সুজিত কুসুম পাল-এর অনুদিত কবিতা




নোবেল বিজয়ী আইরিশ কবি  
উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের সনেট 

‘লিডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান’ 


অনুবাদ ও ভুমিকা: সুজিত কুসুম পাল


আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯)-এর কবিতায় সেক্স ইমেজের উপস্থিতি থাকলেও ইন্দ্রিয় লালসার কোনো ছোপ নেই। তিনি মনে করেন, ‘The tragedy of sexual intercourse is the perpetual virginity of the soul.’ তার মানে, কুমারীত্বের বিশুদ্ধতাকে তিনি উন্নীত করেছেন মিলনের পূর্ণতায়, যার ট্র্যাজেডির আড়ালে খুঁজেছেন আত্মার অন্তহীন কৌমার্যের বসতি অনুক্ষণ। দিনশেষে একসূতোয় বেঁধেছেন দেহ, মন ও আত্মাকে। ভালোবেসেছেন রূপের ধ্রুবতারা আইরিশ জাতীয়তাবাদী নেত্রী মড গনের তীর্থগামী আত্মাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল জয়ী (১৯১৩) কাব্য সংকলন ‘গীতাঞ্জলি’র মুখবন্ধ রচনা করে ইয়েটস তাঁর চিরকালিন আসন নির্মাণ করেছেন বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে। এই মুখবন্ধ রচনার ঠিক দশ বছর পর তিনি নিজের নোবেলটি ঘরে আনেন ১৯২৩ সালে।
‘লিডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান’ কবিতায় গ্রীক পুরাণে বর্ণিত মানবীর ওরসে দেবরাজ জিউসের কন্যা সুন্দরী হেলেনের জন্মকাহিনীর আড়ালে, বৃটিশ কর্তৃক সাতশ’ বছর ধরে আয়ারল্যান্ড যে নির্যাতিত হয়েছে তারই একটি গ্রাফিক চিত্র এঁকেছেন আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯), যিনি শাসন ও শোষণকে আড়াল করেছেন ধর্ষণের রূপকল্প দিয়ে। ABAB CDCD EFGEFG স্কিমের ছন্দে ১৯২৩ সালে রচিত ১৪ লাইনের এই সনেটটি একটি সফল কাব্যকর্ম যার অবস্থান শিল্পোত্তীর্ণ উচ্চতায়। দু’টি অসম প্রজাতির (রাজহংস ও নারী) মধ্যে সম্পন্ন অস্বাভাবিক এক পাশবিক কর্মের রূপকল্প সনেটের মতো একটি সংবেদনশীল মাধ্যম তথা সীমিত পরিসরে উপস্থাপন করে ইয়েটস সত্যিই মুন্সিয়ানা প্রদর্শন করেছেন, এবং এই কারণেই এটি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। মাত্র ১৪টি লাইনের মধ্যে একটি অপ্রাকৃতিক জৈব ক্রিয়ার পাশাপাশি ঘটনার পৌরাণিক রেফারেন্স এবং ইতিহাসের এমন শৈল্পিক বিন্যাস ইংরেজি সাহিত্যে বিরল। অনুবাদকালে, ইয়েটসের ABAB CDCD EFGEFG স্কিমের ছন্দটি শতভাগ অপরিবর্তিত রেখে ১৪ লাইনের রূপক এই ইংরেজি কবিতাটিকে বাংলায় ১৪ লাইনের মধ্যে সীমিত রাখা হয়েছে। 
গ্রীসের স্পার্টা রাজ্যের রানী লিডা হঠাৎ দাঁড়ানো অবস্থায় টাল হারিয়ে ফেলেন। আচমকা উড়ন্ত একটি রাজহংস তাঁকে বেসামাল করে দেয়। বিশাল আকারের পাখা মেলে হাঁসটি জড়িয়ে ধরে লিডাকে। হাঁস তার জালের মতো বোনা পা দিয়ে আবেশ ছড়াতে থাকে নারীর দুই উরুতে। লম্বা গলার আগায় লাগানো ঠোঁট এগিয়ে দেয় রানীর গ্রীবা জুড়ে। হাঁসের পালকময় বুকটি একশ’ আশি ডিগ্রি কোণে চেপে বসে আক্রান্ত নারীর অসহায় স্তনের ’পরে। পালকশোভিত বিশেষ ‘অঙ্গ’টি গন্তব্য খুঁজতে গেলে নিজের উরুর উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় নারী। তাঁর আতংকিত সিদ্ধান্তহীন দশটি আঙ্গুল এই বিশেষ ‘অঙ্গ’টিকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেনি। উন্মত্ত সাদা পাখার নীচে অভিগৃহীত এক নারী শুধু কান পেতে শুনলেন এক লুঠেরা হৃৎপিণ্ডের অবিদিত স্পন্দন। বিন্যাসক্রমের শেষ ছন্দে বেজে উঠে সহসা শিহরিত সংগীত নিতম্ব জুড়ে। রাজহংস উড়ে যায় রানীকে ছেড়ে, বীজবপন নিশ্চিত করে। শুধু ফসলের মওসুমে হেলেন এলো ডিম্ব ফুঁড়ে। যুদ্ধ হলো ট্রয় জুড়ে। বিজয়ী বীর আগামেমননের স্ত্রী যুদ্ধশেষে স্বামীর প্রাণ সঁপে দিলেন পরকিয়ার সুরে।
কবিতার নাম ‘লিডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান’। কবিতার কোথাও ধর্ষকের নাম নেই। সনেট কবিতাটির চতুর্থ লাইনে ধর্ষক পুরুষের জন্যে একটি সর্বনাম (He) ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। লাইনটি হচ্ছে ‘He holds her breast upon his breast.’ একাদশ লাইনে আছে ‘And Agamemnon dead.’  আগামেমনন গ্রীক পুরাণে উল্লেখিত একজন বীর। আগামেমননের সূত্র ধরে খুঁজে নিতে হয়েছে এই কবিতায় অনুল্লেখিত ধর্ষকের নাম জিউস। জিউস, গ্রীক পুরাণ মতে, গ্রীক দেবতাদের রাজা। এই জিউস মানুষ কিংবা পশু, পুরুষ কিংবা নারী, যখন যাকে পছন্দ হয়েছে, তার সাথে মিলিত হয়েছেন। গ্রীক সমাজের মূল্যবোধ অনুযায়ী দেবতারা ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য এবং ভালো-মন্দের ঊর্ধ্বে। তাঁদের হাজারটা অপকর্মের একটি হচ্ছে ‘লিডা’ উপাখ্যান। জিউস কর্তৃক গর্ভবতী হয়ে লিডা ডিম্ব প্রসব করলে এই ডিম্ব থেকে জন্ম নেয় যে কন্যাটি, পরবর্তীকালে তিনি হন দুনিয়ার সেরা সুন্দরী হেলেন। হেলেনের পরিণয় সম্পন্ন হয় আরেক রাজপুত্র মেলেনাউসের সাথে। তাঁদের একজন কন্যা সন্তানও জন্ম নেয়। সুখের সংসারে একদিন লাগে আগুন; আরেক রাজপুত্র প্যারিস রূপের মোহে হেলেনকে অপহরণ করে। প্যারিসের কবল থেকে হেলেনকে উদ্ধার করার জন্যে গ্রীকদের মধ্যে যে যুদ্ধ হয় সেই যুদ্ধটি ‘ট্রোজান ওয়ার’ নামে পরিচিত। শেষ পর্যন্ত ট্রয় থেকে হেলেনকে উদ্ধার করা হলেও এই যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আগামেমননকে হত্যা করেন তাঁর-ই স্ত্রী ক্লায়টেমনেস্ট্রা। হেলেনের সৎ বোন (লিডার মানব স্বামীর ঔরসজাত) এই ক্লায়টেমনেস্ট্রা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গোপনে আরেক পুরুষের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হয়। এই  যুদ্ধে ট্রয় নগরী সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে কবিতাটির ওপর একটি বিশদ রিভিউ সংযুক্ত করা হয়েছে আমার প্রকাশিত ‘ইয়েটসের কবিতায় নারী ও নিকুঞ্জ’ (২০১৬) গ্রন্থে। তবে, ইংরেজি সনেট থেকে বাংলা সনেটে রুপান্তরের সদ্য প্রয়াসটি সম্পন্ন হলো আজকে (ডিসেম্বর ২০২১) ‘ভুবনডাঙা’ পত্রিকার সৌজন্যে। 







লিডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান


টাল হারান নারী উড়ন্ত রাজহংসের আচমকা ঝাপটায়;
আবেশ ছড়ায় আগ্রাসী ঠোঁট দিশাহীনের গ্রীবা জুড়ে; 
ছড়ায় সোহাগ ঊরূপথে; ঊর্ণময় পা ক্রমশ ল্যাপ্টায়;
হংসবক্ষ প্রাণিত হয় অসহায় স্তনের লয়হীন সুরে ।


ঢিলা ঊরুতে অন্তর্গত হয় পালকশোভিত লালিত অঙ্গ;
প্রতিরোধে বিমূঢ় হয় আতংকিত অসংসক্ত হাতখানি;
শায়িত শরীরে আঁকে সরল কোণ প্রকুপিত শ্বেত বিহঙ্গ; 
দলিত স্তনকে শোনায় অবিদিত এক হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বানী।

জঠরে জাগে জীবন নিতম্বের শিহরণে;
জ্বলে ওঠে দুর্গের ছাদ, প্রাচীরের হয় পতন; 
যুদ্ধ শেষে জয় আসে, ডানাগুলো চলে উড়ে;
আগ্রাসন স্তব্ধ হয় আগামেমননের মরণে।
পশুকবলিত নারী কি পেয়েছিলেন ক্ষমতাধরের যতন?
অনাসক্ত চঞ্চু তাঁকে মৃত্তিকায় ফেলে চলে গেছে দূরে। 


Original: Leda and the Swan By William Butler Yeats


A sudden blow: the great wings beating still
Above the staggering girl, her thighs caressed
By the dark webs, her nape caught in his bill,
He holds her helpless breast upon his breast.

How can those terrified vague fingers push
The feathered glory from her loosening thighs?
And how can body, laid in that white rush,
But feel the strange heart beating where it lies?

A shudder in the loins engenders there
The broken wall, the burning roof and tower
And Agamemnon dead. Being so caught up,
So mastered by the brute blood of the air,
Did she put on his knowledge with his power
Before the indifferent beak could let her drop?




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন