কেউ দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিল মানে অনেকদিন ধরে ছাড়ব ছাড়ব ভাবছিল, সেই একগুঁয়ে বস্, কোলিগদের অসহযোগ, যাতায়াতের অসুবিধা নানা কারণ থাকে। অথবা বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, সামাজিক, পারিবারিক নানা বন্ধন থেকে মুক্তি সারাক্ষণ চেয়ে থাকি আমরা। মেয়ে বেজাতে প্রেম করেছে সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে তার পরিবারের কেউ একজন অনার কিলিং করে দিল। মুক্তি একেবারে হাতে গরম অনুষ্ঠিত হল।
খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেক সময়ে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জট পাকিয়ে গেলে মুক্তি চাই। এখানে একটা গজলের লাইন মনে পড়ছে ' গাঁটে অগর লাগ যায়ে তো ফির রিস্তা হো ইয়া ডোরি / লাখ করে কোশিশ খুলনেমে বক্ত তো লাগতা হ্যাঁয়'। দেখা যায় প্রতিদিনকার বিরূপ ঘটনা তুচ্ছ বা কারণসহ, প্রভূত মানসিক দ্বন্দ্ব থেকে ক্যাথারসিস হিসেবে মুক্তির ভাবনা উঠে আসে। আবার সমস্যা কোথায় কতখানি বিশ বাঁও জলে আছে তার উপরে নির্ভর করবে পার্টি,সমাজ , সমিতি, পরিবার থেকে পদত্যাগ, ডিভোর্স ইত্যাদি ঘটবে কি ঘটবে না। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দল বদলাবদলি করেন। কে কোন দলে যুক্ত হল আর কে কোন দল থেকে মুক্ত হল এই নিয়ে খবরের চ্যানেল আর কাগজরা উচ্ছ্বসিত আর জনতা উত্তেজিত।
আমরা বয়োবৃদ্ধ সিনিয়র সিটিজেনরা ভাবছি ঘরে ঘরে এত ডিভোর্স বেড়ে গেছে কেন। এর কারণের বেশিরভাগ হল স্বাধীনচেতা মেয়েরা স্বোপার্জিতা মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন। আছে পুনর্বিবাহ, লিভ টুগেদার, কখনো বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্তসম্পর্ক। টুঁটি চেপে ধরা দমবন্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি সবাই চায়। কেউ সুখি হয়, কারো স্বস্তি মেলে। দেশে উচ্চবিত্তদের ফলো করে স্টেপ বাই স্টেপ উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা। সিনেমায় গল্পে প্রথম কদম ফুল ফোটার উৎসব থেমে থাকে না। মা বাবারা বলেন সন্তানদের বিয়ে দিয়ে একপ্রকার মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু সঠিক মুক্তিলাভ হয় কি? আমাদের বাংলা সিরিয়ালগুলো এই সব নিয়ে কাজ করে। বিয়ে দেবার পরও তাদের সঙ্গে লেজে গোবরে জড়িয়ে যায় মা-বাবা। কখনো কন্যারা ঝড় মাথায় করে ফিরে আসে। নাতিপুতির মায়ার ঠেলায় মুক্তি দূরে সরে যায়। আমেরিকায় শুনেছি ব্যক্তিগত পিস্তল বন্দুকের ব্যবহার সে দেশের নাগরিকদেরকে মুক্তমনা করে রাখে। স্কুলবালকরা সহপাঠীদের মেরে ফেলে গভীরতম কোনো মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। প্রবলতম নাগরিক জীবনের দূষণের শিকার তারা। আমাদের দেশে রাজনৈতিক খুন হয় বেশি। আর চাকরি বাকরির অভাব বলে খুন করাটাই একটা পেশা হয়ে যায়। গুলিতে বারুদে কত মুক্তির আশ্বাস। লিবারেশন, বিদ্রোহ, মুক্তিসূর্য, ভারতবর্ষ মুক্তির এক নাম— গালভরা কথায় ছেয়ে যায় জীবন। রাজা যায় রাজা আসে। বোড়েরা পটাপট মরে। মঞ্চে মরা সৈনিকরা আর বেঁচে ওঠে না।
খালাস কথাটার সঙ্গে এসে পড়ে অবাঞ্ছিত গর্ভপাতের ইশারা। ইউটিউবে অসংখ্য শর্ট ফিল্ম। দেখাচ্ছে অন্য এক বন্ধুর আকস্মিক কাজকর্মের দ্বারা একজনের প্রেমিকা গর্ভবতী হয়ে পড়েছে, কিন্তু প্রেমিক খালাস করাতে রাজি নয়, সে দ্রুত মেয়েটিকে বিয়ে করে নিচ্ছে। যদিও স্বপ্ন পূরণের মতো লাগছে তবু তো ভাবছে ডিরেক্টর, গল্পকার, অভিনেতা ও দর্শকরা। কে জানে ঘটনাটা একদিন বাস্তবেও ঘটবে। অথবা ঘটে গেছে কোথাও না কোথাও। প্রাচীন ও ক্ষুদ্র স্বার্থের উপরে মনের মুক্তি প্রেমের মুক্তি। হয় তো নতুন প্রজন্ম নতুন করে ভাবছে।
সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়, অভিনেতা, গায়ক ,অভিনেত্রী, কবি সাহিত্যিকদের জীবনের ভাঙাগড়ার গল্প মুখরোচক হয়ে সাধারণ মানুষের হাতে এসে পড়ছে। এদের নিয়ম ওলটানো প্রেম, বিবাহ, বিচ্ছেদ, বয়সের ফারাকে বিবাহ, অধিক বয়সে বিবাহ ইত্যাদি দ্বারা তোলপাড়িত হয়ে যাই আমরা। এগুলো কি মানসিক মুক্তির পথ দেখায় না? গ্রুপে গ্রুপে তর্কবিতর্কের ঝড় আছড়ে পড়ে না? ম্যাগাজিন পত্রিকায় গেল গেল রব ওঠে না?
মানুষের দার্শনিক চেতনায় আস্তিকতা অনেকটা স্থান জুড়ে আছে। নাস্তিকরা কিন্তু পিছিয়ে নেই। তারাও ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। মন্দির, চার্চ, মসজিদের অনুশাসনকে প্রশ্ন করছে তারা। সাধারণত মানুষকে ধর্মের নামে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া, স্বর্গ নরকের ভাওতাবাজি ও অনুদান ভিক্ষা করা ইত্যাদি শোষণ থেকে মুক্তি পেতে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে গিয়ে মানুষ নাস্তিকতার মূল্য বুঝতে পারছেন। দাভোলকর, গৌরী লঙ্কেশদেরকে ভয় পেয়ে তাদেরকে মৃত্যু উপহার দিচ্ছেন দেশের লোক। সমাজে মুক্তমনা সাংবাদিক, ব্লগারদের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। কুসংস্কার থেকে বাঁচতে এই মুক্তিসংগ্রাম দরকার। ধর্মের নামে জাতিবিভেদের মূলোৎপাটন তো হয়নি সমাজে। অতএব দেখা যাচ্ছে নাস্তিকতা ও যুক্তিবাদ আত্মিক মুক্তির অপর নাম
যে কোনো মুক্তি অর্জনের জন্য ঝুঁকি নিতেই হবে। মানুষ রোগমুক্তির জন্য হাসপাতালে ভর্তি হন। এবার চিকিৎসার গণ্ডগোলে শেষমুক্তি এসেও যেতে পারে। মানুষ আসলে নিজের শরীর ও মন দুটোকেই চেনে না। শরীর ও মনের পারস্পারিক লুকোচুরি খেলায় বিধ্বস্ত মানুষ। রোগমুক্তি আর কী করে হবে। তা ছাড়া এখন লেজুড় হয়ে গেছে সঙ্গে পরিবেশদূষণ। মানুষের নীরোগ বা আরোগ্যলাভ এক কাকস্যপরিবেদনা।
নেশামুক্তির বিজ্ঞাপন দেখে দেখে চোখ পচে গেল। খবরে দেখি স্ত্রীদের হাতে নেশাড়ু স্বামীরা খুন হয়ে যাচ্ছে। কখনো একটি পরিবার নেশার কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি একান্তই কাম্য।
আছে আমাদের মুক্তিপণ আর পণমুক্তির দুর্ধর্ষ সব ঘটনা যা নিয়ে পুলিশ ফাইলস নামের একটি চ্যানেল চলে দূরদর্শনে। হারেরেরেরে করে চলছে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংপর্ব। অস্বাভাবিক এই অবস্থা থেকে ছাত্রছাত্রীদের মুক্তি মিলবে কোনো দিন? এখন সবরকম মানুষ ও নারী শিশু পাচার আর অপহরণ করা হয়। নিজের পরিবারের লোক আত্মীয় স্বজন কখন যে অপহরণ করে মুক্তিপন চেয়ে বসবে কেউ জানে না। পণমুক্তি এখনো বিলুপ্ত হয়নি। মস্তিষ্কের কোষে কোষে মরচে ধরে আছে মানুষের। বিবাহ যেখানে একপ্রকার ব্যবসা। নারীপুরুষের সম্পর্ক অস্থির দ্বন্দ্বময়। কেউ কাউকে এক তিল স্পেস ছাড়তে রাজি নয়। বন্ধনের মাঝে মুক্তির সাধনা আয়ত্তে আসেনি। তবে চেষ্টা চলছে।
সাংসারিক শোক-তাপ-জ্বালা-অপমান নানাবিধ পরাজয় অসাফল্য থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই আত্মহত্যা বেছে নেন। আমাদের মেট্রো রেল অকুস্থল হিসেবে বিখ্যাত। আবার আবেগের বশে নয় ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল মাথায় আত্মহত্যা করার জন্য কোনো একটা দেশ জনসাধারণকে স্বাধীনতা ও স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। চরম মুক্তি ইউথানেশিয়া নিয়ে নেট ঘাঁটাঘাঁটি করছি।
এ প্রসঙ্গে ওই চরম মুক্তি মানে পুরুষদের একসট্যাসি একধরনের মুক্তি যাকে কেন্দ্র করে সংসার কখনো কখনো রণাঙ্গনে পরিণত হতে পারে। অ্যানিম্যাল জগতেও তাই। দ্য ভিঞ্চি কোডের মতো এক মুক্তি। ওফফ। খুব, বিশদে গিয়ে লাভ নেই। এর লাভ লোকসানের হিসেব কবিতার খাতায় আছে। কেউ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি চাইছে। কেউ টাকার পাহাড়ে বসেও যন্ত্রণা পাচ্ছে।বোঝাই যাচ্ছে যে এত রকম মুক্তির মধ্যে কোন-না-কোন মুক্তি প্রবন্ধকার নিজেই চাইছে। না হলে মানবজন্ম বৃথা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন