কফি ঢালি। ঢালার নিভৃত বেদনা। আমার আঙুলের ফিলামেন্টগুলো জ্বলতে থাকে। আর ওই সামান্য আলো টুকু। এই ঘনঘোর দিনে জানলার সার্সি পেরিয়ে যে তরল অন্ধকার বাথরুমের দিকে ছুটে যায়। আমিও ছুটে যাই। কমোডে ব্রাশ লাগাই। তার দাঁতে দাঁত পিষে প্লাঙ্ক জমে গেছে কতদিন যে এভাবে শাওয়ার ক্রমাগত ফোঁটা ফোঁটা ঝরতে থাকা জল। আমার গালে বিচ্ছিন্ন দাড়ি হাত বোলাতে পারি না। রেজার চালাতে থাকি। আমার দাড়িগুলি উষর ভূমির মত একা বড় একা।
এই ঘোর বৃষ্টিপাত সারাটাদিন একটা জীবিত বেড়াল ছিল। আমি ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়ি। বারান্দার পেছনে ছোট্ট তাদের পাতানো ঘরকন্না । দেখতে গিয়ে চশমার কাচ কেমন ঝাপসা। কামিনী যে সরু তার বেয়ে খাড়া হয়ে যাচ্ছিল । অস্বচ্ছ আকাশ ভেঙে গেছে দেখে আমি ছুটে ঘরে ঢুকে গেছি। কামিনীর হাত থেকে তার ছুটে গেছে। ওর ঝুঁকে পড়া মাথা। পেলভিক, কলার বোন আমি ছড়ানো রক্তধারার চিহ্ন খুঁজছিলাম। আঙুলের ফিলামেন্টগুলো দপদপ করছে দেখে গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসি। বাতিস্তম্ভের নিচে কার দুর্ঘটনায় ছিন্নভিন্ন নয়নতারা বা কেবল তারের জটলা আকাশ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে থাকা নয়নতারা…
মৃত্যুর মিছিল দেখে বাড়ি ফিরে একটা হট বাথ নিয়ে এলিয়ে যাচ্ছিলাম । আরো রাতে জানলার পাল্লা ধরে চিৎকার চলবে। ভীড় বাড়বে আম,সুপুরি, কাঁঠালের আরো বাড়লে বট,শিশুরা। বোগনভোলিয়া একটা ডালিয়ার মত রক্ত ছড়াবে রাস্তায়। আমি ঘুম ভেঙে তুমুল বর্ষা দেখতে চাই সারাদিন একটা মৃত বিড়াল ছিল।
সকালবেলা তখন সবে রোদ্দুর একটা ফিমার বোনের গড়ন নিয়েছে বিছানার ওপর। কিচেন থেকে দুটো বাসি রুটি গরম করে এনে চায়ে ডোবাচ্ছি। দেখি করিবরগা থেকে একটা মা পাখিকে ঝাঁঝরা করে তার সদ্যোজাত বাচ্ছাটা হুঙ্কার করছে আর তার অতিকায় হাঁ যেন কয়েকটা ঘু ঘু কে নিমেষে মুখে চালান করে দিতে পারে। বাজার যাবার পথে খণ্ড খণ্ড জটলা। অজস্র পাখি মারা গেছে এলাকা জুড়ে। তাদের ছানা পোনাদের সমবেত সোচ্চার। কান ঝালা পালা করে। বনমন্ত্রী এসে বললেন। ঝান্ডা নিয়ে ঢুকে পড়েছিল কিছু কাকের দল অথচ তারা সব ঘুঘু পায়রা বা চড়ুই। পাখিরা চিনতে পারে নি। আমেরিকার একটা পুরনো ট্রিকস, ওখানে আন্দোলন রুখতে কাকেরা এভাবে ঢুকে পড়ে তারপর আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দু থেকে ক্রমাগত বাইরের কক্ষপথের দিকে চাপ বাড়তে থাকে।
মূলত আন্দোলন হচ্ছে একটা ব্ল্যাক হোল ফলতঃ বাইরের থেকে ক্রমান্বয়ে কাকেরা ঢুকে পড়ে এবং গ্রাভিটন কণারা তাদের অস্তিত্ব ছারখার করে দেয়। কেন্দ্র অবধি আর ছুঁয়ে ওঠা হয় না। আর এ সমস্ত ঘটনাক্রমের বহিঃপ্রকাশ রূপে ব্ল্যাকহোলের পরিধি বরাবর একটা আলোর বলয় তৈরি হয়। আঙুলে আঙুলে চকমকি। ঘষা লাগে আর জ্বলতে থাকে ওহে কালসর্প যোগ।
এত কিছু কেলেঙ্কারির মধ্যে। কেলেঙ্কারি মানে রাতভর আমার ইউরিনাল ডিস্পেন্সারটা মাড়ি বের করে হাসছিল। কমোডটা চিৎকার করছিল তার অগ্রপেষণ দাঁতে ব্যথা, তার কর্তন দাঁত পিছলে যাচ্ছে। তার ছেদন দাঁত শিরশির করছে। আর শাওয়ারটির অনন্ত কান্না ও তার ঝরতে থাকা ফোঁটা ফোঁটা জল। সকালে মেইল পাঠাই অনিদ্রাজনিত একটি মাত্র রাত। একটি মাত্র দুপুর চাই শাঁসালো। সকাল ফুরতেই নি সা এল। বলল এসব আপাত। খবর পাচ্ছি ওখানেও প্রথমে বাচ্ছা পাখির অতিকায় হাঁ। বাসা ছেড়ে পালাচ্ছিল মাতব্বর পাখিরা। পরে দেখা গেল কাকেরা কেন্দ্র দখল করেছে। আমি বললাম এত প্রগাঢ় বৃষ্টিপাতজনিতভাবে একা। আর বললাম আমার বারান্দার পেছনে আস্তে আস্তে মাথা উঁচু করতে থাকা কামিনী। তার কলার বোনের আর্তনাদ, তার জরাসন্ধ চিরে ফেলতে থাকা বাতাস। আমরা কি জানলা বন্ধ করে দেব!
কামিনী বা ডালিয়ার কুঁকড়ে যাওয়া মাথা। পাখিদের বাসা দখল উল্লাসে কোনো আলো নেই। আলো সেই কুঁচফলের বাদাড়ে। বনচাঁড়ালের পাতারা কেঁপে উঠছে। এই সাড়া জাগানো রোমহর্ষক রাস্তায় আমার এলোমেলো হওয়া আঙুলগুলো ও তার ব্যাস্তানুপাতিক ফিলামেন্ট। ঘষে যাই যদি একবার! আমাদের এভাবেও মুক্তি নেই। আমি অথবা নি সা এই আধা শহর পেরিয়ে হাঁটতে থাকি। আমাদের সমবেত হাঁটা বড় নিঃসঙ্গ।
তারপর অনেকটা শহর পেরিয়ে শষ্যখেতে পাশে এই অপাপবৃষ্টির জলে ঝুঁকে পড়া ফসলে উদ্বায়ু হতে থাকি। আমার জমানো নাইট্রোজেন মাটির ফাঁক ফোঁকড়ে ঢুকে যাচ্ছি, আমি আমি দেখতে পাচ্ছি এই বিজড়িত ধান,এই কেওস বাতাস সরল রেখা বরাবর আর পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে মিছিল। আমিও মিছিল। আমার তাবৎ জমানো উত্তাপ এই মাটির নিচে জমা হয়ে থাকলে আমিও একদল ধানখেত হব তুমি দেখে নিও নি সা।
আজ সকালে রোদ্দুর এসে আমাদের বারান্দার পেছনে ছোট্ট সংসার। নি সা মাটিতে একটা শক্ত লাঠি পুঁতে কামিনী গাছটাকে একটু করে মাথা উঁচু করে দিচ্ছে এবার ফোটন কণা এসে জমতে শুরু করলেই সালোকসংশ্লেষ শুরু হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন