নারায়ণ ঘোষ
      
  কবি নারায়ণ ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধাতর্পণ




আলপিন ও সূচের কারুশিল্প

আমাদের কবিতা লেখার একবারে গোড়ার দিকে যে মানুষটি তাঁর রোমশ বুকখানি ছাতার মতো মেলে ধরেছিলেন তিনি কবি নারায়ণ ঘোষ।আমাদের প্রতিদিনের বেড়ে ওঠাগুলোকে তিনি একটার পর একটা গেঁথে দিয়েছিলেন অক্ষরবৃত্ত,মাত্রাবৃত্ত আবার কখনো বা মন্দাক্রান্তায়।আমাদের অনুভূতিগুলোকে অবাক করে বেজে উঠেছিলো "বৃষ্টি ঝড় আর রোদ্দুরে পার্শ্ববর্তী সারিবদ্ধ বৃক্ষসমূহ থেকে / উজ্জ্বলতা এসে ছুঁয়ে যায় বুকের অন্তর্গত শব্দস্রোত"(ক্রমাগত এগিয়ে আসছে রেলস্টেশন)।আজও যখন এক একটি মোক্ষম অথচ অনিবার্য পংক্তিমালা ধীরগম্ভীর পায়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে 'গান্ডীব'— পর্বের সেই কবিতাগুলোর কাছে নতজানু না হয়ে পারিনা। আমরা ক্রমাগত শিখতেই থাকি কোথাও কোনো রাজনৈতিক পরিভাষা বা প্রতিশব্দ ব্যবহার না করেও কি করে একটা কবিতাকে তার অমোঘ মন্ত্রোচ্চারে উপস্থাপন করা যায়। যেমন 'টেলিগ্রাম' কবিতাটির কথাই ধরা যাক।সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে গেলেও তার রিচ্যুয়াল আর কমপ্লেক্সগুলো যে একবারে ধুয়েমুছে যায়না অসাধারণ এই পংক্তিবদ্ধতায় কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন তা --- "বাথরুমে ভাঙা শাওয়ারের নিচে এলিয়ে দিয়েছো তবু / অহঙ্কারী রূপ"। আবার কখনো ঘরোয়া আবহে প্রিয় নারীটিকে মূর্ত করে তোলেন  "আসবে বলে কাঁধে ঝোলা তুলে নিলে / বাটনাবাটা ফেলে রেখে তুমি দরজায় হেলান দিয়ে চোখ তোলো / জিরেবাটা হাতের ওপিঠ দিয়ে চোখের দুপাশে চুল সরানোর / অছিলায় চোখ মোছো..."।আন্তর্জাতিক প্রেক্ষোও  কখনো উঠে এসেছে 'উল্টোপাল্টা'-র মতো কবিতায়।কাঙ্খিত ভালোবাসার স্বপ্নে কবি তখন নিজেই নিজের প্রেমাষ্পদ।আর যুবনাশ্ব-র মৃত্যুকে অগস্ত্যযাত্রার সঙ্গে তুলনাও বিদ্যুতচমকের মতো।অতুলপ্রসাদ যেমন লিখেছিলেন "রাখতে যদি আপন ঘরে বিশ্বঘরে পেতামনা ঠাঁই" কবির কাছেও সেরকম "পৃথিবীর সংক্ষিপ্ততম অবসর মানে মানুষের থেকে দূরে থাকা" হলেও ওই বিশ্রামবিলাসটুকুও মানুষের সাহচর্যে চিরলিপ্ত।'গান্ডীব'-পর্বের প্রায় প্রতিটি কবিতার সঙ্গেই যেহেতু আমরা মানে তৎকালীন তরুণরা গভীরভাবে ওতোপ্রোতো তাই তাদের প্রায় সবগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে নিদারুণ নস্টালজিয়া।যেমন 'প্রকৃত ঠিকানার জন্য' কবিতাটির সূত্র ধরে অবলীলায় পৌঁছে যাচ্ছি সেই শ্বাসরোধী দিনটিতে,যেদিন কবি সুশীল ভৌমিক কমপ্লিট হার্টব্লক নিয়ে হাসপাতালে অনিশ্চয়তার প্রহর গুণছেন। আর বেসরকারি সেবাপ্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার অক্সিজেনের ফাঁকা সিলিন্ডার নিয়ে এসে হিরো হয়ে ওঠার মিথ্যে চেষ্টা আগুন জ্বালাচ্ছে বুকে।'ধর্মশালা বা কবি সম্মেলন' কবিতায় 'কবিতাপাগল কিছু যুবক'-দের মধ্যে আমিও কি নাই? 'খুচরো পয়সার খঞ্জনীবাদ্যে নেচে ওঠে ফোপরা ধুকধুকি' তো সেদিনের সেই অতর্কিত খোসবাসপুর অভিযানের পরেই লেখা।সুতরাং নিশ্চিত করে বলা যায় ১৯৬৫ থেকে যে কবিতাযাত্রা সূচিত হয়েছিলো তার বহমানতায় হয়তো সাময়িক বিরতি থাকলে  একবারে যতি টানেননি কবি।"হাতের মুঠো খুলতেই দলা পাকানো চিঠির মধ্যে কবিতার খসড়া" কিছুটা অন্যমনস্ক হলেও সটান মেলে দিয়েছে শিকড়ের ডানা।"ভদ্রাসন শ্মশানের প্রতিশব্দ হলে / নদীর জলোচ্ছ্বাসে নুন বেড়ে যায়" অথবা "সুখকে ভুলতে গেলে দু:খের ভিতর দিয়ে / হেঁটে যেতে হয়" এরকম দর্শনপোলব্ধিতে যেমন তাঁর কবিতা ঋদ্ধ তেমনই "অনাহার আর অপুষ্টি / শব্দদুটি নিয়ে জাগলারি" এজাতীয়  পংক্তির মধ্যে দিয়ে শ্লেষাত্মক বিরুদ্ধাচারও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আর সংসদীয় ব্যবস্থা যে আসলে এক বাস্তব প্রহসন তাও উদঘাটিত হয়েছে খাপখোলা তরবারির মতো কবিতায় --- "ভোট নামক একধরনের ক্যাসেট যেটা যাত্রাগানের নাকি / গণতন্ত্র নাম মশালা ফিল্মের তা অবশ্য এখন বোঝা যাচ্ছেনা" (আয়না)।প্রকৃত অর্থে লোকতন্ত্র আসলে যে প্রসবিত অশ্বডিম্ব ছাড়া কিছু নয় তাও উপলব্ধের বাইরে রাখেননি কবি --- "পৃথিবীতে তোমার কোনো প্রকৃত আশ্রয় নেই।প্রকৃত প্ল্যাটফর্ম নেই। / প্রকৃত তদন্ত নেই।গণতন্ত্র তো নেই-ই" (তদন্ত)।সর্বোপরি হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যৌনালয়ের তুলনা নি:সন্দেহে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক দ্ব্যর্থহীন প্রতিবাদ।

বাংলা কবিতার দীর্ঘ পরিক্রমায় কবি নারায়ণ ঘোষ বারবার ভেঙেছেন নিজেকে,কবিতাকেও।কখনো তিনি ইকো-রিয়ালিস্ট --- "কুঠারের সাহচর্যে উঠে যাচ্ছে বৃক্ষের বসবাস / জঙ্গল হারিয়ে ফেলছে গন্ধ সবুজের / জটায়ু ডানার মতো পড়ে যাচ্ছে প্রশাখার হাত" (ছিঁড়ে যাচ্ছে)।আবার কখনো তীব্র মানবিক অবক্ষয়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও একজন প্রবল হিউম্যানিস্ট  --- "আমি শোভনার চোখের ভাষায় পড়লাম / অসহায়তার স্ট্রেচার"(ই.এন.টি হাসপাতাল)।পরিবেশ, প্রিয়জন সবকিছুই প্রসঙ্গিক হয়ে উঠেছে বিষয়ের স্বকৃত নির্বাচনে। বাবলাবন,হিদুদার চা-দোকান,ন্যাটাতলা,মিসেস হেস্টিংসের কবর কোনোকিছুই বাদ যায়নি।একে একে প্রিয় মানুষদের লোকান্তর সর্বংসহা করেছে তাঁকে।রবীন(বিশ্বাস)-এর মৃত্যুতে লিখলেন "বুকের বাতাস কমে আসছিলো জেনেও তুমি চোখের পলক / নামাওনি"। কবি সুশীল ভৌমিক ও শুভ(চট্টোপাধ্যায়)-এর অস্তাচলগমনে বিষাদঘণ মুলতানী হাহাকার আমাদের বুকে বিঁধে দিয়েছেন অতি সহজ কথার বন্দিশে --- " শুভ নেই,তেইশে সেপ্টেম্বর আছে / সুশীলদা নেই,বাইশে অক্টোবর আছে"(অনুপস্থিতি)।

কবিতা থেকে উত্তর কবিতা বা সময় থেকে উত্তর সময়ের পর্যটনে আমাদের অবস্থানও যখন আবছা ও একাকীত্বের আলটিমেট ক্র‍্যাচের দিকে ক্রমশ ক্রমাগ্রসরমান কবি নারায়ণ ঘোষ তখনও তাঁর হাতের প্ল্যাকার্ডটি তুলে ধরেছিলেন "আমি শেষবারের মতো কবিতায় ভাঙচুর বা / প্রকৃত রঙের স্পর্শ দেখে যেতে চাই"।


শান্তিময় মুখোপাধ্যায় 



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন