শূন্যে ফেরিওয়ালা বৃত্তে বেলুন 

পর্ব–৮


এক একটা উৎসব আসে আবার চলেও যায়৷ এভাবেই একের পর এক বছর কেটে যায় আর আমার ঝুলিতে ভরে যায় কত নিত্যনতুন দিন। প্রায় দশ মাস হতে চলল গোয়াতে আছি। আজ মনে হয় ভারতবর্ষে যদি সুন্দর করে বাঁচার জন্য কোন একটি রাজ্য থাকে তা গোয়া৷ জাতি ধর্ম সব মিলেমিশে অদ্ভুত এক সংস্কৃতি। জানেন এবার ক্রিসমাসে কি কী বিশাল উৎসব। রাস্তা ভর্তি স্যান্টা। লাল রঙে সেজে উঠেছে প্রতিটা চার্জ৷ গান বাজনা। রাত দশটার দিকে হঠাৎ কানে এল মাইকে করে স্যান্টা সকলকে মেরি ক্রিসমাস জানাতে জানাতে এগিয়ে যাচ্ছে৷ সন্ধেতে বাড়ির পাশের চার্চে গিয়ে দেখি সে এক ঝলমলে ব্যপার। সত্যি বলতে কি এমন ক্রিসমাস আগে দেখিনি৷ যিশুর জন্ম বৃত্তান্ত পুতুলের আকারে সাজানো ছিল। হাতে তৈরি স্নো ম্যান রেনডিয়ার, কোন কিছুরই অভাব নেই। সমস্ত ফোন্ডাবাসী উপচে পড়েছিল এসব দেখতে। ভিড় বাড়ছে দেখে বাড়ি ফিরে আসি৷ গেটে ঝুলছিল চকলেট লাভা কেক। কে দিল? স্যান্টা? তাই হবে।  

এর আগের বছরগুলোতে ক্রিসমাসের দিনগুলো অন্যরকম কাটতো। যখন ছোট ছিলাম তখন পিকনিক হত। রূপনারায়ণ নদীর তীরে বাড়ির সমস্ত পরিজন মিলে সে কি বিশাল আয়োজন। ছোটমাসি কেক বানিয়ে আনতো। আর থালার পর থালা ফিশফ্রাই কষা মাংস ফ্রাইড রাইস আরো কত কি। আমরা কচিকাঁচারা ব্যাডমিন্টন খেলতাম, ক্রিকেট হত সবশেষে লুডো কিংবা ক্যারাম। আমরা প্রত্যেকেই সেই দিনগুলোকে সোনার দিন বলি, এখন সেসব হয় না বললেই চলে। তবে মাঝেমধ্যে সুযোগ হলে হয় আর পুরনো স্মৃতি আওড়ে আনন্দকে দ্বিগুণ করি। 

এসব তো দেশীয় গল্প। কিন্তু বিদেশে থাকাকালীন অন্যরকম অভিজ্ঞতা। সিঙ্গাপুরে অর্চার্ড রোডে ক্রিসমাস লাইটিং হয়। বিশাল বড় বড় ক্রিসমাস ট্রি আর আমাদের যেমন বারোয়ারি হয় সেরকম ধরনেরই মাটির পুতুল দিয়ে যীশু খ্রীষ্টের জীবনের নানান গল্প তুলে ধরা হয়, এছাড়াও বড় বড় শপিংমল গুলো ঝলমলিয়ে সাজানো হয়। ভিভো সিটি বলে একটা বিরাট শপিংমলের ওপরে গিয়ে আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিতাম মাঝরাত পর্যন্ত। কোন বছর এদিক ওদিক ঘুরতে বেরিয়ে পড়তাম। সবাই মিলে ডিনার বা অন্য কিছু।  ক্যালিফোর্নিয়াতে একেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতা। সানফ্রান্সিসকো বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম ছুটির মেজাজে প্রত্যেকেই নিজের নিজের পরিবারের ব্যস্ত। রাস্তাঘাটে ভিড় প্রায় নেই। দু একজন অসহায় মানুষ কিংবা বলা যায় না খেতে পাওয়া মানুষ সেক্সোফোন বাজিয়ে চলেছে আপন মনে। ওদেশে কেউ ভিক্ষে করেনা বাজনা বাজিয়ে গান করে নিদেন পক্ষে টিস্যু পেপার বিক্রি করে টাকা ইনকাম করে। তবে ক্রিসমাসের জন্য ডেকোরেশন তো ছিলই। চারপাশে শুধু আলো আর আলো। এ আলো যেন অনন্তের আলো। যা কোন এককালে শুরু তো হয়েছিল কিন্তু শেষ আজও হয়নি। 

ক্রিসমাসে আমি কখনো পার্কস্ট্রিটে যাইনি।  আজকাল ওই রিলে দৌলতে দেখি পার্কস্ট্রিটের গমগমে যাপন। মেলার মত লোক এদিক থেকে ওদিক হেঁটে যায়৷ কলকাতাবাসীর এই পার্কস্ট্রিটিও উৎসব না দেখলেও আমি দেখেছি জমজমাট পরিবারের আনন্দ।  যে বছরগুলোতে পিকনিক হতো না বাড়িতে সবাই আসতো পিঠে বানানো হতো। পৌষ মাস চলছে কিনা! আমাদের বাঙ্গালীদের নবান্ন। এও কি কম বড় উৎসব?  বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে বহু চর্চিত এবং উল্লেখযোগ্য একটি উৎসব। প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপূজার প্রসাদ খেতে খেতে অপেক্ষা করি মকরসংক্রান্তির। সকালবেলায় নানান মন্দির থেকে মকর আসবে আর বিকেলে হরেক রকম পিঠের সমাহার। আমাদের ছোটদের এই নবান্নের দিনগুলোতে কোন পড়াশোনাই থাকত না। কারণ ক্রিসমাসের কেক বাঙালির পিঠে নতুন বছরের মিষ্টিমুখ বেশিরভাগটাই জয়নগরের মোয়া,  নলেন গুড় সব মিলিয়ে বলা যায় আনন্দের হাট।  আমার মত প্রত্যেকেরই এরকম যাপন রয়েছে যেখানে তারা প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শেখে আর নিজেদের সংস্কৃতির  পাশাপাশি অনেক নতুন জানতে পারে। একি সত্যিই খুব কম পাওয়া?

(চলবে...)




নীলম সামন্ত

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন