শূন্যে ফেরিওয়ালা বৃত্তে বেলুন 

পর্ব-৭

গত পর্বে দুর্গাপূজার কথা বলছিলাম। প্রবাসে দূর্গাপূজা যেমন তেমন করে পালন হলেও কালীপূজার সময় মানে ওই দীপাবলিটা কিন্তু দারুণ হয়৷ আলোয় আলোময়। তবে কালীপূজার নাম নিশান থাকে না৷ যেহেতু অবাঙালিরা দীপাবলিকে নতুন বছরের সূচনা ভাবে তাই বেশ কিছুদিন স্কুলগুলো ছুটি দেয়, আর সেই সুযোগেই আমরাও তলপিতলপা গুছিয়ে বাড়ি থেকে ঘরে যাই৷ আমার সোনার সবুজ মেদিনীপুর৷ হুড়োহুড়ি করে কাটা টিকিট ব্যাগ ভর্তি শপিং সত্যিই এক হুলুস্থুল আয়োজন।  ঘরেও বোধকরি সকলে অপেক্ষা করে৷ 

এতোবার যাতায়াত করি গল্পের ঝোলা বাড়তেই থাকে। এক একবার ট্রেনে এক একরকম অভিজ্ঞতা।  গতবছর মানে ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় যাচ্ছিলাম। যথারীতি ট্রেনে৷ মিডিলবার্থে সিট পড়েছিল। ট্রেনে যাবার সময় আমার সঙ্গী সব দিনই একটা বই হয়। আর কবিতার বই হলে সেটা পড়ে পাঠপ্রতিক্রিয় লিখি৷ নয়তো বড় উপন্যাস হলে পড়তে পড়তে সময় কেটে যায়। তো সেবার আমি একা যাবার কারণে একটু তাড়াতাড়িই খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়েছিলাম। হাতে বই খোলা। একটু সন্ধে থেকেই পেছনের কম্পার্টমেন্টের সাইড লোয়ার থেকে আওয়াজ আসছিল 'ও বাবা গো'/ 'ও মা গো'। জিজ্ঞেস করায় জেনেছিলাম এক ভদ্রমহিলার খুব পেটের যন্ত্রণা হচ্ছে৷ সত্যিই ভয় পাওয়ার মতো। এই ট্রেনে এতো অসুস্থতা নিয়ে যাবে কোথায়? আরও একে ওকে জিজ্ঞেস করে জানলাম মেয়েটির সাথে দুই মেয়ে আছে বাবা মা আছে৷ এসবের মধ্যেই কিছুক্ষণ কাৎরানো বন্ধ। ভাবি সব ঠিক হয়ে গেছে৷ 

সিটের সবাই শুয়ে পড়তে চায় বলে মিডিল বার্থ ঝুলিয়ে উঠে গেলাম। বই খোলা৷ পড়ছি প্রীতম বসুর কপিলাস্তুর কলস। বইটি আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷ আর আমিও দিক দিশাহারা অবস্থায় এক মনে ছুটে চলেছি৷ ধ্যান ভাঙল  মাথায় টোকা পড়তে। মুখ তুলে দেখি এক মহিলা পুলিশ আমাকে ডাকছেন৷ বলছেন 'ম্যাডাম উন লোগো কো সামঝাইয়ে না৷ আয়সে হালাত মে ক্যায়সে হাওড়া যায়েঙ্গে? নাগপুর মে উতর যানা স্যহি রাহেগা' আমি ভাবছি হল টা কি? জিজ্ঞেস করতে যা শুনলাম চক্ষু একপ্রকার চড়কগাছ।  

ওই যন্ত্রণায় কাৎরানো ভদ্রমহিলাটি ন' মাসের প্রেগন্যান্ট, যার কিনা লেবার পেইন উঠেছে৷ ওদের বাবা মা কিছুতেই শুনতে চায় না। তারা বলে 'আগেকার দিনে ডাক্তার ছিল না। তাও বাচ্চা হত। এখানে নামলে আমাদের কে দেখবে? অচেনা অজানা জায়গা'। কথায় যুক্তি আছে৷ কিন্তু এই অবস্থায় হাওড়া পৌঁছাতে অন্তত ২০ ঘন্টা। কিভাবে থাকা সম্ভব? এই বচসা চলতে চলতে সেই আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটল। অন্তঃসত্ত্বা মা জন্ম দিলেন এক ফুটফুটে পুত্র সন্তানের৷ এই ভাবে তাকে ট্রেনে রাখা যায় না৷ কিন্তু ট্রেন তখন চলছে। পরের স্টেশন নাগপুর৷ পুলিশ ডক্টর কল দিলেন। আমরা সবাই উৎসুক এটা দেখার জন্য এর পর কি হবে! বাচ্চাটা কাঁদছে। সে এক স্বর্গীয় সুর। আম্বালিক্যাল কডে মায়ের সাথে জুড়ে আছে। হঠাৎ দেখলাম আরেকটি মহিলা পুলিশ ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের মধ্য থেকে এক মহিলা গাইনকলোজিস্ট খুজে বের করে আনলেন। উনি এসে দেখেই বললেন পরিষ্কার চাদর, গরম জল কাচি আর একটা ক্লিপ জোগাড় করে দিতে। বুঝলাম আম্বালিক্যাল কড কাটার ব্যবস্থা হচ্ছে৷ নতুন ধপধপে সাদা চাদরে বাচ্চাটিকে মুড়িয়ে দিলেন। কিন্তু কাচি আর ক্লিপ? আমার মুখোমুখি সিটের একজন বললেন তার কাছে একটি গোফ কাটা কাচি আছে। প্রায় নতুন। বলার ধরণে বুঝলাম কয়েকবার ব্যবহার করেছেন৷ আর দু একজন মেয়ে খুঁজে পেতে চুল বাঁধা ক্লিপ বের করে দিলেন। ওই দিয়েই কাজ চালিয়ে দিল ডাক্তার। দেখছি থ্রি ইডিয়টস এর লাইভ টেলিকাস্ট৷ 

হ্যাঁ একেবারেই লাইভ। এমনও হয়। পুলিশ জানালো ছেলেটির আজীবন রেলের টিকিট লাগবে না৷ এদিকে সদ্যজাত শিশুটি সমেত তার মা ও বাকি দুই ভাই দাদু দিদা নেমে গেলেন নাগপুরে৷ রেলের হাসপাতালে তাদের ব্যবস্থা করে দেওয়া হল৷ সকলে লটবহর নিয়ে নেমে গেল৷ রক্ত মাখা সিটের দিকে তাকানো যাচ্ছে না৷ অদ্ভুত গন্ধ। তাও মিডিল বার্থ থেকে দেখলাম প্রাণ ভূমিষ্ট হবার নিশানা কেমন অবহেলায় ছুটে চলেছে, গন্তব্য হাওড়া কার্শেড।

(চলবে...)



নীলম সামন্ত


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন