প্রজাপতির লাভা। প্রোজ্জ্বল। বুকে স্বস্তিকা। আড়ের দিকে লেলিহান হলদে। নীল গাছপালার সামিয়ানা। মুক্তির ওষ্ঠ সত্যসন্ধানী বৈদিকমুনি। কবচের চারদিকে পার্থিব তারাপরম। আক্ষরিক অর্থে ঠোঁটপুরু দুরুদুরু। মেঘ এবং বিদ্যুৎ। গোবেচারি এবং শিষ্ট। অশনি এবং ঝলকানি তাঁর চেতনার চৌকাঠ। গীতিভ্রমরটি পুরাতনী! শরবিদ্ধ চাঁদেলা তুষ। পুষ্টস্তনের উচ্চারণ! আমার কয়েক আনা কলমে এমন সাম্রাজ্য আঁকি কী করে!
বন্দনায় ব্যস্ত স্বয়ং অন্তরীক্ষ। চপলমতি খরোষ্ঠী! শ্রুতকীর্তির লিপিও থাকে না পিছিয়ে। নদীর শোণিতপ্রবাহ! সনাতনগোষ্ঠীর আকাশ। অই যে নিঠুর ধূমকেতুর হা হা! হাসিতন্বী ধ্রুবতারা! অই যে খলখল মেদুর যাত্রাপথ! মহানুভব মৌতাতের কমললেবু। প্রথম আভা। দেহাতী সূর্যের রাঙাবেলিয়া! পাপিয়ার মিড়! কুরুশকাঠের তৈরি মুক্তির মুক্তাঞ্চল। কতো প্রশ্ন যে তাঁকে ঘিরে।
মুক্তি কোথায়? কোথায় গেলে শুনতে পাবো পরাবাস্তবী মোহিনীঅট্টম? উত্তর দেবে কে?
কবিতা? সঙ্গীতসন্ধ্যা? তন্দ্রারোগী সাহিত্যিক? কার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর আছে? পূর্ণপ্রান্তরে জলকেলি সেরে যে পাগলপারা ধূপধুনো, শেষ অবধি উত্তর দিলো সেই!
মুক্তি। ডানামেলা জনপদটি। জলদর্শী পাখিপনা। বৃষ্টিপনা! নাম জানি না । ঠিকানাই বা কী। রঙ্গিণী বাদল! শিসমোহন! আত্মহননের বাসনা ছিঁড়ে কোজাগরী রোদ। প্রশ্ন আর উত্তরের চরমঘূর্ণিতে লুটোপুটি ধানঝিনুক! ঝিলমিল মাখা বিষহরি কথামৃত! চাষপুকুরের ভিতরকণিকায় সুডৌল কনকচাবিটি!
কিন্তু সঘনঘন তালা কই?
তালা বন্দী আছে দেরাজের ঝঙ্কারে, নাবিকের ফরাসে, ঘুমকন্যের ডানাঝলকে! কুহেলি আর জাটিঙ্গার হৃৎচুম্বনে। নুয়েপড়া বিকেলের সান্তালখোলায়!
তালাটি রচিত পিরিচে পেয়ালায় তেষ্টার জ্বরে!
মুক্তির তালাটি আমার শ্যামবাসনার আড়ালে, গোপনতম প্রেমবিহারে! জুনরাতে জুলাই ঝিরিঝিরি জোনাকসৈকতে। সকল যৌনবাসনায়, বাসনভাঙার গৃহপ্রবেশে! আমার মুক্তির খণ্ডাংশ দিয়েই তৈরি বুকের ক্যালিওগ্রাফি। স্তনের উচ্চাবচ! আমার স্বমেহনের স্বর! মুক্তির দ্বাদশীবেলায় দুটি পাতা একটি কুঁড়ি! আমি তো জন্মান্তর পেরিয়ে এসে মধু আর মহুলের ঘ্রাণযুক্ত মুক্তিকে হৃদয়হরণ বলেই ডাকি!
মুক্তির রং? মুক্তি কি গান যে তার রং হবে! মুক্তি গান নয়, বাঙালি সম্প্রদায়ের আবৃত্তির মতো দেখতে আহুতি! ক্ষেত্রলক্ষী। খানিক প্রস্রবণ, ক্ষণিক বল্মিক। মায়ামন্ত্র কয়েক ছটাক! প্রবাসী ঝাঁপতাল। পিট্যুইটারির সরগম! মুক্তির দশদিক পোখরাজ এবং অন্বেষণের রং!
মুক্তির আকার?
ঘরোয়ামতো, যামিনীরায়ের পট। সপ্তরথীর শর। অভ্যর্থনার কাঁচাসোনা। তৃষ্ণাহরা প্রদীপবতী। নৃত্য এবং কোমরদুলুনি। একবার মুক্তির সাগর পেরিয়ে নাটোরের পালকে ভেসেই গিয়েছিলাম! সারা রাত্তির সরবতের গর্জন! নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেওয়া উরুর চুম্বক!
চুম্বন? কী আর বলি! একবার ঠোঁট ঠেকালেই বাঘিনীফুলের লালা!
ভেবেছিলাম মরেই গেছি। শেষ অবধি পগারপারে ভরাডুবিতে এসে জিরোয় প্রাণ। প্রলাপের রথ থেকে নেমে আরও একবার প্রাণবায়ু! অপরা বাতাস! মুক্তির হেঁশেলঘরে প্রাণহারানো প্রয়াগ! দোর্দণ্ডপ্রতাপ অপ্সরা কুণ্ড! জানতে পারিনি আগে!
তাহলে মুক্তি কী দেবালয়? জান্নাতের জুঁই? বৈরাগ্যের হাস্নুহানা?
না গো!
মুক্তি, প্রশ্রয়ের কলিজায় নাভিমূলের মজ্জায় আবিস্কারের নেশায় মগ্ন আশ্চর্য জকি! রেসঘোড়ার চরিত্র। ফিনিক জড়ানো। এমন দে-দৌড় জম্মে দেখিনি ভাই! তুমি দেখেছ কখনো? এমন জিনিয়া-নিটোল! কালজয়ী জার্সিবদল! এমন মাত করে দেওয়া সলিটেয়ার? গ্রামোফোনে বেজে ওঠা আশ্চর্য কিছু প্যাথস! এমন মেরিরক্তিম চিয়ার্স! চার্জশিট আর ক্লিনচিট! পানশালায় যে মুক্তির পেগপ্রবণতা মুক্তির তাঁর প্রতিটি প্রলয়ই প্রবল স্বেচ্ছাচারী।
তবে হ্যাঁ, কখনো কখনো সে প্রদোষকালীন টলমলেও বটে। পেয়েছি শুনতে অতলান্তকালে। একবার দিবাগতে অরণ্যভ্রমণে তার রভসদীপ্ত বিহার! সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা প্রসববেদনা লতাপাতা। ধনেখালির সুতাশালায় চওড়াপাড় কয়েকটি জঙ্গুলে বাঁধন। চেষ্টা করেছি অনেক। ঘরে ফেরার আগে নানা প্রয়াস! যখন পারিনি, ধুত্তেরিকা বলে জোব্বার অন্ধকারে কয়েকটি বাসি জ্যোৎস্না, কয়েকজন চারমিনিটকে নিয়েছি নিয়েছি।
মাঝে মাঝে ভাবি মুক্তির আবেদন যদি শতদলপন্থী হত! তাহলে কী হতো!
মুক্তি তো একজন সারং নয়। সহস্রধারা বাণিজ্যচরাচর। কামরূপ মাধ্যাকর্ষণের খোপে খোপে দলমাদল আর কোকনদ। মুক্তির ইচ্ছাপত্রে লাবণির পাট্টা। তার সকাশে জীবন যেন পুরোহিত। পূজার পাশে শিখরি অর্চনা। কথোপকথনের লাবণি। প্রেমিকযুগলের হৃষীকেশ। মাদকাসিক্ত শ্রাবণ। দূর থেকে মনে হয় কোলাকুলি আর ফিসফিস! উড়ে আসা কলমের দোপাট্টা। কাছে এলে বুঝি সর্বরোগহর বিশল্যকরণী বটিকা!
বড়োঘড়ির পৃষ্ঠায় নিবিড় নিখুঁত রাজতটিনীর স্পর্ধা! রাগিণীপ্রবণ পরিক্রমা। প্রতিটি পথকীর্তনের পদাবলীতে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। তারপর নিজেকে রাঙানো! ফুল ফসল ঘাসফড়িং আর সেগুনহ্রদের কিনারায় নিজেকে পর্যবেক্ষণ।
ও মা! কী দারুণ ছায়াপথে চাষবাস! পথশিশুর মতো দেখতে গ্রাম। চোখদুটিতে কী আরাম! একটু ছায়া পেলেই যেন ঘুম শোনাবে। একটু আদর জানালেই উপহার দেবে দোলনা। একটু মলম করলেই আমার ছোটবেলা, রুলটানা!
মুক্তির প্রথম সংস্করণ?
কবেই শেষ! গুহাচিত্রের প্রথম বরকন্দাজেই শেষ হয়ে গিয়েছে মুক্তির পাইক। এখন এদিক সেদিক যতটুকু চোখে পড়ে, সুজলা মেরুন কালার, সুফলা ট্রাপিজ। নয়নহরিণীর লেখা কাব্য নাটক উপন্যাস, তাঁতের শান্তিনিকেতন।চৌকোটিপ খোয়াই। পাঞ্জাবি পরা কবিসভা। পুরস্কার। থইথই চিত্রনাট্য। মঞ্চযাত্রা। আর এক গেরামভারি সোনাঝুরি! মুক্তির নাম করে সে এক অলৌকিক, গাণিতিক বলয় করেছে তৈরি।। অধিবেশনের পর অধিবেশন। বারো রকমের বাউল। মুখর বাদলরাত। সেই ছাদনাতলায় এখনো কারা যেন নিয়মিত বিবাহ। মঙ্গলঘট। বেনারসি জোড়। মালাবদল! মেঘটোপর! মল্লার! মুক্তি এখন বিয়েচিহ্নের শেষ সংস্করণ!
তাহলে মুক্তি বুঝি যুদ্ধ? আরে না না! মুক্তি যুদ্ধ কেন হবে?
মুক্তির জন্যেই সরু রোগা মোটা চিলতে – যতো যুদ্ধ! কেউ রাজপ্রাসাদের ম্যাজিক থেকে মুক্তি চাইছে। সাগরিকা চাইছে মুক্তি উচাটনের ফসফরাস থেকে। শাড়ি মুক্তি চাইছে মায়াবিনী আঁচল থেকে। ব্রেসিয়ার বন্দী থাকতে চাইছে না স্তনের ট্রিগারে। মুক্তি চায় নার্সিসারের সঙ্গমী উল্কিস্রোত থেকে। বৃক্ষ মুক্তি চায় পাখিকুঠুরির জানু থেকে থেকে। নদী এখন যুবতী। সে থাকতে চায় না আর ট্রাঙ্কবন্দী। মুক্তির বাসনায় সে এখন মিছিলতলায়, ধর্মতলায়। কোজাগরী চায় মুক্তি ঢেঁকিছাটা লালচালের ঝোরা থেকে।
এমনকী দুপুরও মুক্তি চায় সেলফোনের নেফারতিতি থেকে। জাহান্নম মুক্তি চায় আগুন থেকে আর জন্নত হুরপরীদের বাস্প থেকে। মন্দির নিস্তার চায় চালকলা আর দুধসাবু থেকে। চোখ মুক্তি চায় অশ্রুলায়লা থেকে। ডাকঘর এখন প্রেমপত্রগামী। মুক্তি চায় সিঁদুরবন্দর থেকে। প্রতিটি লেখা মুক্তি চায় বানানভুলের হাত থেকে। ভোরবেলার হাত থেকে মুক্তি চায় সূর্য, চাঁদ মুক্তি চায় নৈশপূর্ণিমার মৃগয়া থেকে। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে লেখা চিঠি মুক্তি চায় অন্ধত্ব থেকে। মানুষও নেই পিছিয়ে। সেও মুক্তি! মানুষের কাছে মুক্তি কোনো যুদ্ধ নয়। তবে মুক্তিচাওয়া মানুষরা বেশীরভাগই অস্ত্রপ্রবণ, যুদ্ধভ্রমণ হয়!
কবি গাইলেন মুক্তির মানে! ক্লিওপেট্রার স্তব স্তুতি এবং দেবত্ব!
গায়ক লিখলেন সুবানসিরির রোপওয়ে, মুক্তির এলোচুল মার্বেল-দামাল।
সমাজবিদ বললেন, মুক্তি হলেন সোমরস সাবাড় করা অবৈধ দাম্পত্য।
বিজ্ঞানী আঁকলেন মুক্তির শীতাতপ- কৈশোর থেকে যৌবন! মুক্তির কৃষ্ণগহ্বর।
সঙ্গীতজ্ঞ বললেন, মুক্তি আর কিছুই না! রকডিস্কোর ফ্রেসকো।
দার্শনিক হাসলেন মুক্তির খরবাতাস, নক্সাদার শ্বাস এবং কষ্ট।
সন্ন্যাসী লিখলেন বেশ কয়েকটি ছত্র।
মুক্তির গোত্র বসন্তকাল! বৃষরাশি। বৃষলগ্ন। মৃগশিরা নক্ষত্র। গৃহদেবতার দুইতীরে সাজানো কাশ্যপ মুনির গোত্রাঞ্চল। সংশয়ী নয় আদৌ, সাদামাটা গীতগোবিন্দ। উথাল-পাতাল নির্বাণের বৈঠা। গড়নটি মেঘল। দীঘলপাড় চন্দনবস্ত্র। রমণীয় ময়ূরনৌকা। বকুলে চুমকিতে আঁটসাঁট ব্রজপ্রাসাদ।অপাপবিদ্ধা মুক্তির সংখ্যা লাখ দুয়েকের কম না।
এমনই এক মুক্তিবাসনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমার। স্বাতীরজনীর সরাইখানায়। কয়েকদিন তার সঙ্গে এক শয্যায়। পান করেছিলাম তাঁর বাক্যমদিরা। এক ঝঞ্ঝায় উড়ে গিয়েছিল আত্মার বসন, ভেঙেচুরে একসা অভয়বাণীর ভূষণ, এক ঘুমে কাবার গায়েহ্লুদের হালখাতা। কাহারবা আর দাদরার হাভেলি। নির্ভেজাল লজেনরঙের মহল্লা!
তারপর একদিন। সেদিন দারাপুত্রহীন অক্ষ। দ্রাঘিমাহীন ব্রহ্মাণ্ড। সিংবোঙ্গার রুদ্রাক্ষমুদ্রায় চরম ঝুমুরতাল! শাপমোচনের বেদীমূলে আমাকে একশোভাগ উজাড় করে ফিরে গেল সে অন্যমনের লয়কারীতে! মহাকালের রথে চড়ে, পক্ষিরাজের শেকল ছিঁড়ে কোথায় যে উড়ে!
দ্বিতীয়বার যদি দ্যাখা হয় তার সঙ্গে? কী কী করবো! নিজেই জানি না!
স্পর্শ করার লোভই সামলাতে পারবো না! যে মোহময় অজগর শুনিয়ে সে আমার সারা গায়েদুপুরে চুরচুর আর ছারখার, সব একে একে ফেরত শোনাবো। তারপরে ব্যাবিলনের ছররা। হিসেব আর নিকেশের ভস্ম ভুরু ধোঁয়া। নারীমাকড়ের মতো উটপাখির বালুঝড় বুকে দুলিয়ে পৃথিবীর সমস্ত ছায়াকান্না আর দাপাদাপি সহ তার দিকে। সে আরও নিকট হলে দীর্ঘজখমের শার্টকার্নিশ! আমিও জিভ আলজিভ তালু দন্ত!
তাঁর পাঁজরের আঙ্গুলে, তলপেটে, নিরুদ্দেশে! ১৮০ ডিগ্রী রক্তহোলিকা! ঈশানকোণে ঈশানী! উপায়হীন বাউন্ডুলে আমি! পরমানন্দের কণ্ঠনালী জড়িয়ে! আমার বয়েসের চাইতে বেশি চুম্বনগোধূলির সবুজ মুঠি, মদ্যপবনের ম্যামথ! মনপবনের বাইসন!
কী রোমাঞ্চকর আশ্রয়! অষ্টাদশী ঝুলন। সেই মুক্তির প্রসাদী ফুলে ফলে এমন মাধুকরী যাপন যেন শেষ না হয় কখনো!
তবে এ’কথা স্বীকার করতে লজ্জা বোধ করি না এতোটুকু! প্রাচীনতম মুক্তিটির খোঁজ আমি আজো পাইনি। শুনেছি সে নাকি দিগন্তজয়ী ভাটিয়ালি! যমুনাবতী সরস্বতীর নাও! দ্রুতডাঙা, লোকসাহিত্যের নির্মাণ। বেসরকারি কবিতার নির্বাণ! এমন বিচ্ছুরিত মুক্তিকে পাওয়া নয় মুখের কথা।
সেই মুক্তিকে খুঁজতে মুক্তির বৃত্তে ঘুরে যাই অনবরত। মগজের কোষে কোষে খুঁজে ফিরি ! লবনসাগর! ঢেউ, সাঁতার। একাকীত্ব যেন বৌদ্ধভিক্ষুর বোধিসমগ্র। পাঠ নিই সাধকের তপোবন। জানি, ঋষিনেশার দেশে নিজস্ব বসতি স্থাপন করা কঠিন খুব! প্রার্থনা করি,
নিদ্রাসমগ্র থেকে যেন জেগে উঠি। শিমূলশিশুর সঙ্গে বাঁধতে পারি যেন জীবনের খেলা। ডাহুকের তীরে বসে যেন নিজেকে আদর! যেন মুক্তির সিংদরোজায় দাঁড়িয়ে মাথা কুটে না মরি। বরং বুক চিতিয়ে নিধিউদ্ভিদের বাঁশিটি নেড়েচেড়ে!
জানি মধু সংগ্রাহক সে! মাত্রার অতিরক্ত প্রেমিক! উজ্জল মুখে দেবতার ঘাম। বুকে ঈশ্বরের দুধ! পাকদণ্ডীর শিলায় উপশিলায় মন্দিরের ডাকনাম! ব্রজকাহনে বিরহবণিকের ঢল! বীর্য আর ভ্রূণ! গমখেতের বর্ণাঞ্চল।
বারবার মনে হয়েছে, এই বুঝি পেয়ে গেছি মুক্তির ময়ূরাক্ষী। এবার বুঝি পেয়েই গেলাম তাঁকে।
সৎ কথাটি হল, সম্পূর্ণ করে পাইনি কখনোই পাইনি তাঁকে। একদম নিজের করে নিজস্ব ঘরানায় ত্রানমুহূর্তের শঙ্খ সে, আমার একান্ত আজান! তবু তাঁরই জৌলুসে ভরে উঠছে গীতভবন। তার আদিবাসি পাঠশালায় ছোট্ট ছোট্ট বেঞ্চে বসে শিখে নিচ্ছি তাহিতি ভাষার পত্রলেখা। শালিখের বাসরে বুনছি পানকৌড়ির ডানা! সৎ আর সত্যির পার্থক্য আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছে মুক্তির সর্বশিক্ষা অভিযান!
হুটহাট আত্মহত্যার কথা ভাবছি না আর।
মুক্তির আলেখ্য শেখাচ্ছে ধনমানহীন হরিয়াল। কথায় কথায় আর ছুরিবিদ্ধ নয়। হাতে কলমে শিক্ষা নিচ্ছি বৃক্ষ মৃত্তিকা মিলন উন্মুখ বাবুইবাসা! ধীরে হলেও একটু একটু পাঠ করতে পারছি এখন মুক্তির নীহারিকা!
রাতের প্রদোষে সে এসে দাঁড়ায় কখনো। কখনো সে হাতছানি লেখে বর্ষামঙ্গলের আয়নায়। জ্যোৎস্নাকুমার! বাঁধভাঙা সুর্মাবদ্বীপ। দুরন্ত তারুণ্যে ভরা সেকি শুধুই প্রেমিক?
বন্ধু? শত্রু? নাস্তিক? সে আসলে কে? রহস্যকাহনের সালতামামি? নয়নতারার অঙ্গার? ফিনফিনে নিষ্ঠুরতা? বঙ্কিমচন্দ্রের পয়ার? পূর্ণসীতা? নাকি দুষ্টুমির গাঁ ঘেঁষা বালক রাম? আকাশবাণীর মতো উৎফুল্ল আটচালা! বাঁশিবনে লুকায়িত বিশ্বপীরের দরগা! কষ্টিপাথরের তৈরি মিশনারি মঠ! তার কাছেই কি সন্ন্যাসী শিখেছে প্রব্রজা?
সমুদ্রবক্ষের মতো সর্পিল, ফুরফুরে প্রত্নকীর্তি! ছায়াধ্বনিতে কেঁপে ওঠে হৃদয়,ক্যানভাসে ফুটে ওঠে আমাদের কথা-না কথারা, তানের পুঁটুলি! প্রাণের অধিক পরাজগতের খামখেয়ালিপনা! আজ অবধি কেউ কবজা করতে পারেনি নিয়ন্ত্রণহারা মুক্তির সাঁ সাঁ!
পঞ্চমুখী কোহিনুর হয়ে সে আমাদের ক্ষুণ্ণ করে না কখনো, শোনায় শাসন এবং শোষণ! কখনো আবার আমরা তাঁর জীবনচর্চাকে মোহাব্বত ভেবে ভুলঘুড়ির মাঞ্জায় রাস্তা হারিয়ে!
বাংলাভাষায় লেখা পাঠশালার আদিগঙ্গা বইছে তাঁর কিরণে। কারণ আর অকারণের লাবডুব। কাঠচাঁপার কাছাড়জেলা শীতলপাটির গ্রাম! কোথায় সে নেই! পিপুলগাছের পুঁথিতে উলগোলা পরাগে, পরমাণুতে দরবেশের অলিতে! কোথায় সে নেই!
সে যেন আমার মেয়ে! মেধার ঝিলিক! বাঁ গালে টোল! হাসলে। না হাসলেও।
নামতা ভুল! অংক ভুল! কতো বকুনি যে আমার কাছে। আবার অভিমান পেলে আমার কোলেই লুকিয়ে, ফুঁপিয়ে! চোখে হারাই তাঁকে! সজনে ফুলের মতো আলো করে রাখে দিনরাত্রি! যখন তখন একতারাটি! দোতারার মতো গভীর মণি!
সর্বক্ষণ চোখে চোখে। স্পর্শ ফুরায় না। বারবার লিখি ঝর্ণার উড়ান। তবু ফুরায় না ঝাড়বাতির তুলি।ভোরবেলাটির মাথা ধুইয়ে, চুল শুকিয়ে অঝোর বিনুনী। তার হাসিকে সোয়েটার পরাই। পাছে ঠাণ্ডা লাগে, জ্বর আসে তাঁর স্বপ্নবাণীর।
প্রণাম করি তাকে, যখন প্রথম চাঁদ দ্বিতীয় পৃথিবীর পিঠে এসে বসে। হাজার ঊষার হারমোনিয়াম দিনশেষের মৃদঙ্গে বাসা বাঁধে! প্রতিটি নিঃশ্বাস ভিটেমাটির রূপো, রূপসী মাধবীলতা! পূর্ণপাঠ! আমার নিশ্চিন্তিপুর!
মুক্তি? তাঁর বাবার দেওয়া পদবী। বান্ধুলী? তাঁর মায়ের দেওয়া গরিমা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন