পঞ্চপাণ্ডব 

ভয়ে 
বাঘভাল্লুকরা 
কেউ আমাকে মঞ্চ দেয়নি 

তাই 
জঙ্গলে এসেছি 

জঙ্গলের ছায়া 
জঙ্গলের জলাভূমি 
জঙ্গলের ফলমূল 
আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে 

পড়ে যেতে যেতে 
আমি পশুদের পিঠে আটকে আছি 
তাদের কারও দুটো হাত দুটো পা নেই 

চারটেই পা 

আমি 
হঠাৎ হঠাৎ লম্বা হয়ে যাচ্ছি 
হঠাৎ হঠাৎ ছাড় দিচ্ছি 
হঠাৎ হঠাৎ চওড়া হয়ে যাচ্ছি 

আমার নিজেকে পঞ্চপাণ্ডব মনে হচ্ছে 





মৃত্যু উপসর্গ 

প্রতিটি গাছের ভেতর 
শুধুমাত্র গ্রাম নয় 
প্রতিটি নগর সভ্যতা লুকিয়ে থাকে 

এই যে 
কাঠের গুঁড়োয় ভরে যাচ্ছে পৃথিবী 
শুধুমাত্র গাছেরই নয় 
প্রতিটি মানুষেরও হাড়মজ্জার সাদা ঘুণ 
যা আমরা পাউডার ভেবে গায়ে মেখে নিচ্ছি 

আর ওই যে 
গাছের গায়ের কুঠারের কোপ 
সেগুলোও শুধুমাত্র গাছেরই নয় 
মানুষেরও আগামী দিনের গায়ের গভীর ক্ষত 

এগুলোই তো 
মানুষের আগামী দিনের মৃত্যু উপসর্গ হয়ে 
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে শিয়রে 

গাছের 
ছাল-বাকলের কান্নাগুলো মনে করি 
শুধুমাত্র গাছেরই একার 

তার মধ্যে 
আমরা নিজেদেরকে খুঁজে পাই না আদৌ 





সম্পর্ক 

সম্পর্কগুলো 
অনেকটা সময় ধরে 
মটকা মেরে পড়ে থাকে 

তাদের উপর দিয়ে 
তখন 
শান্ত বাতাস বয়ে যায় 
ঠাণ্ডা জল গড়িয়ে যায় 

হঠাৎ হঠাৎ 
তারা জেগে ওঠে 

তখন তারা 
হাসে কাঁদে ভালোবাসা নিবেদন করে 

আশ্চর্য 
তারাই 
ভয়ংকর এবং হিংস্র হয়ে ওঠে 

ঝড়ে বিধ্বস্ত জাহাজ 
অথবা 
পালছেঁড়া নৌকোর কথা 
মনে করায় না কি? 

যার পাশ দিয়ে লাশ ভেসে যায়? 




খাঁজ 

মুখের খাঁজ দেখে 
এড়িয়ে যাওয়াই 
আমাদের অধিকাংশের স্বভাব 

আমরা ধরে নিই 
ভাঙা যৌবন আর 
দেখার মতো থাকে না 

ভাঙা জাহাজ 
ভাঙা নৌকো 
ভাঙা রেল ইঞ্জিন 
এরা এক একটা সিঁড়ি 

সিঁড়ি বেয়ে 
একবার নেমে বা উঠে যান 

দেখবেন 
এরা সবাই অটুট আছে 

এদের খাঁজে খাঁজে 
সৌন্দর্য লুকনো থাকে 





ত্যাগ 

ত্যাগ আসলে 
এক পক্ষের মহত্ত্ব 
আর এক পক্ষের স্বার্থপরতা 

কিন্তু 
দুটোই স্বাভাবিক 

এবং এটা চিরসত্যের মতোই স্বাভাবিক 

আমাদের বুঝতে হবে 
যেকারণে গাছ বেঁটে এবং লম্বা হয় 

আর 
লম্বা গাছকেই 
ঝড়ঝাপটা একটু বেশি সামলাতে হয় 

তার দুঃখও অনেক বেশি 





দারিদ্র্য 

সাত সংখ্যাটি 
ইংরেজি অথবা বাংলা 
যে ভাষাতেই লিখি না কেন 
দারিদ্র্য চিহ্নের মতো মনে হয় 

সেই সাত সংখ্যাটি দিয়েই 
দারিদ্র্য পেরোনোর উপায় খুঁজি 

তা দিয়ে 
একটা সেফটিপিন এবং 
একটি ছাতার কল বানাই 

একজন 
ছেঁড়া পোশাক খামচে ধরে 
আর একজন 
ভাঙা ছাতাকে সাড়াই করে 

এরপর 
পাহাড়ে চড়ার দড়ি এবং গাঁইতির মতো 
ক্রমশ প্রকাশ্য 

দেখবেন একদিন 
দারিদ্র্য ভয়ে ছুটে পালিয়েছে 





কঙ্কাল 

রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে 
হঠাৎ কঙ্কাল দেখে থেমে যাই 
ছবি তুলি 

তারপর 
নিজস্ব মিউজিয়ামে সাজিয়ে রাখি 

একদিন 
হঠাৎ খেয়ালবশত 
রক্তমাংস ও চামড়া লাগিয়ে 
দাঁড় করিয়ে দিই 

আর ভাবতে থাকি 
সেও কোনও অভিজাত পরিবারে জন্মাতে পারত 

এখন মাঝে মাঝেই 
মোহভঙ্গের হতাশায় ভুগতে ভুগতে 
আমি রাস্তায় রাস্তায় 
কঙ্কাল খুঁজে বেড়াই 






চামড়া 

অল্পস্বল্প 
সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র পড়া আমি 
মনে করতাম 
প্রেমিকার অবশ্যই 
পটলচেরা চোখ চাই 

তারপর 
বুক,কোমর ইত্যাদি আরও অনেক কিছু 

একসময় 
সেসব পেরিয়ে এসে মনে হতো 
হাঁটুছেঁড়া জিন্স পরা মেয়েই 
প্রেমিকা হিসেবে ভালো 
কেমন জংলী ভাব আছে একটা 

এখন আবার অন্য ভাবনা 

মনে হয় 
সাধারণ একটা মেয়েই 
প্রকৃত প্রেমিকা হতে পারে 

বুঝতে পারি 
জীবনে লড়াই না থাকলে 
সে প্রেমিকা হয় কীভাবে 

তাতে চামড়া 
কালো সাদা শ্যামবর্ণ যা-ই হোক 





2 মন্তব্যসমূহ

  1. পঞ্চপাণ্ডবদের সঙ্গে সঙ্গে পুরোটাই ঘুরলাম । আপনি আপনার মতোই যথাযথ ।

    উত্তরমুছুন

  2. আপনার কবিতা বাস্তবের রূপক-আশ্রিত এক প্রজ্ঞার রূপান্তর। যন্ত্রণাবিদ্ধ ব্যক্তিহৃদয়ের যুদ্ধ-অভিমুখিন তুমুল ক্রিয়ার অশনিপাত। খুব ক্ষুরধার এবং বিপর্যস্ত ভাঙনের মুখোমুখি দাঁড় করানো আমাদের বিবেক। স্থিতিহীন জঙ্গমের কাছে নিজস্ব আইডেন্টিটি খুঁজতে খুঁজতেই আমরা বিরল জান্তবের কাছে আত্মসমর্পণ করে দিয়েছি।তাই এই বোধ আসা স্বাভাবিক:
    “আমি
    হঠাৎ হঠাৎ লম্বা হয়ে যাচ্ছি
    হঠাৎ হঠাৎ ছাড় দিচ্ছি
    হঠাৎ হঠাৎ চওড়া হয়ে যাচ্ছি

    আমার নিজেকে পঞ্চপাণ্ডব মনে হচ্ছে”
    সত্তার এই বিকৃত বিকিরণ মানসিক বিক্রিয়ারই ফল। অথচ পৌরাণিক অন্বয়ের সাবলীল উত্তরাধিকার থেকে নির্ণীত হয়ে চলে আসছে তার প্রবাহ। একে অস্বীকারও করা যায় না। ‘মৃত্যু উপসর্গ’ করতে করতেই জীবন ও সভ্যতার মোক্ষম প্রচলটিকে কবিও অনুধাবন করেছেন। তাই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই জেগে উঠেছে এই উপলব্ধি:
    “প্রতিটি গাছের ভেতর
    শুধুমাত্র গ্রাম নয়
    প্রতিটি নগর সভ্যতা লুকিয়ে থাকে”
    সভ্যতা যতই পরিবর্তন হোক, মানুষ যতই পরিবর্তিত হোক—জীবনরসায়নে তার মৌলিকত্ব হারাবে না আর এই কারণেই কবি লিখেছেন:
    “ভাঙা জাহাজ
    ভাঙা নৌকো
    ভাঙা রেল ইঞ্জিন
    এরা এক একটা সিঁড়ি
    সিঁড়ি বেয়ে
    একবার নেমে বা উঠে যান
    দেখবেন
    এরা সবাই অটুট আছে
    এদের খাঁজে খাঁজে
    সৌন্দর্য লুকনো থাকে”
    এই সিঁড়ি সভ্যতার নির্ণায়ক প্রতীক। কখনো সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যায়, আবার কখনো নামাও যায়। সিঁড়ি দিয়ে কে নামে, কে ওঠে?
    সিঁড়ি দিয়ে ওঠে সভ্যতা, নামেও সভ্যতা। এই সভ্যতাকে বিনয় মজুমদারও দেখেছিলেন। এই সভ্যতার মধ্যে যুদ্ধ-রক্তপাত, স্বপ্ন-প্রেম-প্রণয়, লীলা ও লীলান্তর বিরাজ করে।
    আমেরিকান অপরাধ এবং রহস্য গল্পের লেখক ইভান হান্টার বা এড ম্যাকবেইন(১৯২৬-২০০৫)বলেছেন:“The world is made of stairs, and there are those who go up and those who go down.”
    অর্থাৎ পৃথিবী সিঁড়ি দিয়ে তৈরি, এবং সেখানে যারা উপরে যায় এবং নিচেও যায়। এই সভ্যতার কাছেই কবি দাঁড়িয়েছেন। কবির সঙ্গী শুধু সময়। সত্তার ভাঙন থেকে, বিচ্ছিন্ন থেকে, নীরবতা থেকে যে শব্দস্বর উত্থিত হয়, কবিতা সেখান থেকেই উঠে আসে। কবি তিরন্দাজ। শুধু শব্দ ছুঁড়ে দেন। আর বোধের চাদরে নিজেকে জড়িয়ে নেন:
    “এখন মাঝে মাঝেই মোহভঙ্গের হতাশায় ভুগতে ভুগতে আমি রাস্তায় রাস্তায় কঙ্কাল খুঁজে বেড়াই”
    সময়ের এই অবিমিশ্র কদর্যতায় নিজের মানবজন্মেও ঘৃণার উদ্রেক হয়। হতাশার নিরবধি জন্ম দিতে থাকেন। তখন বিনয় মজুমদারেরও স্বর শোনা যায়:
    "...আমি যেই কেঁদে উঠি অনির্বাণ আঘাতে আহত তখনি সকলে ভাবে, শিশুদের মতই আমার ক্ষুধার উদ্রেক হলো, বেদনার কথা বোঝে না তো।"
    (মনের নিভৃত ভাগ)
    এই বেদনাই সঞ্চারিত হয়েছে নিয়াজুল হকের কবিতায়ও। যে কবিতার মধ্যে আত্মদর্শ জীবনের প্রজ্ঞাপারমিতা বাহিত হয়ে চলেছে। যে কবিতায় ছলনা নেই। শৈল্পিক বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে জীবনের মর্মরিত চেতনিক ভাষ্য সর্বদা বিরাজমান।
    #
    তৈমুর খান






    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন