হঠাৎ এতো ভীষণ জোরে বৃষ্টি এসেছিল সেদিন, যে কেউ বুঝতেই পারেনি ওর পেছন পেছন ধাওয়া করে বড়ো রাস্তার মোড়ে যাবে, নাকি স্টেশন চত্ত্বর ছেড়ে রাজপথে কিংবা এ-পথ সে-পথ ফেলে কোনো গলিঘুজি খুঁজবে, নাকি কোনো ফাঁকা জায়গায় যেখানে আকাশের দিকে মুখ করে দুহাত ছড়িয়ে দেওয়া যায়, চোখ বুজে ফেলা উপভোগ্য অনুভূতির মতো শ্রাবণের সাথেও প্রেম করা যায় সবার চোখের আড়ালে, গাছের কোণায়, ট্রাফিকের ধোঁয়া তোলা শহরের ক্র্যাকোফোনিক ব্যস্ততা থেকে ভোরের ট্রেনের বাঁশির মতো বহুদূরে, যেখানে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটারা একেকজন স্প্রিন্টার হয়ে ধেয়ে আসে ফিনিশিং পয়েন্টের দিকে, আর যার প্রান্তভাগে দাঁড়িয়ে থাকে আমারই মতো বৃষ্টিসঞ্জাত কেউ, বৃষ্টির সাথে সমানুপাতিক সম্পর্কযুক্ত একটি সময় ------ যাকে দেখা যায় না সাইকেল গ্যারেজের ভুরিভুরি সাইকেলের মাঝে একটি হয়ে চালকের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে, যাকে দেখা যায় না ধুলোবালির মাঝে ধূলিকণা হয়ে বেঁচে থাকতে। বুঝিয়ে শুনিয়ে আজ এমনই কোথাও নিয়ে যাব ওকে; এদিকে আকাশ ভাঙে, ওদিকে কয়েক পশলায় একটু ভিজিয়ে চেখে দেখবো এই সেই মুক্তি কিনা! যে রোজ রোজ আমার সাথে ট্রেনে করে যায়, আবার বাড়ি ফেরে আমারই সাথে। আজও ছিল, এইতো স্টেশনে কয়েকটুকু তফাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম দুজনে, তাও কয়েক মিনিট হবে যখন বৃষ্টিও এসে গেছে পুরোদমে এমন নয়, তবে যখন এলো তখন স্টেশনে হোক বা ট্রেনের ছাদে, তার ক্ষ্যাপামি কাকে বলে তা সে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ধনী-দরিদ্র ছোটলোক-বড়োলোক ছাত্র-ছাত্রী মাস্টার-কেরানি অফিসার-দোকানী চালচুলোহীন নির্বিশেষে সকলের জন্য সমানভাগে ভাগ করে দিচ্ছিল অকাতরে ---- তা মুক্তিও পেয়েছিল বেশ খানিকটা, আমারই সামনে। আর তারপরেই একটা ভিড় ট্রেন প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ালে সহসা স্টেশনের সমস্ত যাত্রীদের মধ্যে এমন একটা অদ্ভুত ব্রাউনীয় গতির সঞ্চার ঘটে যে তারই ফলস্বরূপ আমরা এদিক-ওদিক দিগ্বিদিক, জ্ঞানশূন্য ইতস্তত হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগলাম ও একে অপরকে ধাক্কা মারতে মারতে এগিয়ে যেতে থাকলাম জ্ঞানশূন্যতার চরম ভুলভ্রান্তিতে, যা আমাকে চালিত করেছিল ভুল ট্রেনে করে ভুল পদচারণের জন্য, যেখানে আমি বহমান মুহুর্তের মাঝে খুঁজে পেলাম না মুক্তিকে, হারিয়ে ফেললাম রং-বেরঙের শহুরে ভিড়ে আমার অযথা রাগ দেখানো মুক্তিকে, বদলে পেলাম শুধু একরাশ শব্দহীন চেঁচামেচি যা আমাকে সেই বিরক্তিকর মুক্তির অভাব বোধ করাচ্ছিল বারেবারে।
রেলগাড়ি নিজের গতিতে ধাবমান হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু আমার স্থিতাবস্থায় বারবার ঝাকুনি দিয়ে প্রত্যেকটা স্টেশনের দূরত্ব এমনভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছিল যে, আমি মুক্তি কে খুঁজছিলাম ওইখানে যেখানে আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল দরদী জনতার একেকটি ঢল। একেকটি দল দুপুর গড়ানো সাড়ে তিনটের ঘুমে দাঁড়িয়ে-বসে ঝুলে না-ঝুলে গুঁতো খেয়ে খেয়ে ঝিমোচ্ছিল প্রাণপণ। একদল মহল্লাসে স্কুল-কলেজের বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে রকমসকমের গল্পে ব্যস্ত, আর একদল নিত্যযাত্রী তাদের উইকিপিডিয়ার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পাওয়া একটা ট্রেন দুর্ঘটনার খবর নিয়ে বেজায় প্রতিপক্ষের আসর বসিয়েছে, যার ডামাডোল ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল পাশের সিটে বসে থাকা এক কপোত-কপোতীর বিস্তর বিশ্বাস ও ভরসার বিশ্রামকে। তখনই আমার খেয়াল হলো, কখন যেন বৃষ্টিও তার ঝমঝমানি বন্ধ করে টিপটিপানি ধরে নিয়েছে; কিন্তু ওকে যারা ধাওয়া করেছিল স্টেশন থেকে স্টেশনান্তরে, তারা তো ফিরে এসেছে সেই কখন, এসে অংশ নিয়েছে আমার মনে নতুন ফন্দি আঁটতে। তবে কি মুক্তি সেই হঠাৎ না পাওয়া কিন্তু দূরে অনুভূত কোনো আনন্দের রেশ! শূন্য বিঘৎ আয়ুর সামনে দাঁড়ানো আমার পার্বত্য জল, জলীয় কাঁটাতার! ---- এই রেশ কাটতে না কাটতেই আমি কেঁদে ফেললাম, চেঁচাতে লাগলাম মুক্তি মুক্তি করে, 'মুক্তি, কোথায় তুই?' ---- সবাই হাঁ করে চেয়ে রইল আমার দিকে। অনেকে অনেক কথাও বলে উঠলো ----- 'কী লোক রে বাবা! আশ্চর্য!' ---- 'পাগল নাকি!' ---- 'মুক্তিটি কে ভাই? সে কি গেটের বাইরে বসে আছে?' ---- 'নাকি মরার শখ হয়েছে?' ----- প্রায় বাইরেই চলে গিয়েছিলাম, আর একটু হলেই...। কে যেন ধরে ফেলেছিল আমার হাত। কিন্তু মুক্তি! তুই কি রাগ করেছিস মুক্তি! দ্যাখ, দ্যাখ না! যতদূর চোখ যায় শুধুই সবুজ, কী সুন্দর চারিদিক, দেখলে মনেই হবে না এই সৌন্দর্যের মাঝে তোকে খোঁজা কতটা দুষ্কর! শোন, শোন না! যতদূর কান যায় শুধুই কু ঝিক ঝিক, আমি যে তোর মতন এতো কথা বলছি তা কেউ শুনতেও পারছে না! বল, বল না! যতদূর বলা যায়, সে মারিয়ানা হোক বা এভারেস্ট!
যখন শেষ স্টেশনে চলে এসেছি তখনও দেখছি এক একটা দল একেক জায়গায় শেডের নীচে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দোয়াপ্রার্থী হয়ে ---- আকাশের কাছে, সূর্যের কাছে, মেঘের কাছে, পথের কাছে ------ আমি কী করবো ভেবে না পেয়ে বৃষ্টির পাশেই দূরত্ব রেখে দাঁড়ালাম, হাতে হাত রেখে, পায়ে পা রেখে, শুধু নিজেকে রাখতে পারিনি, কারণ আমি তখন অনেক দূরে ----- মুক্তি মুক্তি মুক্তি ---- কোথায় তুই? ---- আমার আর বৃষ্টি ভেজা হলো না। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের এমন অপূর্ব পুনর্মিলন যেন শুধু পৃথিবীরই হলো, শ্রাবণেরই হলো, গাছেদেরই হলো, ধুলোদেরই হলো, আর হলো স্টেশনের কালো টিনের ছাদের, যার নীচেই তো মনে আছে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে ছিলাম কাল প্রবল বৃষ্টিতে, যখন শীতের ভোরের মতো একটু দূরই অনেক আবছা হয়ে পড়েছিল বর্ষার সদ্য বিকেলে, ফেরিওয়ালারা যে যার পসরা গুটিয়ে নিচ্ছিল, আবালবৃদ্ধবনিতার দল বিরক্তি প্রকাশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল, কিন্তু সে তো কারো কথাই শুনবার নয়, এক নাগাড়ে বলেই চলেছে ঝমঝম ঝমঝম ঝমঝম, এমনকি আমার কথাও শুনছে না; কতবার বললাম, আমাকে একটু ভিজিয়ে দিতে কালস্রোতে ----- ঠিক নানান হাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেলো। ভেবেছিলাম এবার ঠিক বুঝে নেবো যে, ওই সেই মুক্তি কিনা! কিন্তু তা এবারও হলো না। ফলে আমিও তেমন আড়ম্বর প্রদর্শনের বদলে একটু জড়োসড়ো হয়ে গেলাম, পড়ে গেলাম উভয় সংকটে। ওদের দুজনকে আমি কিছুতেই একসাথে মেলাতে পারি না, একজন তো আমার সামনে বকর-বকর করেই চলেছে, আর অন্যজনের তো রাগ অভিমান ব্যস্ততার গেরোয় দ্যাখা পাওয়াই মুশকিল। চারিদিকে এতো প্রতিবাদ এতো উৎসব এতো প্রাচুর্যতা, কই আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, মুক্তিকে খুঁজতে গিয়ে আমি ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছি এদের মাঝে, হারিয়ে ফেলছি নিজেকে, হারিয়ে ফেলছি আমার ব্যক্তিত্ব, বিশেষত্ব, একাকীত্ব, আমিত্বকে ----- যা কখনও গত কয়েক বছরে তৈরি করা বিশ্বাসকে পশ্চাদাঘাত করছে, কখনও অসীমের মাঝে নিজেকে খোঁজার ব্যস্ততায় অলস করে তুলছে, কখনও মুক্তিকে অবিশ্বাসী করে তুলছে নিমেষের মধ্যে, যার সঙ্গে অতীত সংগ্রামের তুলনায় কেবল চলে। আর আমাকে শুধুই দেখতে পাঠাচ্ছে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে কিনা! যদিও বেশিরভাগ লোকের দলই তাকে তোয়াক্কা না করে যে যার নিজের গন্তব্যে ধাবমান হয়েছে। শুধু আমার চলনহীন বলনহীন কথনহীন যৌবনহীন এক অস্তিত্ব যেন অস্তিত্বসংকটের দায় পড়ে মিলিয়ে চলেছে মুক্তিকে, যাতে আমার প্রাণের আরাম, মনের শান্তি আর আত্মার পথ চলা। ও কি সেই মুক্তি! মুক্তিই কি এই বৃষ্টিটা! — কিন্তু বৃষ্টি তো সকল জগতে সকলখানেই হয়, বাইরেও হয় ভেতরেও হয়, যা কিনা নিছকই এক প্রাকৃতিক ঘটনা। তবে তা কি কালের নিয়মে সত্যিই প্রাকৃতিক, নাকি ও আমার মুক্তিরই নিমিত্ত মাত্র! — প্রশ্ন রইল জীবনের কাছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন