আচ্ছা, মুক্তি নিয়ে কোনও কথা হলে আমিও কি ঠিক এভাবেই ভাবি! এই ধ্বনিময় বিশ্বে একবুক রঙের হাট, রূপের পসরা সাজিয়ে যে বসে, তার নিজের কি রূপ! আমি কি এও ভাবি-এই যে জেগে ওঠার প্রান্ত থেকে এক বিস্ময়কর শব্দজগৎ, তারও এক রসের আধার! এক অপূরণীয় বিস্ময় থেকে গন্ধ আসে, সুর ওঠে। সেও এক রূপের মায়া। এ মায়ার কি কোনও কূল হয়! এই যে দেহ-দেউল, তারও কতো কতো দরজা-জানলা! খুলতে খুলতে বেলা যায়। আমরা কি এও ভাবি কূল নেই, সীমা নেই, সে অকূল দরিয়ার মাঝি ভেসে চলেছে অপারের দিকে। অপার কখন যেন ওপার হয়ে গেলো! তারপর কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা। একবার ভাবলাম, এভাবেও যদি ভাবা যায় -

বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।

অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ।

রবীন্দ্রনাথ ভাবলেন। এই মহতের মহত্ব সেখানেই, তিনি যেমন বৈরাগ্য বোঝেন, বন্ধনও বোঝেন। আমাদের মতো ক্ষুদ্রপ্রাণ, যাঁরা হাফগেরস্ত জীবন কাটাই, না ঘরকা, না ঘাটকা, তাঁদের বৈরাগ্যসাধন নেই। আর ওই বন্ধনের মাঝে মুক্তির স্বাদ লাভ করা কি অতোই সহজ! আমরা জীবনটাকে সেভাবে বুঝি ক'জন!

হে মহাজীবন তোমাকে প্রণাম করি বারবার। যে জীবনের একটি বোধিবৃক্ষ আছে। একটি ছায়ার মতো গোধূলি চাদর বারবার চোখ থেকে সরে যায় আর ডাকে আয় আয় দেখবি আয়। দেখা তো সবটুকু পড়ে রইলো চোখের বাইরে। বিশ্বাসের আলো যখন ঝাপসা হয়ে আসে, বৃষ্টি তখন অবগাহনের উষ্ণতায় সূর্যোদয়ের গান বাঁধতে দেয়।

এই গান প্রণাম হয়ে ওঠে। আর ওই প্রণামে অবশ্য যতটা নতি, তার চেয়ে বেশি নির্ভার হয়ে ওঠা। এর মধ্যে এক একটা টুকরো টুকরো খোঁজ রয়েছে। কিছুটা অনন্তের, কিছুটা নিজের দিকে মুখ ফেরা। খুঁজতে খুঁজতে সেই আত্মের গহ্বরে ডুব দেওয়া। এক অতল জলের আহ্বান। অনেকেই দেখতে পায় না। কিন্তু ডুবে যেতে পারলে তার যে কী শান্তি তা কোনও মুক্তি দিয়ে বোঝানো যাবে না।

তাহলে কি আত্মানুসন্ধানের মধ্যেও মুক্তির স্বাদ লাভ করা যায়! হয়তো। নিভৃতিও এক মুক্তির সাধনা। সমস্ত কোলাহল থেকে, লোভ থেকে, চাওয়া-পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাগুলো সরিয়ে ফেলতে পারলে তার মধ্যে যে মুক্তির আনন্দ। আহা! এর বাইরে পৃথিবীতে বন্ধনের তো কোনও শেষ নেই। সংসারের বন্ধন, রাষ্ট্রের বন্ধন, প্রেমের বন্ধন, অপ্রেমের বন্ধন, হিংসার বন্ধন, ঘৃণার বন্ধন। শেকল ছেঁড়ার গান একটা অলক্ষ্যে বাজছে। তা সকলেই গাইতে চায়,

কিন্তু কন্ঠে সুর লাগে কই! বাঁশি তো সঙ্গীতহারা।

যাহোক এই প্রলাপেরও কোনও বন্ধন নেই। কিন্তু মুক্তির সঙ্গে সাধনার কথা যখন উঠলো তখন চেতনার কথাও বলতে হবে। হয়তো এককলি গানও ভেসে উঠতে পারে। গানের যে অনেক ধারা। না-বাঁশি, হ্যাঁ-বাঁশি, ওহো-বাঁশির ফাঁকে যতটুকু নৈঃশব্দ্য সেখানেই গান গান অট্টহাসির পদধ্বনিগুলো। চোখের জানলা দিয়ে চেতনার যে প্রসারণ আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে সেখান থেকেই মুক্তির প্রথম আনন্দ। কারণ এই আলো আমাদের অপরূপ এক রূপের সন্ধান দেয়। সেই রূপময় জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে চায়। যা অপরিচয়ের প্রথম পরিচয়।

কে যেন ভেতর থেকে বারবার নাড়িয়ে দিচ্ছে আর বলছে দ্বার খোলো। দ্বার খোলো। ইন্দ্রিয়ের সকল দরজা খুলে দাও। তো আমাদের পাঁচটি পথ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক। কিন্তু তাদের দরজা কোথায়! পথের আবার দরজা হয় নাকি! হয়। হয়। তা নাহলে এতো খোঁজের কোনও মানেই থাকতো না। শুরুরও একটা শুরুয়াত থাকে। একটা আরম্ভ। শুধু মুক্তির জন্যেই একটি শিশু কৈশোর পেরিয়ে নব নতুন বিস্ময়ে চিত্ত জাগিয়ে অজানার পথে যৌবনের দ্বার খুলে দাঁড়ায়। চক্ষু বলছে সব কি আর দেখলাম! কর্ণ বলছে এই শ্রুতিস্বাদ, এখানে যে আনন্দ তাকে কতটুকু আর শব্দ দিয়ে ধরতে পারি! মন তাই ফিরে ফিরে নতুন দরজা খোঁজে।

আর তাছাড়া ইন্দ্রিয়ের যে প্রকাশ তা দিয়ে মানুষের জ্ঞানের পরিধি মাপতে বসলে দেখা যায়, বড়ই সীমিত। তা নিয়ে গর্ব করার মতোও কিছু নেই। বরং দেখা যায়, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, ঘ্রাণশক্তি ইত্যাদি যে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশ তা সব স্তরেই মানুষের চেয়ে অনেক পশুর তীব্রতর এবং সূক্ষ্মতর। কিন্তু এই অনুভূতির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মানুষ কীভাবে সমস্ত জীবের ঊর্ধ্বে সমাসীন হয়! এখানেই আমাদের যাত্রা এবং বিস্ময়।

এই যে আমরা মুক্তি খুঁজছি, কেউ বলছেন সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হবে, কখনও রাষ্ট্র বলছে হে স্বাধীনতা! আমাকে সমস্ত পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করো। আমরা একটা বয়সে এসে আত্মার বন্ধন থেকে মুক্তির কথা ভাবি। এতো সব ভাবনার কেন্দ্র হলো মন। তাই বলি মন চলো নিজ নিকেতনে। কিন্তু বললেই যে পথ দীর্ঘ হবে তা বলা যায় না। সে নিকেতনটা কোথায়! ওই যে কথায় বলে মন থাকলেই মনের হুঁশ সকলের মধ্যে থাকে না। 'সজাগ মন বা প্রবুদ্ধ মনের অধিকারী' সবাই হতে পারে না। একটা জাগ্রত মন চাই। মুক্তি আসে নৈঃশব্দ্যের জটা ধরে। মন শুধু অনুমান করেই ক্ষান্ত থাকে না, সে দেখতেও পায়। তার জন্যে আলোর প্রয়োজন হয় না, ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষের বাইরে এসে চেতনার তরঙ্গে মনের দেখাটা নিখুঁত হয়, যা একেবারে সন্দেহাতীত।

মুক্তি নিয়ে কথা বলতে বসে এভাবে আমার মন এখন উড়ু উড়ু। এখানে রাষ্ট্র, দেশ, সময়, সমাজ, হিংসা, ঘৃণা, দ্বেষ কিছুই যেন মাথায় রইলো না। দুঃসহ বেদনার জল যখন কান্না হয়ে বাজে, আমি তার সঙ্গে হয়তো দুদণ্ড গল্প টল্প করতে পারি। অশ্রুর চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলতে পারি দেখো, অসীম আভার সীমান্তে একটা কুসুম কুসুম মন। দেখো কেমন মুখ ঢেকে এক পাহাড় নুনে ভেজা সমুদ্র শুকোচ্ছে। একটা পাহাড় এবং সমুদ্র কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। কেউ কাউকে দেখেও দেখছে না। অথচ বিনিময়ের পারদ চড়ছে।

যার আলোয় জগৎকে দেখেছিলাম সেই আলোরই শেষ ঝলকে এক পলকের জন্যেই যেন দেখে নেওয়া যায় আলোর উৎসকে। যা চেতনার মূল কেন্দ্র। এখানে এসে পৌঁছলে আয়নায় প্রতিফলিত আলোর রশ্মি নিভে যায়। সমস্ত অচেতন প্রকৃতি চেতনার কাছে মাথা নত করে। কারণ ধার করা আলোয় তো আর জীবন চলে না। মনের জানা এবং অজানার মাঝখানে যে দ্বন্দ্বটুকু তাকে সংশয় এবং সন্দেহ মুক্ত করে একটা প্রকাশ আর উদ্ভাস এসে সামনে দাঁড়ায়। দেখা যাচ্ছে অনির্বাণের আলো জ্বলছে ইন্দ্রিয়াতীত হয়ে। সেই আয়না পেরোতে এক চেরা বাঁশের সাঁকো। ওপারের ঘ্রাণে জাগছে জীবনপোড়া রোদগন্ধগুলো। কেমন মায়াময়!

জীবনে এখন অনর্গল বাঁশির সুর বাজে। বাঁশিতে ফু দিলেই নৈঃশব্দ্যের কথা ওঠে। আসলে সে আমার মুক্তির প্রথম সোপান। চরাচরের সমস্ত কিছু থেকে বি-মুক্ত হতে শেখায়। একটা ডুব ডুব জাহাজের মাস্তুল। সেখানে দুটো পাখি এসে বসলো। 'জীবনের বোধিবৃক্ষ' মৃত্যুকে ভালোবাসতে শেখায়। কেমন পাতায় পাতায় বর্ণমালার আলো, অক্ষরের মায়া! কেমন ঝুরি নামিয়ে দিচ্ছে মাটির বুকে। দুধ হয়ে ফুটছে সুজলা সুফলা। অন্ধকার নীরবতাকে কোল দেয়। এ জগৎ রহস্যের আধার। এই আলোর আভাস জ্ঞেয় অজ্ঞেয়। নদীমা নদীকে জন্মের নানা উপাচার দিয়ে সাজাচ্ছে। তার মধ্যে অন্ধকার এক রমণীয় সাজ।

অজাতশত্রুর নির্জনে চন্দনের গন্ধ নিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। ঝুরি বেয়ে মেঘের কৌটো থেকে কয়েকবিন্দু আভা। নদীর কলকা পাড়ে ঢেউ ঢেউ ফুলছাপ। ছন্দ-যতি, মিল-অমিল নিয়ে এক আশ্চর্য তারার আকাশ। এ এমন এক মুক্তি যার কোনও দৃশ্যগত অস্তিত্ব নেই। কিন্তু একটা মনভাষা আছে। সে ফুটতে চায়। একটা মনচোখ আছে। সেও ফুটি ফুটি। যেমন প্রাণের রচনায় যে সমর্পণ তার স্নান সারা হলে আলোর দেহ মরে যায়। এটা কি সবাই বুঝতে পারে! পারে না। অথচ মৃত্যুর স্বরূপে তার দেখা নাদেখা কারণ হয়ে ওঠে। এই যে দেহ মরে যায় - তা কেন! আসলে তার আর কোনও বিশেষ থাকে না। প্রয়োজন থাকে না। প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে অপ্রয়োজনের পথ নিজের হাতে গড়া। এখানেই শান্ত স্থির নীরব আনন্দ ও বেদনার নিবিড় সংসার। যে ঘরে আলো আছে ঐশ্বর্যের। যেখানে কোনও সন্তানের নাম দুঃখ নয়। তবু তার অস্তিত্বে হাওয়া এসে নিরবধি দোল খায়।

কিছুটা অন্ধকার ধরে নিলাম। তার সঙ্গে জ্যোৎস্না। মিহি একটা বাতাস সব দুর্লভকে গাঢ় করে তোলে। ফুলে ফুলে উঠছে। এখন কথা হলো, কবি দেখলেন অন্ধকার ধরতে যে গাঢ়তা লাগে, জ্যোৎস্না ধরতে তার ঠিক উল্টোটা। এই একাকী নৈঃশব্দ্যের মধ্যে এই দুইয়ের মহামিলনে যখন একটা বৃক্ষের জন্ম হয় তার বোধি, তার প্রজ্ঞা নিয়ে এক এক অধ্যায় রাত্রির কাছে সমর্পিত হয়। এই সৃষ্টি যত বড়ো ততই তার মিলনের অপেক্ষা প্রসারিত। বহু কিছুর মিলনের মধ্যে দিয়েই এই সৃষ্টি। সময় তাকে লালন করে চলেছে মুক্তি দিয়ে। বিনম্র এক শুদ্ধ চেতনা।

অব্যক্তের এই অরূপ প্রসাধন নিয়ে সৃষ্টি। যে কোনও সৃষ্টির পেছনে জীবনের ভূমিকা যতটা, তার সঙ্গে জলের প্রবাহ জড়িয়ে। রচিত পথে পথিকের ভাঙাজন্ম চাতাল ধুয়ে দিচ্ছে প্লাবন করে। অনন্য এক রাত্রিমুখ খুলে দিচ্ছে জ্যোৎস্নাদ্বার। বেরিয়ে পড়ছে মুক্তির বিভা। বৈরাগ্যসাধন আর সাধনবৈরাগ্যে সেই একই ভাষা, কখনও অব্যক্ত, কখনও ব্যাপ্তময়। নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে জন্মঘর। বিমূর্ত বিস্ময় মাটিকেই দিচ্ছে শূন্যের পাঠ। আলতানো রেখার উপর চক্রাকারে পাক খায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ধোঁয়া ধূপ গন্ধ সব বহুমাত্রিক। মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে আসছে অকথিত বর্ণমালা। কথায় কথায় বর্ণ জুড়তে এতো রঙ! অনেকটা পথ দীর্ঘ হলো। আমরা নীরবতা দিয়ে দীর্ঘ মাপি। তারায় তারায় রংমহলের চাকা। ঘুরছে। যে চোখে আলোর ঘূর্ণি। কন্ঠে জমছে নরম রসকলি।

ওহে মুক্তি! অতি তুচ্ছ তুচ্ছ ধারনার মধ্যে আমাদের বেড়ে ওঠাগুলো যখন থমকে দাঁড়ায় তখনও আলোর কানে কানে অনাবিষ্কৃত অলোক মূর্ছনা। বিমূর্ত পথ রচনা করে চলতেই থাকে। ওহে মুক্তি! সব বন্ধন খুলে দাও। সব সংকীর্ণতা। নিভৃতের শোক এখন আর মৃত্যুর গান গাইবে না। দূরত্বজয়ের ভেতর ফিসফিসে হাওয়া। বিষন্নকে কাটিয়ে রিমগুলো ঝিমিয়ে এখন শুধু হাওয়ার ভেতর রাত্রি পেতে থাকে। কানে কানে কথা হয়। ওহে মুক্তি - "ধরা যাক সেই দৃশ্যটি। পড়ন্ত বিকেল। একটু পরে সন্ধ্যা ঘোর হয়ে আসবে অশ্রুপাতের মতো। একা একা একটি পাখি যেন গিলে ফেলতে চাইছে লাল আকাশ। স্টিফেন হকিং উচ্চারণ করে চলেছেন... রাজান্নাম সহস্রেণ সহস্রাংশুং দিবাকরম। অতিবেগুনি রশ্মি নেমে আসছে রোগ নিরাময়ের জন্য। ত্রিকুণ্ডলী থেকে ষটচক্র ভেদ করে সহস্রারে মাথা তুলছে একটি ভ্রমর। তার গুনগুন শব্দে কম্পিত হচ্ছে ব্ল্যাকহোল" (অরুণাংশু ভট্টাচার্য)।

তারপর অনিবার্য ডাকে ঘন অরণ্য থেকে বেরিয়ে আমরা আবার ঢুকে পড়লাম কুয়াশার গন্ধের ভেতর। হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় এক অতল পুষছি। দুটি সাদা মেষশাবক লাফিয়ে উঠলো কাঁধের উপর। সারা শরীর বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে নরম পেলব উষ্ণতা। উষ্ণকে আরও নরম করে তুলতে আবার এক পাখি পাখি স্বপ্নের ভেতর তার বিমূর্ত। ছন্নছাড়া একটা মন রোজ বেরিয়ে পড়ে অন্তর্লোক থেকে। আভরণহীন জল সাঁতরে অনন্ত। সবই তো প্রতীকমাত্র। এই যে মুক্তির কথা, যা আমরা বলতে চাই, প্রতীকের অলংকার দিয়ে তাকে ঢাকা হলো। হাত বাড়ালে হয়তো আকাশ হতে পারে। কিন্তু হাতে হাতে যা পড়ে রইলো তা আমার একান্ত। সে আমার মুক্তির আনন্দ ...।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন