এই আমি ও আমির ভেতর বেদনাজল টলমল করে। বুঝি পড়ে যাবে৷ সাথে সাথে বন্যা ঘোষণা করবে আবহাওয়া দপ্তর। তখন কত রুপোলী মাছ আসবে ঘুরতে, কত কলা-ভেলা উপযাচক হয়ে পিঠে হাত রাখবে৷ আমি হয়তো তখনও স্থির। তখনও শিখব আমি ভীষণ একা। এই পথ, এই বন্যা, এই রোদ সবার জন্যই বিস্তৃত। আমার জন্যও হয়তো, তবে আমি তাদের কেউ না। আমি আমারও কেউ না।
আজকাল মাঝে মধ্যেই মিছিলে হাঁটি। চারপাশে কালো কালো পোশাকের লোক। কারোর হাতে মোমবাতি, কারোরও বা পোস্টার। পোস্টারের লেখাগুলো হঠাৎই ঝাপসা হয়ে যায়। তখন শুনি নুপুরের শব্দ। কি জানি কোথা থেকে আসে। নুপুরের শব্দে অনেক ধুলো থাকে, অনেক স্মৃতিও। মনে পড়ে একদিন তুমি কথা দিয়েছিলে নিজে হাতে নুপুর পরিয়ে দেবে৷ বিশ্বাস করেই বইয়ের পাতা উল্টেছি। ছাপা অক্ষরে সে সব নথিভুক্ত করেছি। বুঝিনি তা ধুলোয় চাপা পড়ে যাবে। কত কীই তো চাপা পড়ে যায়। নুপুরের শব্দ, কথার গভীরতা। ভুরি ভুরি হিসেব এসে জাঁকিয়ে বসে৷ মিছিলের শ্লোগানে মোমবাতির দল বিদীর্ন হলে নিজেকেই জিজ্ঞেস করি 'খুব কি প্রয়োজন এই হিসেবের?'
আমার ভেতর থেকে সেই আমি বেরিয়ে আসে। ভুলে যাওয়া ধ্যানের মন্ত্রে টুক করে আগুন জ্বালিয়ে মনে করিয়ে দেয় আমি কতখানি নিজের বৃত্তের কতখানি প্রসস্থ আমার ছায়া। চার পাশে লোকের শেষ নেই। চারপাশে তোমার শেষ নেই।
ঘোর ক্যামোফ্লাজ। বলতে পারো মুক্তির পথ? কত বারই তো ভেবেছি মুক্তির পথে নির্বাসন নেব, তাও তোমার হাত ধরে। পাখি ইশারা করেছিল, এই পথ নৃত্য মঞ্চের। শুধু নেচে ওঠার আগে চোখ বুজে আসে৷ স্বপ্নে দেখি হাজার হাজার রঙিন আলোয় মোড়া দীর্ঘ পথে আমি, শুধুই আমি— বড্ড একা। নাটকের সমস্ত ধুন কেমন যেন বিষাদ অপেরা হয়ে বাজে। টের পাই ঘুমন্ত সরিসৃপ জেগে উঠছে। তাতে কি? সমস্ত ইশারাতেই ঘোর অন্ধকার থাকে। অন্ধকারও যে আমারই মতন একা।
আসলে সকলেই একা। তবুও ভিড় জমে রাস্তায়। ভোর হতে না হতেই বেহালাবাদক এসে দখল নেয়। আমার বিষণ্ণ রুমাল ভেজা অবস্থায় পড়ে থাকে মাটিতে৷ শরীরের ভেতর রবিঠাকুর গান লিখছেন আর কে যেন প্রতিটা শব্দের পর পরই ঘড়ি বসিয়ে দিচ্ছে। তারা সাইকেল চড়ে এসেছিল। সেগুলো রাখা আছে আমার বাঁদিকের কলকব্জার কাছে৷ মিস্ত্রি নেই। কাউকে পুষিওনি। তাই এতো জল। বেদনাজল। জোনাকজল।
— জল পেরিয়ে ঘাটে পৌঁছলে অপূর্ব দৃশ্যের মতো দেখা যায় তৎপর বিকেলগুলো— মা-কাকিমাদের শাড়িতে রোদ এনে দিচ্ছে, ব্যস্ততায় কোন ঘাটতি নেই। এদিকে আমি কেমন যেন ফুরিয়ে যাচ্ছি সন্ধ্যার বাতাসে৷ আমি যে চিরকালের হা-বসন্ত৷ দূর থেকে পাখি দেখে ভাবি আমার হাত ধরার জন্য যারা হাত বাড়িয়েছে তারা শুধু রঙিন পালক কিংবা আশ্চর্য ফড়িং। এই আছে এই নেই। প্রতিটা 'নেই' এর সাথে আমি ঋদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাই মুক্তির দিকে৷ পথ বড় একার।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন