শীর্ষার কবিতা






একটি কবিতাসিরিজ 


১ 

ভালোবাসার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে আসে ভালোবাসা স্বয়ং এক মহীরুহ— বর্ষীয়ান, প্রাচীন বিগ্রহটির মতো। ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে যুগান্তর ধরে। তার ঠোঁট নড়ে, আমরা শুনতে পাই না। চোখের পলক পড়ে, আমরা দেখতে পাই না। কানে শোঁ শোঁ শব্দ হয়, আমরা বুঝতে পারি না। আমরা তার ডাল ভেঙে পুজো দিই, ফুল তুলে নিজেকে সাজাই, ফল পেড়ে পুষ্টি কিনে আনি। এভাবে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পৃথক করতে করতে তাকে মেরে ফেলি, তবু তাকে একটিবারও অনুভব করি না। ভালোবাসার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় এ সেই পাতালভেদী বৃক্ষটি, মাটির সঙ্গে যার অনন্ত গভীর প্রেম ছড়িয়ে রয়েছে এই পৃথিবীতে। আর সেই প্রেমেরই মৃত্তিকাগর্ভে ধারণ হচ্ছে নব নব প্রাণ। মানুষ যার রোমাঞ্চে শিহরিত হতে শিখল না আজও। মানুষ যার ছায়া নিতে শিখল না আজও।



২ 

প্রেমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে আসে এক ভাসমান নৌকোর কথা— চাঁদের রং নিয়ে যে সমস্ত আকাশ চষে বেড়াচ্ছে। তার মাটিতে বরফের বিচ্যুত কণা ফেটে বেরিয়ে আসছে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি। মানুষ উত্তেজনায় শুষে নিচ্ছে সেই পাতা-কুঁড়ির রস। আর চাঁদ এসে ঢুকে পড়ছে মানুষের মুখের ভেতরে। এভাবে চাঁদ খেতে খেতে চাঁদ খেতে খেতে মানুষ নিজেই হয়ে উঠছে ভাসমান সেই নৌকোটি। যার সমস্ত কায়া জুড়ে শুধুই সঞ্চিত তরল অমৃতের ছলাৎ ছলাৎ।





আদরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে আসে এক রাজহংসের কথা— গায়ে জল মেখে দিব্য ফুরফুরে রেখেছে নিজের স্নিগ্ধতাটুকু। ঠোঁটে থাকুক না কাদা-মাটির স্পর্শ, অনাবিল ভ্রমণের আনন্দ তার দৃষ্টিকে নির্মল সরস্বতী করে তুলছে। পূজা-অর্চনা পালকে মেখে সে রীতিমতো দেবত্বের অধিকারী, ধীরে ধীরে জল কেটে কেটে ভেসে চলে তরলের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। তরল? হ্যাঁ, তরলই তাকে রাজহংস করে তোলে, তরলই তাকে ভরন্ত করে তোলে, চিকন মাধুর্যে ভরে দেয়। তরলই তাকে আকণ্ঠ ছলছল গদগদ ভাব এনে দেয়। আদরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় সেই রাজহংসের কথা— তরলই যার রাজকীয়তা থেকে পরমবোধকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।




যাত্রা

মায়ার কথা ভাবতে ভাবতে একটি বিষণ্ণ 
বুড়ো ছায়া নেমে আসে চেহারায়,
বর্ষীয়ান প্রাচীন গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকে
বিশালকায় সেই ছায়া—
যার কোলে-কাঁখে অজস্র পরিবার সন্তান সেজে 
সুখে ঘুম দেয়, দোল খায়, আনন্দের 
বারোমাস্যা উদযাপন করে।
আমাদের দুচোখের গভীরেও রয়েছে সেই মায়াটি, 
সেই মহীরুহ— পা ঝুলিয়ে বসে থাকা দিয়ে যে 
আমাদের পার করে দিতে পারে এক অনন্ত বৃদ্ধ যাত্রা।
মহাভারতের মহাপ্রস্থান।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন