তপন বরুয়ার কবিতা

মূল অসমীয়া থেকে বাংলা অনুবাদ— বাসুদেব দাস



স্বদেশের আকাশের নিচের মানুষ

তোমরা সূর্য উঠা দেশের মানুষ
সূর্যের সঙ্গে জেগে  উঠতে না পারার কারণ কি
ঘুরতে না পারার কারন কি
ঘড়ির কাঁটার লয়-ছন্দে?

তোমরা সবুজ দেশের মানুষ
সবুজ বসন পরতে না পারার কারণ কি 
মনের মলিনতা মুছে নিজেও
 সবুজ হওয়ার?

 তোমরা খনিজ খচিত দেশের মানুষ
 অন্ধকারের সঙ্গে খেলতে না পারার কারন কি
 অন্ধকার  ঘিরে থাকা ঘরটা
 আলোকিত করতে না পারার কারণ কি?

জয়ের সঙ্গে
নাম খোদিত করা মানুষ তোমরা ,
যে জয় ছিল এই মাটির
পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে তাহলে কেন
ধর্ম, দুর্নীতি, সহজ ধন অর্জন,
নিদ্রার অভিনয় করা নাটক এবং মিথ্যা বক্তৃতা পর্যন্ত
শিকড় আজ অন্ধকারের কবলে।

 তোমরা স্বদেশের মানুষ
 যাকে নিয়ে দেশ গর্বিত
 যাকে নিয়ে তোমরা গর্বিত
 নিজের মাথার উপরে আকাশ পর্যন্ত
 ভালোভাবে দেখতে না পারার কারণ কি?

কারণটা কি
কিছুক্ষণ নিজের
মুনাফা ভুলতে পারবে না

‘আমরা স্বদেশের আকাশের নিচের মানুষ’- -
কেবল মুখে বললেই হবে না।





সময় আজ মানুষকে মানুষ বলে বলার

(বিশ্বের প্রতিটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির হাতে)
আমি যখন তার বুকের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখি 
আমি যখন তার হাতে কিছুক্ষণের জন্য নিজের হাতটা রেখে দেখি 

বুকটাকে বলতে শুনি–তোমার মতোই 
আমারও স্বপ্ন আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে;
হাতটাকে বলতে শুনি–আমারও তাপ আছে উত্তাপ আছে, অনুভবের উষ্ণতা আছে। 

আমি যখন রেলগাড়িতে ভ্রমণ করি 
হঠাৎ দেখা হওয়ায় তাদের বলতে শুনি–
আমারও একটি সুন্দর কন্ঠ আছে, কণ্ঠস্বর আছে 
বলতে শুনি, চোখ না থাকলেও 
আপনাদের দেখতে পাওয়ার আমার চোখ আছে 
কানে না শুনলেও রেলের উকি 
সময়ের উকি শোনার আমার কান আছে। 
‘দিন বাবু, পা দুটো না থাকলে কী হবে
আপনার জুতো জোড়া পালিশ করার জন্য 
দুটি হাত আছে।’
আবার কখনও কাউকে বলতে শুনি–
‘বাবু, হাত দুটি রেলে কাটা পড়েছে বলেই বেঁচে 
থাকবো না নাকি, দেখবেন নাকি স্নান করা থেকে 
শুরু করে 
দুই পায়ে কী কী করতে পারি ?’

আমি যখন তাদের বুকের মধ্যে দেখার চেষ্টা করি 
দেখতে পাই তারাতো দেখছি  আমাদের মতোই
হাসে, আমাদের মতোই কাঁদে, আমাদের মতোই কথা বলে। 

আমি যখন তাদের হাতে হাত রাখি 
অনুভব করি তাদেরও তো দেখছি আমাদের মতোই
স্পর্শানুভূতি;
আমাদের মতোই শিহরণ-উত্তাপ।

আমার মায়ের প্রতি আমার যতটুকু ভালোবাসা 
তাদের মায়ের প্রতিও তাদের ততটুকুই ভালোবাসা 
তাঁরাও জানে জন্ম এবং মৃত্যুর কথা 
তাঁরাও জানে জীবন সংগ্রামের কথা।

পার্থক্য তাহলে কোথায়, 
প্রভেদ তাহলে কোনজায়গায়?

তাঁদের হয়ে আজ কে বলবে–
এখন সময় নেতিবাচক ধারণা গুলি বাদ দিয়ে চলার 
সময় এখন তাঁদের স্বাবলম্বী করে তোলার 

সময়–বৈষম্য দূর করার 
সময়–সমমর্যাদা, সম অধিকার তাদেরকেও দেওয়ার 
সময়– মানুষকে মানুষ বলে বলার।।






হারিয়ে যাওয়া মানুষটার সমাধি


হারিয়ে যাওয়া মানুষটার সমাধিতে সে বার-বার যায়  এবং 
প্রতিবারেই চোখের জল ফেলে।

তুফান ছুঁয়ে যাওয়া সমাধি
ভূমিকম্প কাঁপিয়ে যাওয়া সমাধি
ব্যস্ত নগরের অন্ধকার-আবর্জনায় ঠিকানা হারানো সমাধি

একসময় যেখানে একগুচ্ছ গোলাপ 
খিলখিল করে হাসত সকাল বিকেল
এক ঝাঁক স্নিগ্ধ বাতাস সলতের তেল হয়ে 
না নিভিয়ে রেখেছিল স্নেহের প্রদীপ 

সেখানে সে বার-বার যায় 
আর আনে 
স্মৃতির ধুলো কুড়িয়ে।

তিনি আসলে সেই সমাধিতে যান 
যা অক্ষয়
কালের তুফান-ভূমিকম্প যার সামনে সম্ভ্রমে নতশির হয়
আর 
আলয় তাঁর হৃদয়।   
  






বয়স্ক পৃ্থিবী অনেক বসন্ত দেখেছে 

বয়স্ক পৃ্থিবী অনেক বসন্ত দেখেছে
অনেক গ্রীষ্ম অনেক শীত 
অনেক বৃষ্টি
আর সূর্যের মতো অনন্ত উৎসের প্রদীপ জ্বালিয়ে  
দ্রুত এগিয়ে চলেছে
কখনও শস্যভূমির দিকে 
কখনও রণভূমির দিকে 
কখনও উৎসবভূমির দিকে 

পরিবর্তিত ধাবিত প্রতিটি ঋতুতে 
স্বয়ং অপরিবর্তিত থেকে 
মুখোমুখি হয়েছে সময়ের।

বয়স্ক পৃথিবী বহু উৎসব বিভীষিকা  
শান্তি হাহাকার দেখেছে 
আসলে এই সমস্ত কিছুরই
সাক্ষাৎ হয়েছে একগাছা 
ছোট্ট প্রদীপের মতো মানুষ 
রাতে-দুপুরের ঘণ্টার এক একটি 
ক্ষীণ ধ্বনির মতো মানুষ
কঠোর শ্রমের তপস্যায় এক ফোঁটা ঘামের মতো মানুষ

যে নিজেই সোনালি শস্য হয়ে মাঠে মাঠে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে 
কখনও বা আগুন শিখা হয়ে রণভূমিতে নেমেছে
কখনও বা হিংস্র হয়ে বন্য পশুর মতো চিৎকার করেছে
আবার কখনও বা 
সকালের এক ঝাঁক বাতাস হয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বয়ে গেছে।

 বয়স্ক পৃ্থিবী অনেক বসন্ত দেখেছে
 আর প্রতিবারই
 এই বিমোহন সজ্জায় নিজেকে হারিয়ে 
 একাকার হয়েছে স্রোতে।







অন্ধকার পোড়ার কবিতা

তুমি জিজ্ঞেস করলে-কাল কী লিখলাম

কালরাতে 
অন্ধকার পোড়ালাম।

ভেতরের অন্ধকার বাইরের অন্ধকার 
প্রেমের অন্ধকার ঘৃণার অন্ধকার 
জন্মের অন্ধকার মৃত্যুর অন্ধকার 

কর্মা-কর্ম বিচার 
দিন ঢেকে ক্রমে ক্রমে বেড়ে আসা অন্ধকার
যা!জ্বলে যা অন্ধকারসূচক 
যত যা বিশেষ্য!

কালরাতে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়া কবিতাটিতে 
জোনাকি পোকার মতো একটা শব্দ হয়ে ঝল্মল করলাম নিজেরই চোখে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন