"আমায় মুক্তি যদি দাও বাঁধন খুলে" গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের ১৮৬ নং এই গানটির সঙ্গে কমবেশি সকলেই আমরা পরিচিত। যদিও রবীন্দ্রনাথের অনেক গান বা কবিতায় নানাভাবে মুক্তির উপস্থাপন আছে তবু এই বিশেষ গানটি নিয়েই যতো মাথাব্যথা। কেননা ঠিক এর পরের লাইনটিতে আছে মারাত্মক এক বিস্ফোরণ --- "আমি তোমার বাঁধন নেবো তুলে"। কেন মুক্ত হবার পরও কেউ পুনরায় অবরুদ্ধ হতে চান, এটা কি শুধুই লিরিকের খাতিরে নাকি এর পেছনে লুকিয়ে অন্য কোনো দর্শন বা ব্যপ্তি যা একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক(spiritual) ও বস্তুকেন্দ্রিক (material) ! এ যেন অনেকটা শ্রম বিভাজনের মতো বৌদ্ধিক (spiritual) এবং কায়িক (physical বা material)। যা-ই হোক, মুক্তির প্রসঙ্গ তখনই আসে যখন বন্ধনের প্রশ্ন থাকে। এ-বন্ধন নানা ভাবে, নানা কিসিমে। কি শিল্পে, কি সাহিত্যে, কি মানসিকতা, জীবনের সবদিকেই পরিব্যপ্ত। যাকে কেন্দ্র করে শিল্প, সাহিত্য, চিন্তাভাবনা প্রভৃতির মুক্তি ধারণা গড়ে উঠেছে। আর ভারতীয় দর্শনে তো মুক্তি একটা ইজম বা মতবাদ হিসেবেই সুপরিচিত। দুজন কবির দুটো পংক্তি দিয়ে আলোচ্য ওই দু-ধরণের মুক্তির উদাহরণ টানা যেতে পারে। প্রথম উদাহরণ হিসেবে এখানে অবশ্যই "আমার মুক্তি আলোয় আলোয়"— রবী ঠাকুরের গানের পংক্তিটি যেমন উল্লেখ্য তেমনই দ্বিতীয়টি কাজী নজরুল ইসলামের "আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী ছল করে দেখা অনুক্ষণ"— কে রাখাই যায়। সর্বোপরি "মুক্ত বেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতর বঙ্গে/আমরা বাঙালী বাস করি সেই তীর্থ বরদ বঙ্গে"— কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-র আমরা কবিতাটি তো আমাদের এই সমগ্র বাংলাদেশকেই যেন বুকে ধরে আছে।
বাস্তবে আদও কি মুক্তি বলে কিছু আছে না তা পাওয়া যায়? এ প্রশ্ন হয়তো সর্বজনীন। তবু যখন একটা শাসন বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে আর একটা ব্যবস্থায় পৌঁছুনো যায় তখন তা কি আদপেই বন্ধনহীনতা! অথবা এক দেশ থেকে অন্য এক দেশে পাড়ি দেওয়া, এমনকি মানসিক এক স্তর থেকে অন্য স্তরে থিতু হওয়া সত্যিই কি একটা গণ্ডি অতিক্রান্ত হয়ে আর একটা ঘেরাটোপে বদ্ধ হওয়া নয়! একটা পাখিকেও যখন খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিই আর দূর আকাশে তার ক্রমাগত মিলিয়ে যাওয়া দেখি আপাত দৃষ্টিতে তখন মুক্তির একটা মানে খুঁজে পেলেও মনে হয় একটা শূন্য অতিক্রম করে আরো বড়ো কোনো শূন্যে সে কি সত্যিই নিঃসীম হতে পারবে! কেন না সাধারণ ভাবে পরিচিত যে আকাশ, সে তো আসলে বায়ুমণ্ডল। বিভিন্ন গ্যাস ও জলীয় বাষ্পের সমাহার। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে চারদিক থেকে পৃথিবী নামক এই গ্রহটিকে ঘিরে আছে। সূর্যের সাতটি রঙের মধ্যে একমাত্র নীল রং ক্ষুদ্রতর তরঙ্গের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে তাকে নীলাভ দেখায়। আবার এই বায়ুমণ্ডলেরও পাঁচটি স্তর। তাদের পরিবেশ ও আয়তনও নির্দিষ্ট। সুতরাং তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া যায় পাখিটি আকাশে বায়ুমণ্ডলের কোনো এক স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে তাহলেও সে কি মুক্ত নাকি অন্য এক পরিবেশ বা পরিস্থিতির আবর্তে গণ্ডিবদ্ধ! আবার ভারতীয় দর্শনে আকাশ হলো জগতের পাঞ্চভৌতিক উপাদানগুলির মধ্যে পঞ্চম (ব্যোম)। তার নিচে চতুর্থ উপাদান বায়ু। ফলে ধরে নেয়াই যায় যে বায়ুমণ্ডলের পঞ্চম স্তর অর্থাৎ ট্রাপোস্ফিয়ারের পরের অসীম মাধ্যাকর্ষণহীন সেই শূন্যই আকাশ। ভারতীয় দর্শনানুসারে যা সর্বাপেক্ষা ডেলিকেট বা সুক্ষ্ম। কারণ অন্য উপাদানগুলির বাকি সবগুলিই শারীরিক পরিকাঠামোয় প্রত্যক্ষত অথবা অনুভূত। অথচ এই পাঞ্চভৌতিক দেহ গঠনেও তার আনুপাতিক হার শতকরা ছয়।
স্বভাবতই বিশাল ব্যপ্তি নিয়ে থাকা এই মুক্তি বিষয়টি যদি বন্ধনের বিপরীত হয়ে থাকে তাহলে বন্ধন কি সেই প্রশ্নটিও কিন্তু অনাবশ্যক নয়। উত্তর খুঁজতে আমাদের মহোপনিষদের শরণাপন্ন হতে হবে।"পদার্থভাবনাদার্ঢ্যং বদ্ধ ইত্যাভিধীয়তে"(২।৪১) অর্থাৎ দৃঢ় পদার্থভাবনাই বন্ধন। আর একটু এগিয়ে যোগবশিষ্ঠ রামায়নে এটি উল্লিখিত হলো "পদার্থবাসনাদার্ঢ্যং বদ্ধ ইত্যাভিধীয়তে"(২।৩৫।৩) যার মানে দাঁড়ায় শুধু পদার্থ ভাবনাই নয় তাকে কেন্দ্র করে যে বাসনা বা ইচ্ছা তাও বন্ধনস্বরূপ।
ফলে আমাদের কবিঠাকুরও বিভাস-বাউলে গান বেঁধে ফেললেন "এই কথাটা ধরে রাখিস মুক্তি তোরে পেতেই হবে/যে পথ গেছে পারের পানে সে পথে তোর যেতেই হবে" (গীতবিতান,পূজা পর্যায়, ১৯০)। তা তিনি যখন গান বাঁধলেনই তখন আমাদেরও মুক্তির সুলুকসন্ধানে আর কোনো বাধা রইল না। পাণিনির কাছ থেকে আমরা জেনে গেলাম এই মুক্তি শব্দটির উৎপত্তি 'মুচ্' ধাতু থেকে যার অর্থ মোক্ষণ, মোক্ষ বা মুক্তি (অষ্টাধ্যায়ী ৭।৩।৫২)। বেদের দ্রষ্টারা বললেন এ মুক্তি অমৃত থেকে নয় মৃত্যুরূপ বন্ধন থেকে, কামনা-বাসনা থেকে।গীতায় দেখলাম পাপ থেকে মুক্তি; কর্ম, বন্ধন এবং সর্বোপরি দেহ থেকে। আর মহাভারতে বলা হল বাসনার নিবৃত্তিই মুক্তি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ে যা মোক্ষ, নির্বাণ, অর্হৎ, অপবর্গ, কৈবল্য, নিঃশ্রেয়স প্রভৃতি নানা সমার্থবোধক শব্দে পরিভাষিত।
মুক্তির প্রকারভেদ নিয়ে দর্শনশাস্ত্রে ইতরবিশেষ প্রায় একই রকম মত থাকলেও 'সুতসংহিতা' কিন্তু একে পরমামুক্তি এবং অবরা মুক্তি এই দুই ভাগে বিভাজিত করেছে। পরমামুক্তি জ্ঞানলব্ধ (মুক্তি), পরমার্থ বা ব্রহ্মে লীন হওয়া। আর অবরা মুক্তি চার প্রকার— (১) সালোক্য অর্থাৎ ইষ্ট বা অভীষ্টর সঙ্গে একই লোকে থাকা (২) সারূপ্য অর্থাৎ ইষ্টদেবতার রূপ প্রাপ্ত হওয়া (৩) সামীপ্য, অর্জুনের মতো ইষ্টের সান্নিধ্যে থাকা (৪) সাযুজ্য, অনেকটা ঘুমের মতো, গভীর নিদ্রায় যেমন বাহ্যিক কিছুই অনুভূত হয়না নিজের মধ্যে নিজেই মগ্ন থেকে যে সুখ পাওয়া যায় সেরকমই ইষ্টে নিমগ্ন থাকা। যেন রবীন্দ্রগানের সেই কলিদুটি "দেহ মনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে"। আর অবরা মুক্তিতে জীব আপাত মুক্ত হলেও ব্যক্তিত্ব ও অপ্রাকৃত দেহ, মন ইত্যাদি অবলুপ্ত না হবার ফলে শুধু ব্রহ্মসাম্য প্রাপ্ত হন মাত্র। দুর্গাদাস তর্কবাগীশ প্রণীত 'শব্দকল্পদ্রুম'-এ 'মুচ্' ধাতুর ব্যাখ্যায় মুক্তি আবার এরকম মানে পেয়েছে: বন্ধনরহিতীভাবে অকর্ম্মকোহম্ গজঃ কর্ত্তারিক্তঃ এবং পাপন্মুক্ত ইত্যর্থ: (কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ সংস্করণ, পৃ: ১০৪৩)।
মুক্তির সাতকাহন ঘেঁটে তাহলে কি শেষপর্যন্ত আমরা সংযমের পথ ধরে পঞ্চেন্দ্রিয়ের সব পথ বন্ধ করে বৈরাগ্য সাধনায় রত হবো নাকি এই পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, সুর, তাল, ছন্দ, লয় ইত্যাদির নানা বাঁধনে নিজেকে বেঁধে কবির মতোই উচ্চকিত হবো— "মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া,/প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া"(নৈবদ্য-৩০) তা ঠিক করার দায় কিন্তু আমাদেরই।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন