শূন্যে ফেরিওয়ালা বৃত্তে বেলুন 

পর্ব -১২


দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন হয়ে গেল আমি পুনেতে থাকছি। সবকিছু গুছিয়ে বসতেই বেশ কিছু সময় গেছিল। এর মাঝেই আবার বর্ষার বিপত্তি। আজকের কথায় লিখি, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছি যেমন রোজই উঠি প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, কিন্তু সকাল হচ্ছিল কী হচ্ছিল না সেই বিষয়েই অবাক হয়েছি। আসলে পশ্চিমে সূর্য একটু দেরিতেই ওঠে। কিন্তু যখন একটু একটু আলো পড়ছে, দেখছি মেঘ একদম নিচে নেমে এসেছে। মহারাষ্ট্রে এরকম বৃষ্টি আমি আগেই দেখেছি। সামনে পাহাড়গুলো মেঘে ঢেকে গেছে, বেশ কিছুটা ফাঁকা জমি যেখানে টুকটাক চাষাবাদ হয় সেগুলো জলে ভরপুর। হঠাৎ করে খুব শীত করছিল। এখানে কিছুদিন ধরে এত বাতাস দিচ্ছিল ঠান্ডা বাতাস যে কারণে সারাদিনই প্রায় শীত শীত লাগতো, তারপরে এত বৃষ্টি। 

এরকম বৃষ্টির দিনে বড্ড অলস হয়ে যাই, বসে বসে ভাবি সাহিত্য করতে এসে কত কী করতে পারতাম অথচ অলসতার ফাঁদে কেমন জড়িয়ে পড়েছি। বাংলা থেকে এত দূরে জীবনে যা-ই থাকুক সাহিত্যের সিঁড়ি বেশ দুর্গম। তাও যেখানে সৃষ্টি ছাড়া থাকতে পারিনা সেখানে সৃষ্টির হাত ধরেই থাকতে হয়। দুপুরগুলোতে আজকাল ভীষণ প্রভাত চৌধুরী পড়ি৷ যে কারণে, শব্দের নানান ধরণের প্রয়োগ আমায় ভাবিয়ে তুলেছে। গত উনিশে জুলাই মায়াকোভস্কির জন্মদিন ছিল। ভাবছিলাম, আজ থেকে কত বছর আগে উনি কী সহজে অনেকটা সাহস নিয়ে বলেছিলেন, যে ভাষায় এতোকাল লেখা হয়েছে সেই ভাষায় আর লেখা হবে না। নতুন ভাষায় লেখা হবে৷ যে কথা আজ আমরাও বলে থাকি। কবিতার ধরনকে বদলাতে সাহিত্যের ধরনকে বদলাতে বর্তমানে আমাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রভাত চৌধুরী দেখি ঠিক কথাই কিন্তু এ কথা বহু আগে থেকেই প্রচলিত। সেই যুগে যখন মানুষ ভাবতে পেরেছিল কবিতাকে বদলাতে হবে। তার মানে এটা বুঝতে হবে ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি অনেকটাই সময় থেকে এগিয়েছিলেন। 

আজকাল সময়ের সাথে সাথে ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেছে, কবিতা নিয়ে মাতামাতি আছে সাথে নানান প্রবন্ধেরও কাজ করছি। প্রবন্ধ লিখতে কি অনেক কিছু জানছি ঠিক কথাই তা আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করছে, শক্তি বৃদ্ধি করছে, কিন্তু প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করছি না। তবে আমি মনে করি এই যে জ্ঞান এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি তা আমার আগামী সাহিত্য যাপনে অবশ্যই বিরাট ভূমিকা পালন করবে। 

এইসবের মাঝেও বেশ কিছু মানুষ জীবনে আসছে যাচ্ছে আর জীবন বারবার করে শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকাটা মৃত্যু পর্যন্ত পৌঁছানোর একটা পথ, সেই পথে নানান বন্ধু আসে, তারা চলে যাবার জন্যই আসে। আমি কিছু করলেও তারা চলে যাবে কিছু না করলেও তারা চলে যাবে। এই থাকা বা চলে যাওয়ার মাঝে মানুষের যে কত রকম রূপ তা দেখি। আমরা যাকে যুগের হাওয়া বলি তা আসলে মানুষের ষড়রিপুর বাড়বাড়ন্ত। স্বার্থের বাইরে কিছু হলে বা সামান্য কিছু স্বার্থকে আঘাত করলে তখন দেখা যায় তার রূপ। নিজেকে চারজনের কাছে ভালো দেখানোর জন্য মানুষ অন্যকে ছোট করতেও পিছু পা হয় না। একি মনুষ্যত্ব?  না এ-মনুষ্যত্ব নয় এ হলো লোভ। আমি দেখেছি যে সমস্ত মানুষ নিজেকে বড় মাপের মানুষ ভাবে এবং বিত্তবান মনে করে তাদের মধ্যেই আছে অন্ধকার। সেই অন্ধকার ঢাকতেই হয়তো তাদের গলাবাজি করতে হয়। সংকীর্ণতা আসলে আয়নার সামনে ঝুলতে থাকা ব্যবহার করা টিপ। না চাইতেও সে থেকে যায় দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর। 

বেশ কিছুদিন যাবৎ একটা অদ্ভুত বিপত্তি আমি দেখেছি, কবিতার জগতে কিছু নতুন মুখ জুটেছে যারা নিজেকে সর্বজ্ঞ মনে করে।  তারা এটা মানতেই চায় না যে তাদের জানার বাইরেও অনেক জানা রয়েছে। এই যে সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিজেকে আটকে রেখেছে এই সীমাবদ্ধতা কোনদিন আলোমুখি নয়। এতে ধীরে ধীরে ফাঙ্গাস জমে এবং ইনফেকশনও হয়ে যায়। কখন যে মানুষের শিকড় অসুস্থ হয়ে পচে যায় সে কথা হয়তো তার ছায়াও টের পায় না। 

এই ধরনের অভিজ্ঞতা যত বাড়ে তত নিজেকে ভিড়ের থেকে সরিয়ে নিতে মন চায়। এর থেকে ঢের ভালো নিজের মতো করে ছবি আঁকি কবিতা লিখি বইয়ের মধ্যে বুঁদ হয়ে ডুবে থাকি। 

ভাগ্যিস ভুবনডাঙায় এই ধারাবাহিকটি লেখার জন্য জায়গা পেয়েছিলাম, যে কারণে নানান কথা চাই বা না চাই লিখে রাখি। আসলে সত্যের উপলব্ধি কখনোই মিষ্টি হয় না। বড্ড তেতো লাগে। আর তেতো রক্তের পক্ষে উপকারী। এভাবেই ভালোলাগা ও মন্দ লাগার মধ্যে বেঁচে আছি। লিখতে লিখতেই আবার ঝড়-বৃষ্টি নেমে এলো। আবারো মুখের সামনেটা মেঘে সাদা হয়ে গেল। প্রকৃতি কি দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায় তাই না?  আর প্রকৃতির কোলে মানুষ সে তো আরো বেশি।


ক্রমশ...

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন