সনন্ত তাঁতি'র কবিতা
অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ : বাসুদেব দাস
১
তোমার নাম
তোমার যখন সময়
তখনই আমার দুঃসময়।
তোমার যখন দুঃখ
তখনই আমার ভেতরে
জীবনের জন্য সংঘর্ষ।
তুমি দুহাত মেলে যখন
আনন্দে উৎফুল্লিত হয়ে উঠ
তখনই আমি অন্ধকারে বসে
ফোঁপাতে থাকি।
তোমার শব্দ মুখরিত কাল
আমার কেবল আকাল।
আমার কেবল কেঁপে উঠা বুক
আমার কেবল কেঁপে উঠা হৃদস্পন্দন।
তোমার নাম ভারতবর্ষ
আমি তোমার মানুষ।
২
গাছ এবং নিসর্গের দুঃখবোধের মতো
তোমার বিকাশে এখন আমি উৎফুল্লিত হয়ে উঠি না।
কেবল নিস্পৃহ হয়ে থাকি গাছ এবং নিসর্গের
দুঃখ বোধের মতো।
কেবল তোমার উন্মিলিত চোখ দুটির জেগে উঠা
পাপ এখন আমি নিয়ে বেড়াচ্ছি আমার ধমনীর প্রবাহ
ধারায়। শৃঙ্খলিত আমার বুক থেকে নির্গত নিঃশ্বাস
পর্যবসিত হয়ে পড়ে কেবল তুফানে।
তোমার বিকাশে এখন আমি আনন্দিত হয়ে উঠি না
অকস্মাৎ। তোমার ছড়িয়ে দেওয়া ধ্বনি গুলিতে আমার
মগজের ঘনায়মান স্নায়ু গুলি নেচে উঠে না। আমার
রক্ত গুলি আক্রমণাত্মক হয়ে নিক্ষেপ করে না কোনো
শব্দ। এক একটি ব্যাখ্যার সূচনা হয় না আমার
রক্তগুলিতে। উচ্চকিত হয়ে উঠে না প্রেম। উৎসুক হয়ে
থাকি না কোনো ফলাফলের জন্য।
তোমার দুর্গন্ধে এখন আমার বাস। তোমার পচনশীলতায়
এখন আমার জীবন। তোমার বিষাক্ত
অহংকারে ডুবে আমি শক্তিশালী হয়ে উঠেছি প্রতিদিন।
কেঁপে উঠেছি আশঙ্কায়।
তোমার বিকাশে এখন আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠি না।
তোমার বিকাশে এখন আমার স্বপ্নগুলিও
ক্ষুধার্ত হয়ে উঠে না প্রেম স্পর্শ করার জন্য।
৩
ক্ষমা কর
(কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে)
এবার তোমার বাড়িতে যাওয়া হল না।
সময় ছিল না।
কলকাতার পদপথগুলিতে হাঁটতে হাঁটতে
ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কখনও পাতাল
রেলে উঠে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম কবিতা।
পার্ক স্ট্রিট ময়দান রবীন্দ্র সরণী ভবানীপুর হয়ে
কালিঘাট। কালিঘাটে চলন্ত সিঁড়িতে উঠে
বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম।
রোদ এবং মুক্ত বাতাসে হেঁটে
খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম কবিতা।
অথচ কবিতা তখন শঙ্খ ঘোষের ড্রয়িং রুমে
বসে তাল এবং ছন্দের মহড়া দিচ্ছিল।
অথচ কবিতা তখন লাস্যময়ী হয়ে নৃত্যরতা
হয়ে উঠেছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উঠোনে।
অথচ কবিতা তখন ভেঙ্গে ফেলেছিল নিজের মহিমা চৌরঙ্গি লেনে।
এবার তোমার বাড়িতে যাওয়া হল না
ক্ষমা কর শক্তি দা।
তোমার মাতাল পা ছুঁয়ে আমার স্মৃতিতে
তার ছাপ রাখতে না পারাটা দুর্ভাগ্যজনক।
এমনকি তোমার চুম্বনে কেঁপে উঠা কবিতার
শরীর প্রত্যক্ষ করার দুর্লভ দৃশ্যাবলী থেকে
বঞ্চিত হওয়ার জন্য আমার কম ক্ষতি হল না।
এবার তোমার বাড়িতে যাওয়া হল না।
কেবল ক্ষণিকের জন্য পুরোনো বন্ধু মনোতোষের
সঙ্গে দেখা করে ফিরে এসেছিলাম নিজের জায়গায়।
বোলপুর বর্ধমান ফারাক্কা হয়ে ফিরে আসার সময়
মনে পড়ছিল তোমার কথা। তোমার বাড়িতে
যাওয়ার পরে শূন্য একটি লেটার প্যাডে লিখেছিলে
সনন্ত চিঠি দেবে।
এবার তোমার বাড়িতে যাওয়া হল না।
সময় ছিল না।
এবার তোমার বাড়ি থেকে চুম্বন আনা হল না।
সময় ছিল না।
এবার তোমার কবিতার স্পর্শ নেওয়া হল না।
সময় ছিল না।
আগুন এবং রক্ত একাকার করে মানুষ হওয়ার জন্যও
আমার সময় ছিল না।
ক্ষমা কর।
৪
চলো সমুদ্রের দিকে যাই
চলো সমুদ্রের দিকে যাই। আনত সমুদ্রের মুখ
চুম্বন করি। তার বাতাসে ছড়িয়ে দিই
জীবন। অথবা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করি পাপ।
সমুদ্র থেকে আসা তুফান বাতাসকে এই বধ্যভূমির
নির্দয়তায় ব্যাপ্ত করি। এসো বিশাল হই।
সমুদ্র দেবতা নয় অথবা কলুষ আকাঙ্ক্ষা।
সন্তপর্নে ভাষান্তরিত বিবেকের ধ্বনিত কেবল
প্রজ্ঞার বোধ। অগরু প্রলেপহীন।
চলো সমুদ্রের দিকে যাই। সমুদ্রের মতো বিশাল
হই।অন্তরে বাহিরে।
৫
আমি স্বাধীনতাকামী
আমি স্বাধীনতাকামী।তাই উদযাপন করি নিজের উৎসব।
বাইরে ভেতরে স্নায়ু এবং রক্তের ধাবমান প্রবাহে।নৃ্ত্যরত
রাখি ভালোবাসাকে।আমি ভাঙ্গি পুরোনো অবয়ব।ভেঙ্গে নতুন
হয়ে উঠি।স্বচ্ছ হয়ে উঠি।
আমি স্বাধীনতাকামী।তাই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ি।
নদী এবং আগুনের দিকে ঘৃণা এবং প্রেমের দিকে আমি যাই
নিজের সন্ধানে প্রতিদিন।এমনকি তোমার কাছ থেকে তাঁর
কাছে গিয়ে মাঝে মধ্যে পবিত্র হয়ে উঠি।মাঝে মধ্যে
উৎকীর্ণ হয়ে উঠি তোমার শব্দে।
আমি স্বাধীনতাকামী। তাই প্রতিবাদ করি বাইরে ভেতরে।
পরিচয় :
১৯৫২ সনের ৪ নভেম্বর অসমের করিমগঞ্জের কলিঙ্গ নগর চা বাগানে সনন্ত তাঁতির জন্ম হয়। প্রকাশিত কবিতার সঙ্কলনগুলি যথাক্রমে 'কাইলোর দিনটো আমার হব', 'উজ্জ্বল নক্ষ্ত্রের সন্ধানত', 'মই মানুহর অমল উৎসব', 'আপুনি আপোনার স’তে যুদ্ধ করিব পারিব নে', 'শব্দত অথবা শব্দ হীনতাত' ইত্যাদি। ২০১৭ সনে আসাম ভ্যালি লিটারেরি সম্মান এবং ২০১৮ সনে সাহিত্য 'কাইলোর দিনটো আমার হব' কাব্যগ্রন্থের জন্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন। ২৫ নভেম্বর ২০২১ সনে দিল্লিতে কবির মত্যু হয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন