হে পাঠক, হে আমার শূন্য দশক, মুক্তি'র সন্ধানে আমার ইচ্ছার অভিবাদন গ্রহন করুন। উনিশশোসাতচল্লিশে সেই ডানা কাটা স্বাধীনতার  ষোলো বছেরের পর আমার জন্ম। এক অন্ধকার গর্ভের জরায়ু ছিঁড়ে পৃথিবীর মাটিতে এসেছিলাম। বিশ্বাস করুন, আজকের মত কোনও বোধ বুদ্ধি বিবেক চিহ্নিত হবার সময় ছিল না তখন। শুধু এক সিস্টেম থেকে স্যারাউন্ডিংসে এসে পড়েছি মাত্র। বলাবাহুল্য ওই স্যারাউন্ডিংস তখন সিস্টেমে রূপান্তরিত হয়েছিল। এত আলো উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনি যে, ভয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। 
সে-সব কাহিনি গর্ভধারিনীর মুখে অনেক পরে শুনেছি। 
এই যে জন্ম, অন্ধকার থেকে আলোয় ছিটকে-পড়া, ইহা কি মুক্তি? না, মুক্তির এক বিশেষ রূপ মাত্র। ওই রূপের টানেই বিশ্ব সংসার। বলতে দ্বিধা নেই, মহাবিশ্বে কোথাও মুক্তি নেই। প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে ইন্টার রিলেটেড। এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা লেখালেখি হয়েছে কিংবা হচ্ছে। হয়তো হবেও আগামীকাল। 
বস্তুত আমার আলোচ্য বিষয় মুক্তি। প্রথমেই প্রশ্ন আসে, ক্রিয়াধাতু √মুচ্ (মোচন) + ক্তি প্রত্যয় যোগের ফলাফল কি মুক্তি? সম্ভবত হ্যাঁ। অবশ্য আরো অনেক সমার্থক নাম ব্যাকরণে ঠাই নিয়েছে। বলা যায় মুক্তির বহুরূপতা।
তো যা বলছিলাম, মুক্তি শব্দটি আসলে ভাবের ঘরে চুরি। আপেক্ষিক অনুভূতি। পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের ইন্টিগ্রাল পরিণাম। এই যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পৃথিবী নামের গোলাকার বল, সে নিজেই মুক্ত নয়। একটু এদিক ওদিক হয়েছি কি সব্বোনাশ। বস্তুজগৎ + প্রাণীজগৎ এর সব সমীকরণ উধাও। মানবদেহ ভাঁড়ে মা ভবানী। বাস্তবিক কেবলি অনন্তে ভাসমান ধূলিকণা। এরোসল। কেবলি ছুটছে। আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল কেউ নেই। বিজ্ঞানে বলে, এ হল মুক্তিবেগ। কক্ষপথ ছেড়ে বেরিয়ে যাবার বেগ। 
বাস্তবে পৃথিবীর ক্ষেত্রে মুক্তিবেগ ১১.২ কিলোমিটার/সেকেন্ড। চাঁদের দেশে ওই বেগ মাত্র ২.৪ কিলোমিটার/সেকেন্ড। এবার পাঠক ভাবুন, ওই বেগ কি এক্সটারনাল ফোর্স ছাড়া মানুষ সহজে পায়, না-পাবে কোনদিন? তর্কে যদিও বা সম্ভব, মানুষের শারীরবিদ্যায় ধারণ করার ক্ষমতা নেই। কেন? ওই যে, মহাশক্তির টান আছে না। মুক্তি কি কথার কথা। বললেই হল। ভাবের ঘরে ঢুকে জীবনানন্দকেও বলতে হয়েছে। সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী। যে তত্ত্বই বলি না কেন এও এক টান। মায়ার বাঁধন। 
অবশ্য ভাবজগতে ঢুকলে তো কথাই নেই। তার ভাষাই আলাদা। চলনে বলনে যেন খই ফুটছে। মূলত আমরা কেউই মুক্ত নই। মুক্তিও নেই। বাঁধন ছাড়া কারোর মুক্তি নেই। হরিদ্বারে এক গুহার ভেতরে বসে সাধুবাবা বলেছিল, তাও পাইথন সাক্ষী রেখে। দেখে হাড় হিম হয়ে গেছিল।
- মায়ার বাঁধন থেকে মুক্তি অত সহজ নয় বেটা। তপস্যা করতে হয়। 
- তপস্যাও তো বাঁধন।
- তুমি ছেলেমানুষ। এ জগৎ তোমার নয়। 
- আপনি স্ত্রী পুত্র ছেড়ে এলেন কেন বাবা?
- মুক্তির খোঁজে। 
- পেয়েছেন?  
- না। 
- আপনার বেঁচে থাকার জন্য যে শক্তি (মানে খাবার টাবার) দরকার কে যোগান দিচ্ছে বাবা?
- সবই প্রভুর মায়া। জীব দিয়েছেন যিনি আহার যোগান তিনি। 
বোঝ ঠ্যালা। এ যে নিরাকার শক্তির কথা শুনছি। চোখে দেখছি না। অথচ চলছে।
-এখানেও তো আপনি প্রভুর বাঁধনে আটকে আছেন। কোথাও কি মুক্তি নেই?
- ওরে পাগল৷ ওই টানেই তো নিজেকে জানার জন্য হরির দুয়ারে ছুটে এসেছি। নিজের স্বরূপ চিনলেই মুক্তি। 
মনে মনে বলি, নিজেকে জানা। মানে অহং এর অ্যাবসোলিউট ফর্ম। সে তো পরমহংস। জানলে কী হবে? একদিন ব্রহ্মাণ্ডে উড়ে যাবে সব। 

সাধে কী রবিঠাকুর বলেছেন - মুক্তি, ওরে মুক্তি কোথায় পাবি মুক্তি কোথায় আছে/আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন পরে বাঁধা সবার কাছে। কিংবা ধরুন, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়৷ ভাবজগতে এই সব খেলা আকছার চলে। তিনি সতত জানতেন - বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়। বলাবাহুল্য স্বাধীনতাও (স্ব-অধীনতা) যে এক বিপরীত বাঁধন। কেন বলছি? বস্তুত বাধ্য হচ্ছি। শিরা ও ধমনি ছাড়া রক্তের অস্তিত্ব নেই। সাইক্লিক অর্ডারে বয়ে চলেছে। অন্তর্জগতে চোখ রাখলেই টের পাওয়া যায়।

ধরা যাক, ইংরেজদের শাসন থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। বেশ। 
তাদের যাবতীয় অমানবিক কর্মের বাঁধন থেকে লড়াই ও রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে অর্জন করেছি ঝমঝম স্বাধীনতা। 
বেশ বেশ। ভালো কথা। কথার পৃষ্ঠে কথা চাপিয়ে কবির ভাষায় বলা যায় কি, “আমরা সবাই মুক্ত এবং স্বাধীন। কাজেই এখন ইচ্ছেমতো ঘুরি” 
আদপে সত্যি নয়। সর্বৈব মিথ্যে। 
যদি তাই হতো, তাহলে দেশে এতো খুন, ধর্ষন, রাহাজানি, হত্যা, চৌর্যায়ন, আজও হয় কেন? এতো হাহাকার, অন্নহীনতায় মৃত্যু হয় কেন? মুক্তি পেলে তো হিংস্রতার জন্ম হতো না।

সত্য এই যে, আমি বা আমরা কেউ-ই মুক্ত নই। এক খাঁচা থেকে অন্য খাঁচায় ঢুকে পড়ছি। মূলত সিস্টেমের হাত বদল। যে খাঁচায় আছি সে খাঁচার বিরুদ্ধে বলার সাহস নেই। আগেও ছিল না। যারা মুক্তির কথা বলেছে তারা মরেছে। আর যারা মরেছে তারা সকলেই ব্রাত্য এখন। কেবলই বাৎসরিক উৎসব। শহিদ স্মরণে আপন মরণে রক্তঋণ শোধ করো। 

(স্বগোতক্তি), 
বালাই ষাট। নিজে মরতে যাব কোন দুঃখে। আমি ক্ষুদিরাম নই বাবা। বউ বাচ্চা আছে না। এও এক টান। বিপরীতমুখী স্রোত। অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, সামাজিক সব দিকেই বাঁধন। পৃথিবীর আটশো কোটি মানুষের মধ্যে মৃত্যু ছাড়া কোন মানুষ মুক্তি পেয়েছে। আমি জানি না। সে কি মাধ্যাকর্ষণ বল পেরিয়ে ছুটে গেছে অন্য কোথাও। যার স্বরূপ কেউ জানে না। হেথা নয় হোথা নয় অন্য কোনোখানে। 
অতএব ইহাও মুক্তি নয়। 

কেউ কেউ বলেন আত্মানাং বিদ্ধি। আত্মার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। নশ্বর পৃথিবীতে আত্মা অবিনশ্বর। ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। আত্মা কোথায় থাকে। দেহে থাকে। লালন সাঁই বলেছেন—* খাঁচার ভিতর অচিন পাখি। কেমনে আসে যায়। কেমনে মানে? জানি না। শুধু দেখি শক্তি শেষ। অচিন পাখিও ফুড়ুৎ। 

আমার বোধে, আত্মা মানুষের পিওর কনসাশনেস। জাইগোট ফরমেশনের পর থেকে যখন সে পরিবেশে পৃথিবীর ফোটনকণা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখনি তার সময়ের সাপেক্ষে ডিগ্রি অফ কনসাসনেস বাড়তে থেকে। রামকৃষ্ণের বচনে বলি, চৈতন্যলোকের আয়তন ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। চেতনার অরবিট অসীম। অসীমে স্থিতিশক্তির মান শূন্য। বরং কোন অরবিটে পৌছলে অহং উপলব্ধির চরম সীমায় ধাক্কা মারে। ধন্দ লাগে। বিষম খাই। 

যিনি বলেন আত্মার মৃত্যু নেই, তিনি কি দেখেছেন মৃত্যুর পরবর্তী কোনও আত্মা এসে আমাদের বাস্তবিক সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করতে? আত্মা যদি দেহে থাকে, সেখানেও বায়োলজিকাল বাউন্ডারি থাকতে বাধ্য। তাহলে মুক্তি?  
মুক্তি কোথাও নেই।

একটু অন্যভাবে ভাবা যাক। ধরুন, একটি মানুষ। পৃথিবীর একভাগ স্থলের এই ভুবনডাঙায় একটি  বিন্দু। তার স্পেস আছে। গোলাকার ধরলে তার পরিধি আছে। ক্ষেত্রফল, আয়তন, ঘনত্ব আছে। পাশাপাশি আরেকটি বিন্দুর কোহেসিভ ফোর্স আছে। এমনকী প্রাণীজগতের সাথেও আছে। যদি তা না-হতো, মানুষ মানুষের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতো না। এটাও এক ইমাজিনারি দেয়াল।

আসলে বাস্তবে যে মুক্তির কথা ভাবি তা হল খণ্ডকালের প্রতিফলিত ছায়ামাত্র। জনশ্রুতি অনেক শুনেছি। সংসারে খেটে খেটে হাড়মাস কালি হল, কবে যে মুক্তি পাব? তার মানে কি, কাজ না-করা? মূলত স্ট্রেস রিলিফ। যা জীবনের জন্য প্রয়োজন কিন্তু কখনোই অবিরাম, কাম্য নয়। এটা হলপ করে বলতে পারি। 
যন্ত্রণা, অভাব/দারিদ্র্য, অত্যাচার, শাসন, শোষণ, রোগজ্বালা ইত্যাদি থেকে অব্যাহতি পেলেই বলি— যাক বাবা, মুক্তি পেলাম। 

হে পাঠক, আপনারাই বলুন জড় ও জীবের বাঁধন থেকে ছাড়া পেলাম কি? ভাবের ঘোরে অনেক কিছুই ভাবা যায়। নেপচুনে থ্রিবিএইচকে ফ্ল্যাট বানানো যায়। বহির্জগতের তর্জনিকে (শাসন ক্ষমতা) সামাল দেওয়া যায় না। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে যা দেখি সত্য। তবু শেষ সত্য নয়। কেন-না, রণ-রক্ত-সফলতা সত্য হলেও শেষ সত্য নয়।
পৃথিবীর যে কোনো প্রাণী (মানুষ, জীবজন্তু এমনকি ব্যাকটেরিয়াও) সাম্যাবস্থায় থাকতে চায়। এর বিরুদ্ধাচারণ করলেই তার প্রতিক্রিয়া শুরু। কোথাও রেহাই নেই। ঘরে বসে, নান্দনিক চিন্তার অন্তর্জাল বিছিয়ে যতই ফ্যান্টাসির কথা ভাবি না কেন, বাস্তবে পায়ের তলার মাটি সরে গেলে মুক্তির নামগন্ধ আসবে না। 

অব্যাহতি, নির্বাণ, আরোগ্যলাভ সবই মুক্তির রকমফের। কোনোটাই প্রকৃত মুক্তি নয়। পৃথিবীর যে প্রান্তেই অবস্থান করুন না কেন বাঁধন ছাড়া মানুষের দ্বিতীয় কোন সত্ত্বা নেই। ইদানীং মুক্তির কথা বললেই মনে পড়ে খুব। টু ডু সাম ইউজফুল ওয়ার্ক।



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন