জন্মেমাত্র সুতো বুনতে বুনতে নিজের গুটির ভেতর নিজেই গুটিয়ে যাওয়া। গুটি কেটে বেরোনোর দম সব মথের থাকে না। যাদের থাকে, তারাও চির-কাটা, উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানোর মতো মুক্তিবেগ পায় না। অব্যবহিত পরেই অবান্তর ফাঁপিয়ে তুলে তুচ্ছ দৈনন্দিন ব্যস্ততা আর মৈথুনে লিপ্ত হয় এবং ইহায় চক্র। পাকেচক্রে জীবন।

একটা শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া, ক্রমে সেটা নিয়ে খেলার সাহস সঞ্চয় করতে করতে যখন খেয়াল করি, বড় দুঃসাহস হয়ে যাচ্ছে, শব্দটা আমার পক্ষে অসম্ভব বিশাল, সে-যাবৎ সঞ্চিত শক্তি ও পুঁজি সম্বল করে ভেতরে প্রবেশ করা বাতুলতা,  তখন মাথা থেকে নামিয়ে রাখি সেই ব্রহ্মাণ্ড। তুলে রাখি। সেই মুলতুবি নিয়ে আবার কখনো বসা যায় যদি সেই ক্ষীণ আশায়। সেরকমই একটা শব্দ ছিল যুবক কালে, "মুক্তি"। তাকে দীর্ঘদিন সরিয়ে রেখেছিলাম। অনেক বড় শব্দ তো, দুহাতে আঁটছিল না। কেমন ভয়-ভয় ভাব জাগে। কিশোরকালে ভাগ্যের  হাতের নাগালে হঠাৎ ইয়াব্বড় প্রেম চলে এলে ভাবনা যেমন অবিশ্বাস্য, বুক ঢিপ ঢিপ, অনধিকার চর্চা মনে হয়। সেইরকম।

বড়রা, কিছু পরেই, মুক্তি আর স্বাধীনতার ফারাক বোঝাতে চাইল। কিছুটা যেন বুঝলাম। স্বাধীনতার মধ্যে দায়দায়িত্ব, অধিকার আর কর্তব্যের মাখামাখি একটা জবাবদিহি-সংকুল অবস্থা। মুক্তি আরেকটু উপরের ব্যাপার, যেটা যুবককাল আরেকটু দূরে সরে সরে যেতে থাকলে আরও স্পষ্ট হয়ে আসে। ভিতরের বিষয় তো, মুক্তি, বয়স একটু দড় না হলে ধাতে সয় না। সে তো বাহির থেকে তেমন দেখার জিনিস নয়, তুমি অংক কষে বুঝিয়ে দিতে পারবে না, যে, এই হলো গে মুক্তি! অনেকটা, "মাল নিজ দায়িত্বে রাখিবেন"। যার যার, তার তার। তোমার মুক্তি, আলোয় আলোয়,  তোমাকেই বুঝে নিতে হবে, আকাশটাও যেন তোমারই নিজস্ব হয়, এই হলো গে শর্ত। এক্ষেত্রে  কোনোও বিখ্যাত প্রকাশনীর সহায়িকা উদ্ধার করতে পারবে না তোমাকে।
ওই যে মন নামক একটা কিছু আছে না, যেখানে এই শব্দের মূল কারবার। এই শব্দ-মায়ার পিছনে কত হিমালয়, কত গঞ্জিকা, কত গৃহত্যাগ। শব্দটার চরিত্র বস্তুবাদী নয়। মুঠো করে ধরে কিছু পাওয়া যায়না এই শব্দের শরীর থেকে। অতিরিক্ত ফেঁপে ওঠা "ভাব", শব্দটা ছাপোষা মানুষের মরিচিকা।

তারুণ্যে, হাতে পায়ে বাঁধা লোহার বেড়ি ছিন্ন করে বেশ একটা মুক্তি ঘটিয়ে ফেলছে এরকম কাঠখোদাই প্রিন্ট দেখে মুক্তির প্রাথমিক অনুমান হয়। সেই প্রতীকী ছবির তাৎপর্য হয়তো আছে, থাকে। কেননা জীবনটা তো সংকেত আর রূপকের আর কল্পনার গুচ্ছ দিয়ে টিকিয়ে রাখা এক অলীক মায়া। স্বনির্বাচিত ছবির প্রদর্শনীর  ভিতর দিয়ে নিজেকে মুগ্ধ করে রেখে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু, রাজনৈতিক অভিপ্রায় "মুক্তির" মুখস্থ বুলি কপচে আর কিছু না পারুক, শব্দটাকে ডিক্লাসিফাই করে ছেড়েছে।
মানুষ যখন নিজের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বড় কোনও শব্দ বানিয়ে ফ্যালে, তখন শুধু সেই শব্দের দিকে নিরন্তর, নিরুপায় হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না, যদি সেই হাঁটা নেহাতই বস্তুতান্ত্রিক হয়। শব্দ তো নিজের ভেতরে অসীম, অক্ষয় এক ভাব নিয়ে নির্বিকার। মানুষ নানা যুগে, নানা সন্ধিক্ষণে সেই ভাবের সাথে নিজের অবস্থান বুঝে নিতে চায়। সময়ের চাহিদায় তাতে বারবার নবতর সংযোজন  ও বিয়োজন ঘটায়। "মুক্তি" শব্দটা, এইভাবে, আজ, আমার কাছে তার গোষ্ঠী-আবেদন হারিয়ে ব্যক্তিগত এক অভিপ্রায় নিয়ে প্রকাশিত হয়।

মানুষের সামাজিক ক্রমবিকাশ তার মন কে, তার দেনাপাওনা, ভালোলাগা মন্দলাগা, ন্যায়নীতির ধারণা এমন এক বহুপ্রশাখা যুক্ত জটিল বন্ধনে জেরবার করে রেখেছে - যা আবার কিনা এই সামাজিক ব্যবস্থার, উৎপাদনের, ভোগের, আরামের সুশৃঙ্খল পরিপাটি বন্দোবস্ত, যে মুক্তির ধারণাই এই প্রেক্ষাপটে হাস্যকর এক বিলাসিতা। মানব আজ শত দুঃখ কষ্টেও এই প্রকল্পিত ছকেই বেশি সাবলীল।

"সভ্যতার" এত আয়োজন সাজিয়ে, এত এত বন্ধনে নিজেকে বেঁধে এবং  সেই বন্ধনে স্বস্তিবোধ শিখে নিয়ে "মুক্তির" ইচ্ছে করে লাভ নেই। সমস্ত "ব্যবস্থার" বিষ  শরীর আর মন থেকে বিতাড়িত করে  আত্মাকে detox করতে পারলে তবেই মুক্তির দিকে যাত্রা সম্ভব। ... সমস্ত উত্তোলিত, ব্যবহৃত খনিজ কি  আমরা আবার পৃথিবীমায়ের গর্ভে  ফিরিয়ে দিতে পারব? পারব না তো? তাহলে মুক্তির কথা বোলো না! তথাকথিত সভ্যতার সমস্ত কান্না কি আনন্দে বদলে দিতে পারব? পারব না তো? তাহলে মুক্তি কী ভাবে আসবে?

এখন, "মুক্তি" শব্দটার ভাবগত গভীরতা একটু খাটো করে, তার অর্থাবনতি ঘটিয়ে যেটুকু হাতে থাকে, সেই অভিপ্রায়ের সন্তোষ সাধনে মানবের দ্বারা অদ্যাবধি বিকশিত বিজ্ঞান, আইন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর মানবিক গুণাবলীর যুক্তিপূর্ণ প্রায়োগই যথেষ্ট ফলপ্রসূ  হতে পারে। সেটা হবে মানুষের প্রতি মানুষের ও মানবেতর প্রাণীসমূহের এবং অবশ্যই প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণহীন এক নির্মল পরিকাঠামো বজায় রাখার দিকে নিরন্তর ভাবনা, বিচার ও বাস্তবায়ন। কিন্তু যত দিন গেল, আমি বুঝলাম, এই সমষ্টিগত সহাবস্থানের নিরিখে "মুক্তি" শব্দটা এক ধরণের বৌদ্ধিক অপচয়। "মুক্তির" ধারণা সমষ্টিগত চর্চার বিষয় নয় বলেই আজ আমার মত। সমস্ত ভালোমন্দ, চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে যেতে পারলে তবে ব্যক্তির কাছে মুক্তি হিসেবে চিহ্নিত ভাববিশ্বের দরজাটির খুব আবছা একটা ছবি ফুটে ওঠতে পারে বলে আমার ধারণা। অথচ, যা, হবার নয়। মূলত স্টেট অব মাইন্ড, সে এক গোপন, ব্যক্তিগত কুঠুরি। গুহ্য। লোকালয়ে অস্তিত্বহীন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন